এই মেঘনার কাছে
যতবার আসি ততবারই
মনে উকি দেয়
ছেলে বেলায় পড়া
কবি শামসুর রহমানের
কবিতার দুটো চরণ
"মেঘনা নদী দিব
পাড়ি কল-অলা
এক নায়ে’ আবার
আমি যাব আমার
পাড়াতলী গাঁয়ে ”।
এই কবিতার শেষ
লাইনটি আমার প্রিয়
এক বাক্য “মনে
আমার ঝলসে ওঠে
একাত্তরের কথা, পাখির
ডানায় লিখেছিলাম - প্রিয়
স্বাধীনতা”।
আমরা যেই চরে
যাচ্ছিলাম সেটি কবি
শামসুর রহমানের জেলা নরসিংদীর উত্তরের শেষ সীমানা। এই মেঘনা ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর নরসিংদীকে ভাগ করেছে। ০৯ জনের ছোট দলটিকে নিয়ে নৌকাটি যখন চরের কিনারে ধাক্কা দিল। তখন পুরো চারটি মনে হলো কেঁপে উঠল। চলমান নৌকা হঠাৎ করে থেমে যাওয়ায় মাথা দুলে উঠল; নাকি কবিদের আগমনে তাদের স্বাগত জানালো তা বুঝতে পারলাম না।!
আমাদের ছোট নৌকাটি তখন যেন সিন্দাবাদের জাহাজ। সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এসে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে একে একে পা রাখলাম চরের মাটিতে। অনতিদূরের গাছপালা আর কিছু বাড়িঘর ভেদ আলোর চুম্বন করে দিল শেষ বিকেলের সূর্য। ছেলেবেলার চেনা বুনলতা আর বুনো ফুলগুলো যেন মাথা নুয়ে নিয়ে বলল- সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এতদিন পর কোথা থেকে তুমি এলে ?
এদিকে গায়ের পথে বনফুল দেখেই আমার শহরের পথশিশুর কথা মনে পড়ে গেলো, ঠিক যেমন শহরে পথে পথে পথশিশু দেখলে গ্রামের বুনো ফুলের কথা মনে পড়ে যায়। মানুষ ও তরু এই দুই শ্রেণিই অনাদর অবহেলায় বেড়ে ওঠে কিন্তু সৌন্দর্য ও সুবাস ছড়ায় ঠিকই। কোন ফুলের কি নাম, কোন লতার কি কাম। ছোটবেলায় এসব দিয়ে কে কি খেলেছে- সেসব স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে আমরা এগিয়ে গেলাম বেশ কিছুদূর।
দুই একটি ফিঙে এপাশ থেকে ওপাশে উড়তে উড়তে জানান দিল সন্ধ্যা হয়ে এলো প্রায়। সন্ধ্যা নামার আগে আমাদের নদী পাড়ি দিতে হবে। যেতে হবে ওপারের গাছতলায়। ফেরার পথে ফুটে থাকা কিছু বনফুলের ছবি উঠানোর জন্য শরীরটা একটু নিচু করতেই ফুলগুলো ফিসফিসিয়ে আমাদের বলল- আমরা কি নিজের জন্য ফুঁটি। আমরাতো তোমাদের জন্যই প্রস্ফুটিত হই। তবে রোজ আসো না কেনো ?’ উত্তরে আমি বললাম- আসবো বন্ধু আসবো, মিলনের অপেক্ষা সম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধি করে, বলো তাই নয় কি ? তিন বছর আগেওতো তোমাদের কাছে এসেছিলাম, মনে
পড়ে ?।
ফুল-পাখিকে বিদায় জানিয়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম নৌকার দিকে।
ফেরার সময় আমির হোসেন স্যার নৈঋত কোণে আঙুল উঁচিয়ে দেখালেন ‘চরকেদরখোলা’ নামক স্থানটি। যে চরকে কেন্দ্র করে তিনি একটি উপন্যাস লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যের যে কয়েকটি নদীভিত্তিক উপন্যাস রয়েছে তার সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে এই চরকেদারখোলা উপন্যাস। কয়েকবছর ধরে এই উপন্যাসের কাহিনি, চরিত্র ও পরিবেশ ও লোকজউপদান সম্পর্কে আমি সম্মুখ জ্ঞাত। কোনোদিন হয়তো সেই চরে যাব- এই আশাবাদ ব্যক্ত করে আমরা নৌকাতে উঠলাম। আমাদের আরো আগেই চরের এক পাশে নামিয়ে অনেকটা এগিয়ে এসে নদীর এক কিনারে অপেক্ষা করছিল নৌকার মাঝিটি তরুণ ছেলেটি । —--
শুরুতে বলছিলাম নদীর কিছু অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। নদীর কাছে এলেই মানুষ উদাস হয়ে যায়। মনের ভিতর চেপে থাকা কষ্টগুলো মুহূর্তের জন্য কোথাও যেন উধাও হয়ে যায়। নদীর কাছে আসলে মানুষের স্মৃতিশক্তি আরো প্রখর হয়ে ওঠে। ভাঁজে ভাঁজে সাজানো মেঘের মতো লুকিয়ে থাকা স্মৃতিগুলো হঠাৎ জীবন্ত হয়ে ওঠে। নদীর কাছে আসলেই মনে গুনগুন ওঠে কোনো না কোনো গানের কলি, কবিতার কোনো চরণ। আমার মনে মনে তখন গুণগুণিয়ে উঠলো -
ওরে আমার পাগলা মাঝি
পাগলা তর বৈঠা নে রে
আমি আর বাইতে পারলাম না ॥
ঈশান কোণে সাজ কইরাছে
মেঘ ডাইকাছে বায়ু কোণেরে ।
আমি ঠেকলাম ওরে পাগলা মাঝি
নাও ভিড়াইতে উল্টা টানে ॥
হাসন রাজার ভাঙ্গা তরী
নাই যে কড়ি, নাই কাণ্ডারী
আমি মধ্যিখানে ডুইবা রইলাম
কার কাছে কই, কেবা শুনে ॥
—---------
আসা যাওয়ার পথে ছবি ওঠাতে ভুল হয়নি আমাদের। ছবি তুলতেই তুলতেই সহসাই আমাদের নৌকা মেঘনা পাড়ি দিয়ে চলে আসলো নবীনগরের গাছতলা নামক স্থানে।
–চলবে।
চানপুরের চর: এক বিকালের গল্প
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
২৩ জুন ২৫
0 মন্তব্যসমূহ