Ticker

6/recent/ticker-posts

চানপুরের চর: এক বিকালের গল্প


মেঘনা পেরিয়ে চাঁনপুরের চর, সেখানে বসেছিল এবারের কবিতা পাঠের আসর। দিনটি ছিল ২১ জুনের বিকেল। বছরের দীর্ঘতম দিন বলে সেদিন বিকেলটা হয়েছিল বেশ লম্বা। ফলে বেশ সময় নিয়ে মেঘনা দেখার সাধ মেটানো গেলো। যদিও আমাদের অপেক্ষা ছিল টিমের বাকি সদস্যদের জন্য। অবশেষে তারা এলেন। লালপুরের মিষ্টিতে মুখ ভিজিয়ে আমরা সবাই বসে পড়লাম একটি ছোট নৌকায়।


নদীর কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য রহস্য আছে ! তীর থেকে নদীকে শান্ত মনে হলেও বুকে আসলে তার ঢেউয়ের ক্ষিপ্ততা বোঝা যায়। আবার নদীর উপরিভাগের স্রোত যত বেশি  উদ্ধেল, নিচের স্রোত তত বেশি শান্ত। উপরিভাগের জল যত উষ্ণ, ভিতর জল ততটাই শীতল। নদীর উপরিভাগ যত আলোকিত, ভিতর ততটাই অন্ধকার। নদী কোথাও ঐশ্বর্য বিলায়, কোথাও ভেঙ্গেচুরে নিশ্চিহ্ন করে দেয় তীরের সবকিছু। নদীর সাথে মানুষেরও কিছু মানুষের বেশ মিল- বক্ষে বিশাল ধনভাণ্ডার নিয়ে কখনো নীরবে- কখনো সরবে বয়ে যায় কত নদী।

এই মেঘনার কাছে যতবার আসি ততবারই মনে উকি দেয় ছেলে বেলায় পড়া কবি শামসুর রহমানের কবিতার দুটো চরণ "মেঘনা নদী দিব পাড়ি কল-অলা এক নায়েআবার আমি যাব আমার পাড়াতলী গাঁয়ে এই কবিতার শেষ লাইনটি আমার প্রিয় এক বাক্যমনে আমার ঝলসে ওঠে একাত্তরের কথা, পাখির ডানায় লিখেছিলাম - প্রিয় স্বাধীনতা


আমরা যেই চরে যাচ্ছিলাম সেটি কবি শামসুর রহমানের জেলা নরসিংদীর উত্তরের শেষ সীমানা। এই মেঘনা ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর নরসিংদীকে ভাগ করেছে। ০৯ জনের ছোট দলটিকে নিয়ে নৌকাটি যখন চরের কিনারে ধাক্কা দিল। তখন পুরো চারটি মনে হলো কেঁপে উঠল। চলমান নৌকা হঠাৎ করে থেমে যাওয়ায় মাথা দুলে উঠল; নাকি কবিদের আগমনে তাদের স্বাগত জানালো তা বুঝতে পারলাম না।!

আমাদের ছোট নৌকাটি তখন যেন সিন্দাবাদের জাহাজ। সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এসে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে একে একে পা রাখলাম চরের মাটিতে। অনতিদূরের গাছপালা আর কিছু বাড়িঘর ভেদ আলোর চুম্বন করে দিল শেষ বিকেলের সূর্য। ছেলেবেলার চেনা বুনলতা আর বুনো ফুলগুলো যেন মাথা নুয়ে নিয়ে বলল- সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এতদিন পর কোথা থেকে তুমি এলে



এদিকে গায়ের পথে বনফুল দেখেই আমার শহরের পথশিশুর কথা মনে পড়ে গেলো, ঠিক যেমন শহরে পথে পথে পথশিশু দেখলে গ্রামের বুনো ফুলের কথা মনে পড়ে যায়। মানুষ তরু এই দুই শ্রেণিই অনাদর অবহেলায় বেড়ে ওঠে কিন্তু সৌন্দর্য সুবাস ছড়ায় ঠিকই। কোন ফুলের কি নাম, কোন লতার কি কাম। ছোটবেলায় এসব দিয়ে কে কি খেলেছে- সেসব স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে আমরা এগিয়ে গেলাম বেশ কিছুদূর।


গোধূলি বেলা ! উদরপূর্ণ করা গরুগুলো ঘাস খেতে খেতে বারবার মাথা উঁকি দিয়ে দেখছিল আমাদের। ভাবছে- ওই বুঝি এলো রাখাল; নিয়ে যাবে বাড়ি। মা পাখিদেরও পেটভরা তখন। তারা বাসায় রেখে আসা ছানাদের জন্য সংগ্রহ করছিল কিছু কীটপতঙ্গ আর দানাদার খাবার। মাঠের ঘাস, মাথার উপর মেড্ডা গাছ, কিছু বনলতা আর পাখিদের কলরবতারা যেন আল মাহমুদের সুরে বলে উঠল- “পকেট থেকে খোলো তোমার পদ্য লেখার ভাঁজ, রক্তজবার ঝোপের কাছে কাব্য হবে আজ।” 


কবি আল মাহমুদের পকেটে ভাঁজ করা পদ্য থাকলেও আমাদের তা ছিল না। আমাদের ছিল স্মার্টফোন। একে একে পকেট থেকে বের করে তা থেকেই নিজ নিজ কবিতা পাঠ করে শোনালেন সবাই। আমাদের এবারের ভ্রমণের সিন্দাবাদ . শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক স্যার শোনালেন তার সদ্য লেখা অসমাপ্ত একটি কবিতা। এই কবিতার একটি লাইন ছিল অসাধারণনৌকাটি ছিল কাগজের কিন্তু তা চলছিল আমির হোসেন স্যার, হুমায়ূন কবির ভূঁইয়া ভাই, ফেরদৌসুর রহমান ভাই, হেলাল উদ্দিন হৃদয় ভাই এবং আমি নিজ নিজ ঝুলি থেকে কবিতা পাঠ করে শুনালাম। সংস্কৃতিকর্মী ফারুক আহমেদ ভূইয়া ভাই, শিল্পী আনিসুল হক রিপন ভাই সমাজসেবক এম. . সাহেদ ভাই আজ মুগ্ধ স্রোতা।


দুই একটি ফিঙে এপাশ থেকে ওপাশে উড়তে উড়তে জানান দিল সন্ধ্যা হয়ে এলো প্রায়। সন্ধ্যা নামার আগে আমাদের নদী পাড়ি দিতে হবে। যেতে হবে ওপারের গাছতলায়। ফেরার পথে ফুটে থাকা কিছু বনফুলের ছবি উঠানোর জন্য শরীরটা একটু নিচু করতেই  ফুলগুলো ফিসফিসিয়ে আমাদের বলল- আমরা কি নিজের জন্য ফুঁটি। আমরাতো তোমাদের জন্যই প্রস্ফুটিত হই। তবে রোজ আসো না কেনো ?’ উত্তরে আমি বললাম- আসবো বন্ধু আসবো, মিলনের অপেক্ষা সম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধি করে, বলো তাই নয় কি ? তিন বছর আগেওতো তোমাদের কাছে এসেছিলাম, মনে পড়ে ?। ফুল-পাখিকে বিদায় জানিয়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম নৌকার দিকে।



ফেরার সময় আমির হোসেন স্যার নৈঋত কোণে আঙুল উঁচিয়ে দেখালেনচরকেদরখোলা’ নামক স্থানটি। যে চরকে কেন্দ্র করে তিনি একটি উপন্যাস লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যের যে কয়েকটি নদীভিত্তিক উপন্যাস রয়েছে তার সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে এই চরকেদারখোলা উপন্যাস। কয়েকবছর ধরে এই উপন্যাসের কাহিনি, চরিত্র পরিবেশ লোকজউপদান সম্পর্কে আমি সম্মুখ জ্ঞাত। কোনোদিন হয়তো সেই চরে যাব- এই আশাবাদ ব্যক্ত করে আমরা নৌকাতে উঠলাম। আমাদের আরো আগেই চরের এক পাশে নামিয়ে অনেকটা এগিয়ে এসে নদীর এক কিনারে অপেক্ষা করছিল নৌকার মাঝিটি তরুণ ছেলেটি —--

 

শুরুতে বলছিলাম নদীর কিছু অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। নদীর কাছে এলেই মানুষ উদাস হয়ে যায়। মনের ভিতর চেপে থাকা কষ্টগুলো মুহূর্তের জন্য কোথাও যেন উধাও হয়ে যায়। নদীর কাছে আসলে মানুষের স্মৃতিশক্তি আরো প্রখর হয়ে ওঠে। ভাঁজে ভাঁজে সাজানো মেঘের মতো লুকিয়ে থাকা স্মৃতিগুলো হঠাৎ জীবন্ত হয়ে ওঠে। নদীর কাছে আসলেই মনে গুনগুন ওঠে কোনো না কোনো গানের কলি, কবিতার কোনো চরণ। আমার মনে মনে তখন গুণগুণিয়ে উঠলো -

 

ওরে আমার পাগলা মাঝি

পাগলা তর বৈঠা নে রে

আমি আর বাইতে পারলাম না

ঈশান কোণে সাজ কইরাছে

মেঘ ডাইকাছে বায়ু কোণেরে

আমি ঠেকলাম ওরে পাগলা মাঝি

নাও ভিড়াইতে উল্টা টানে

হাসন রাজার ভাঙ্গা তরী

নাই যে কড়ি, নাই কাণ্ডারী

আমি মধ্যিখানে ডুইবা রইলাম

কার কাছে কই, কেবা শুনে

—---------

আসা যাওয়ার পথে ছবি ওঠাতে ভুল হয়নি আমাদের। ছবি তুলতেই তুলতেই সহসাই আমাদের নৌকা মেঘনা পাড়ি দিয়ে চলে আসলো নবীনগরের গাছতলা নামক স্থানে।

চলবে।

 চানপুরের চর: এক বিকালের গল্প

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

২৩ জুন ২৫


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ