ইজরাইলের দিকে তেড়ে আসা প্রতিটি ইটের টুকরো নিক্ষেপকারীর ব্যক্তির ধর্ম, দেশ কিংবা জাত খুঁজতে নেই। নিরেট সমর্থন দিতে হয়। স্বাধীনতার প্রশ্ন ব্যতীত অন্য যেকোনো কারণে আমি আমরা যুদ্ধবিরোধী হলেও বিশ্বমানবতার শত্রু ইজরাইলের বিরুদ্ধে যে কোনো যুদ্ধের প্রতি আমরা পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাব। কেননা যুগ যুগ ধরে নিরস্ত্র, নিরপরাধ ফিলিস্তিনিদের উপর বর্বর ইজরাইলিদের গণহত্যা ও ধ্বংস লীলার পরিপ্রেক্ষিতে ইজরাইলিদের প্রতি বিশ্ববাসীর অধিকাংশ মানুষের কোনো ধরনের নৈতিক সর্মথন নেই। হয়তো কোনো কোনো রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ইজরাইলের পক্ষাবলম্বন করলেও সেই রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণ ইসরাইলের বিপক্ষেই অবস্থান নিয়েছে এবং নেবে।
আর তাইতো গত কয়েকদিন যাবত ইজরাইলের আকাশে ছুটে আসা ইরানের রকেটের গোলাগুলো পৃথিবীর বহু মানুষের মনে নতুন বর্ষ উদযাপন উপলক্ষে আতশবাজির দেখার মতোই আনন্দ উপহার দিচ্ছে । আমরা জন্মের পর থেকেই ইজরাইলের আগ্রাসী মনোভাব আর ফিলিস্তিনিদের উপর তাদের নিপীড়নের ভয়াবহ চিত্র দেখে এসেছি । এই ইজরাইল একদিন নাস্তানাবুদ হবে এরকম একটি প্রত্যাশা থাকলেও এত তাড়াতাড়ি তা দেখতে পাবো এটি ছিল অপ্রত্যাশিত। ইরান আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে। যদিও যুদ্ধে আপাতত ইরানের হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি, তথাপি সারা বছর ফিলিস্তিনীদের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি দেখে ইরানের এসব ক্ষয়-ক্ষতিকে সামান্য বলেই প্রতীয়মান হয়।

তেলআবিবের রাতের আকাশ ইরানীয়দের উপহার পাঠানো বারুদের গোলায় দিনের আলোর মতো ঝলমলিয়ে উঠছে। একে একে ধূলিসাৎ হচ্ছে তাদের সামরিক ও প্রশাসনিকসহ বিভিন্ন জাতীয় বিভিন্ন স্থাপনা। প্রাণভয়ে দিক-বেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে সেখানকার বাঁদর-বাসিন্দারা। এসব দৃশ্য ছিল আমাদের কল্পনারও বাইরে। অবুজ ফিলিস্তিনি শিশুদের মেরে ফেলা যারা জন্মগত অধিকার মনে করত, এখন তাদের বেঁচে থাকার এই চেষ্টা মজলুম, নিষ্পেষিত মানুষের চক্ষুকে শীতল করে তোলে। রাত জেগে জেগে আমরা এখন মহানন্দে ইরানের হাইপারসোনিক রকেটের আতশবাজির আনন্দ দেখি, আবার ভোরে উঠে ফেসবুক খুলে খোঁজ নিই ইসরাইলের কোন কোন শহর রাতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো। হয়তো একদিন ঘুম থেকে উঠে জানতে পারবো ইয়াহুদিবাদের আস্তানা ইজরাইল চিরতরে মাটির সাথে মিশে গেছে ! জানি সহসা তা হবে না ।
ধর্মীয় মতপার্থক্য, মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক আধিপত্যবাদ, বিভিন্ন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও বিশ্ব রাজনীতির কূটকৌশলসহ নানা কারণে শেষ পর্যন্ত হয়তো ইরান পরাজিত হবে। তাদের পরিণতিও ইরাক বা আফগানিস্তানের মতো হবে। কিন্তু তারপরেও দীর্ঘদিন ইজরাইলের অহংকারের আয়রনডোমের বর্ম ভেদ করে তাদের বিভিন্ন স্থাপনায় রকেট হামলার নজির, ইরানিদের সাহস, সক্ষমতা ও লড়াকু দৃষ্টিভঙ্গির জন্য পৃথিবীর মানুষের কাছে বীরের মর্যাদায় আসীন থাকবে। অতীতে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর তাকে স্বীকৃতি দিয়ে ইরান যে ভুল করেছিল বর্তমান আঘাত, পালটা-আঘাত তাদের সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত বলেই মনে করি।

যদিও অসম্ভব তারপরও যদি কোনো মিরাকল ঘটিয়ে এই মুহূর্তে ইজরাইলের আশেপাশে থাকা আরব রাষ্ট্রগুলো নিজেদের দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব ভুলে এক ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইরানের পক্ষে দাঁড়ায় তাহলে ইজরাইল নামক এই বর্বর রাষ্ট্রটি চিরতরে তাদের অস্তিত্ব হারাবে। কিন্তু এমনটা হওয়ার নয় ! দেশে দেশে, যুগে যুগে যে বিশ্বাসঘাতক, বেইমান এক জনগোষ্ঠীর জন্ম নেয়; প্রাচুর্যে ডুবে থাকা বর্তমান শৌখিন আরব রাষ্ট্রের শিরায় শিরায় তাদের সরব উপস্থিতি। কাজেই শক্তি ও অপশক্তির এবং সত্য ও মিথ্যার এই লড়াই ইরানকে একাই লড়তে হবে। ফিলিস্তিনবাসীর মতো ইরানের জন্য দোয়া করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই।
সত্য এবং মিথ্যার লড়াই অবশ্যম্ভাবী। এই লড়াই অতীতেও চলমান ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।। জয়, পরাজয় যাই হোক, ইতিহাস সত্যের পক্ষে লড়া মানুষকেই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ রাখে। জয়ী হয়েও বহু যোদ্ধা বিশ্ব ইতিহাসে খলনায়ক হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। পরাজয়বরণ করেও সাদ্দাম ইতিহাসের নায়ক হিসাবেই আখ্যায়িত হয়েছে এবং জর্জ বুশ হয়েছেন ইতিহাসের ভিলেন। আমাদের দেশেও পরাজয়বরণ করে সিরাজউদ্দৌলা হয়েছেন ইতিহাসের নায়ক মূর্তি, জয়ী হয়েও মীরজাফর আখ্যায়িত হয়েছে বিশ্বাসঘাতকের প্রতিকৃতি হিসেবে। কাজেই যুদ্ধজয় করাই গৌরবের বিষয় নয়, গৌরবের বিষয় হলো সত্যের সঙ্গে থাকা এবং সত্যের পক্ষে লড়াই করা। সেটা সরবে হোক কিংবা নীরবে, অস্ত্রে হোক কিংবা কলমে।
লেখা শেষ করছি ইরানের বিখ্যাত কবি শেখ সাদীর একটি উক্তি দিয়ে। তিনি বলেছেন-
“হিংস্র বাঘের উপর দয়া করা,
নিরীহ হরিণের উপর জুলুম করার নামান্তর।”
-------------------
মুক্তগদ্য: ইরান-ইজরাইল যুদ্ধ: শক্তি ও অপশক্তির লড়াই
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
১৭ জুন ২৫
ছবি: বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘরের ত্রি-ডি আর্ট গ্যালারি।
0 মন্তব্যসমূহ