মানুষের কী অদ্ভুত নেশা ! জীবিত মানুষকে মেরে-কেটে, ঠকিয়ে-ঠেকিয়ে থাকে নিজের ষোলআনা আদায় করে নেওয়ার এই ঘোর অন্ধকার সময়ে মনু মিয়া মৃত মানুষের সেবায় কবর খোঁড়ার মতো পরিশ্রমের কাজটিকে বেছে নিয়েছেন। অনেক বছর আগে মাত্র ১৭/১৮ বছর বয়সে সদ্য কৈশোর পেরোনো এক তরুণ কবর খোঁড়ার কাজটি কেনো বেঁচে নিয়েছিলেন জানি না। জেনে কাজও নেই।
আমাদের সমাজে আশেপাশে এমন অনেক পাগলাটে, খ্যাপাটে, নির্লোভ, নিঃস্বার্থ, নিরঅহংকারী মানুষ আছেন- যারা আমাদের মতো সাত-পাঁচ, নয়-ছয় না ভেবেই মানুষের সেবায় নিজেকে নিবেদিত করেন। পত্র-পত্রিকায় নিজেকে উজার করা এ সমস্ত অনেক লোকের খোঁজ আমরা মাঝেমধ্যে পাই। তাঁদের কেউ গাছ লাগাচ্ছেন, কেউ বই বিতরণ করছেন, কেউ বিনা পয়সায় চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন, কেউ শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন। কেউবা গড়ছেন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। আরো কত মানুষ কত ভাবে সেবা করে যাচ্ছেন মানুষ ও পশুপাখির।
১০/২০ টাকার ভিক্ষে দিতে, কাউকে ১০০/২০০ বা হাজার টাকার ধার দিতে হলে আমরা যেখানে দুই/চারবার ভাবি, সেখানে নিঃস্বার্থভাবে লাখ লাখ, কোটি কোটি টাকা খরচ করেন কেউ কেউ। হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করে নিজের আখের গোছানোর চেষ্টার মানুষ যেমন এই সমাজে আছে, তেমনি কোটি কোটি টাকা নিঃস্বার্থভাবে বিলিয়ে দেওয়ার মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়।
সমাজে আলো ছড়ানো এসব মানুষ আছে বলেই সমাজ-রাষ্ট্র এখনো টিকে আছে। বেঁচে আছে মানবতা নামক শব্দটি। এ সকল মানুষদের কথা শুনলে শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নুয়ে আসে। তাদের আগলে রাখা উচিত। তাদের যথাযোগ্য সম্মান এবং মর্যাদা দেওয়া উচিত। কিন্তু আমরা কি তা করি ? কই নাতো ! খোঁজ দিলে দেখবেন আমাদের আশেপাশে এরকম অনেক মানুষই আছে। তাদের কয়জনকেই আমরা মূল্যায়ন করেছি বলুন ?
আমরা দৌড়াই এমন মানুষের পিছনে যারা সমাজের জন্য খুব ভালো কিছু করে না। আমাদের শ্রদ্ধা জানানোর তালিকায় থাকে অযোগ্য রাজনৈতিক নেতা, দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা, ভণ্ড ধর্মীয় গুরু আর কিছু সুবিধাবাদী মানুষ। যারা আমাদেরকে দেয় কম; নেয় বেশি বা আমাদেরটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাদেরকে দেয়- তাদেরকে আমরা মাথায় তুলে রাখি। আর বারবার অবমূল্যায়ন করি নিঃস্বার্থভাবে সমাজসেবা করা মানুষদেরকে। তেমনভাবে করা হয়েছে কবর খোঁড়া মনু মিয়াকেও।
মনু মিয়ার এখন বয়স হয়েছে। হেঁটেতো আর সব জায়গায় যাওয়া যায় না। আবার সব রাস্তায় গাড়িও চলে না। দিনে দুপুরে, রাত-বিরাতে কবর খুঁড়তে নানা জায়গায় যেতে সমস্যা হয় তাই নিজের জমি বিক্রি করে কয়েক বছর আগে তিনি একটি ঘোড়া কিনেছিলেন। আমাদের গ্রামগঞ্জ বিশেষত কিশোরগঞ্জের মতো হাওর এলাকায় কবরস্থান যে স্থানে রয়েছে, সে সমস্ত জায়গায় যাতায়াত যথেষ্ট দুঃসাধ্য। সেসব জায়গায়, ঘোড়ার দিয়ে উঁচু-নিচু পথ, ক্ষেতের আল দিয়ে যাতায়াত সহজ হবে ভেবে তিনি ঘোরাটি ক্রয় করেছিলেন।
মনু মিয়া কিছুদিন পূর্বে অসুস্থ হওয়ায় ভর্তি হয়েছেন ঢাকার একটি হাসপাতালে। সাথে ছিলেন তার স্ত্রী। ঘোড়াটিকে শূন্য বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন। এই সুযোগে এক বা একাধিক দুর্বৃত্ত ঘোড়াটিকে নিয়ে চুরি করে নিয়ে হত্যা করে ফেলে রাখে পাশের উপজেলার এক মাদ্রাসার পাশে। গত ১৫ মে বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনা মনু মিয়াকে জানায়নি তার আত্মীয়-স্বজন। একেতো তিনি অসুস্থ, তার ওপর প্রিয় ঘোড়াটি হওয়ার খবর তিনি সইতে পারবেন কিনা, ভেবে তাকে তা জানানো হয়নি।
কিন্তু পত্রপত্রিকাতে এটি নিউজ হয়েছে।সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে খবরটি ভাইরাল হয়েছে সারাদেশে। এই নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এক কান, দু-কান করে মনু মিয়া নিজেও। দোষীদের গ্রেপ্তার এবং শাস্তির দাবির পাশাপাশি অনেকেই তাকে একটি ঘোড়া কিনে দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। হাজারো অন্ধকারের মাঝে কিছু আলোর ঝলমলে হাতের দেখা আমরা মাঝে মাঝে পাই। তাই বলেই এতো হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির মাঝেও আমরা আশা নিয়ে বেঁচে থাকি।
আমাদের দেশে একের পর এক ঘটনা-দুর্ঘটনা, অন্যায় অত্যাচারের ঘটনা ঘটে যে কোনটা রেখে কোনটা লিখি ভাবতে ভাবতেই আরো কয়েকটা ঘটনা ঘটে যায়। আবার কোনটা লিখতে গিয়ে নিজের উপর বিপদ ডেকে আনি সেটাও ভাবতে হয়। এর আগেও লেখালেখির কারণে নানা জনের চক্ষুশূল হয়েছি। কত ঝাক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে আমাকে। এখন সেসব নিয়ে ভয় না পেলেও বর্তমান মব রাজত্বে পরিবারের অন্য সদস্যদের নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেক কিছুতেই মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকি।
কতকিছু চুপচাপ সহ্য করে যাই। কত কিছু লিখার জন্য হাত নিসফিস করে। লিখেও কত লেখা অপ্রকাশিত রেখে দিই। আর না লেখার বা না প্রকাশ করার যন্ত্রণা নিয়ে দিনরাত পার করি। আজ মনে হল মনু মিয়ার ঘোড়াকে নিয়ে লিখি। ঘোড়া নিয়েতো প্রতিবাদ করলে নিশ্চয়ই কেউ আর আমার উপর খেপবে না বা আমার ক্ষতি করতে সচেষ্ট হবে না। তাই নিরাপদ ভেবে মনু মিঞার ঘোড়া হত্যার প্রতিবাদ করে গেলাম। যে দেশে মানুষ হত্যা খুব সহজ একটি কাজ এবং তার প্রতিবাদ করা দুরূহ ব্যাপার। সেই দেশে ঘোড়া হত্যার প্রতিবাদ করাই বুদ্ধিমানের কাজ !!!
লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে, ইতি টানতে চাচ্ছি। বাংলাদেশ সরকারের অনেক রাষ্ট্রীয় সম্মানজনক পদক-সম্মাননা রয়েছে। দেশ, মানুষ এবং সমাজের জন্য ভূমিকা রাখায় বিভিন্ন জনকে নানা রকম পদক-সম্মাননা দেওয়া হয়। বেসরকারিভাবেও দেওয়া হয় অনেক পদক-সম্মাননা। এ সমস্ত পদক সম্মানগুলো যারা পায় তারা কোনো না কোনোভাবে সকলের কাছে পরিচিত, আলোচিত, আলোকিত মানুষ। শিক্ষিত এবং উঁচু মাপের মানুষ। কিন্তু সমাজের আনাচে-কানাচে মনু মিয়ার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে যে সমস্ত মানুষ, যারা অন্যদের মতো এতটা আলোচিত, আলোকিত, শিক্ষিত নয়। তাদেরকে খুঁজে খুঁজে পুরস্কার পদক-সম্মাননা দেওয়ার উচিত বলে আমি মনে করি। তার ঘোরা হত্যাকারীকে ধরিয়ে দিতে পারেন আর না পারেন, মনু মিয়া একটা পদক-সম্মাননাতো দেয়াই যায়। তারাইতো আমাদের আসল হিরো।
লেখা শেষ করছি একটি কথোপকথন দিয়ে
- আপনি মনু মিয়ার কে হন?
-আরে ফাগল আমিই তো মনু মিয়া!
-
কাকা মন খারাপ কইরেন না, সব আল্লাহর ইচ্ছা , আল্লাহ আপনাকে দ্রুত সুস্থ করে দিবেন। আপনাকে সুন্দর একটা ঘোড়া দিবো আমরা।
(কথোপকথনটি হাসপাতালে শয্যাশায়ী মনু মিয়া ও বাংলাদেশের জনপ্রিয় নাট্য অভিনেতা খাইরুল বাশার-এর।)
---
নাই বেডার নাই, আছে বেডারই যায়
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
১৯ মে ২৫
0 মন্তব্যসমূহ