অশ্লীল শব্দ চয়ন, আর অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে টিকটক, ইনস্টাগ্রাম বা রিলস-এর ফানি ভিডিও বানানো তথাকথিত সেলিব্রেটিদের আমরা খুব ভালোভাবেই চিনি। জানি তাদের নাম-পরিচয়ও। অনলাইন প্লাটফর্ম ছাড়াও দেশের জাতীয় প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও এই সমস্ত সেলিব্রেটিদের নিয়ে নানা সময় নেগেটিভ-পজিটিভ নিউজ হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থাকে পজিটিভ রিভিউ। তাদের সাক্ষাৎকারও ছাপা হয় বেশ সারম্ভে। নানা ঘটন-অঘটন ঘটানো এসব সেলিব্রেটিদের দিয়ে আবার ওটিটি প্লাটফর্মসহ মেইন স্ট্রিম মিডিয়াতেও তাদের নিয়ে নানা ধরনের শর্ট ফিল্ম, নাটক অথবা মিউজিক ভিডিও তৈরি করা হয়।
অর্থাৎ সোজা সাপটা একটা মেসেজ আমাদের নতুন প্রজন্মকে দেওয়া হয় যে- তোমরা যে যেভাবে পারো ভাইরাল হও, তারপরে লাইম লাইটে চলে আসো। জ্ঞানার্জন ও সৃজনশীলতা ও অধ্যবসায় ছাড়া শর্টকাটে লাইম লাইটে চলে আসা বা লাখ লাখ টাকা উপার্জনের স্বপ্নে বিভোর আমাদের দেশের লাখ লাখ তরুণ-তরুনী।
তথ্যহীন, মেধাহীন, সৃজনশীলতাহীন অশ্লীল ও অনৈতিক এসব কনটেন্ট এবং তাদের ক্রিয়েটররা যে বাংলাদেশ আমাদেরকে উপহার দিচ্ছে বা দিয়েছে তার ফলাফল তো আমরা প্রত্যেকদিনই দেখতে পাচ্ছি। যে-সব বাক্য শুনতে আমাদের লজ্জা লাগে, সেসব তারা কথা অনায়াসেই বলে যায় অনলাইন প্লাটফর্মে। আর তাদের পোশাক-আশাকও যথেষ্ট অশ্লীল এবং উচ্ছৃঙ্খল। আর এসবের মাধ্যমে একটি অস্থির, উচ্ছৃঙ্খল, বেয়াদব এবং মব কালচারে বিশ্বাসী জেনারেশন তৈরি করছে এই ধরনের কনটেন্ট এবং তাদের ক্রিয়েটরা এবং তা খুব ভালোভাবেই প্রমোট করছে আমাদের মতোই সুস্থ বিবেক সম্পন্ন কিছু মানুষ।
আজ হিরো আলম-রিয়ামনি, মামুন-লায়লা, জান্নাত-তোহা, অপু ভাই, রিপন ভিডিও, ধলা বিলাই, ছিদ্দিক চোরারা জায়গা করে নেয় আমাদের নিউজ ফিড, মনন এবং মগজে। কিন্তু আমরা জানি না সেই বীর পাইলটের নাম। গত কয়েকদিন পূর্বে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফেরার পথে মাঝ আকাশে চাকা খুলে যাওয়া ৭১ আরোহীসহ বিমানটিকে সফলভাবে ঢাকায় অবতরণ করালো যে পাইলট, আমি তার কথা বলছি। তার নাম আমরা কজনই-বা জানি। পত্র-পত্রিকা বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার কথা ছিল বিজি ৪৩৬ বিমানের সেই দক্ষ, সাহসী বীর পাইলটের।
যারা কিনা আমাদের আসল হিরো, প্রকৃত সেলিব্রেটি। আমাদের প্রমোট করার কথা কাদের, প্রশংসা করার কথা কাদের, আমাদের মাথায় তুলে রাখা কথা কাদের, আর আমরা করছি কাদের ?
বেশ কিছুদিন ধরে রিধি নামে এক মেয়ে নানা ভাবে অনলাইন প্লাটফর্মে নেতিবাচক কথা ও কর্মকাণ্ডের কারণে ভাইরাল হয়েছিল। দু-দিন যাবৎ দেখছি তাকে নিয়ে কারা যেন একটি নাটক বা মিউজিক ভিডিও বানাচ্ছে। এরকম দৃশ্য একদিকে আমাদের যেমন হতাশ করে, তেমনিভাবে আজকে তম রশিদ নামে একজন উপস্থাপক যে কিনা তাদের শো-এ বিভিন্ন উঠতি, ভাইরাল টিকটকার, কনটেন্ট ক্রিয়েটর বা তথাকথিত সেলিব্রিটিদের নিয়ে এসে অশ্লীল এবং উদ্ভট সব প্রশ্ন করে সমাজকে আজেবাজে বার্তা দিত। আজ তম রশিদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী আইনি নোটিশ প্রেরণ করেছেন।
এসময় সংবাদমাধ্যমে আইনজীবী বলেন, ‘জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালার ধারা ৩.৬.৩ অনুযায়ী, শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক, মানবিক ও নৈতিক গঠনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এমন অশ্লীল, তথ্যগত ভুল এবং ভাষাগতভাবে অশোভন ও সহিংসতামূলক অনুষ্ঠান প্রচারে কঠোর সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশনা রয়েছে। তমা রশিদ এই নিয়ম অমান্য করেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘নীতিমালার ৩.৬.৫ ধারাতেও স্পষ্ট বলা আছে, কোনো ধরনের অশোভন উক্তি বা আচরণ কিংবা অপরাধীদের কার্যকলাপ প্রদর্শনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যা নতুন অপরাধ প্রবণতা তৈরির ঝুঁকি তৈরি করে। কিন্তু উক্ত উপস্থাপিকা তার অনুষ্ঠানে ধারাবাহিকভাবে এমন শব্দচয়ন করে চলেছেন, যা অশ্লীলতা ও কুরুচিপূর্ণ আচরণের উৎসাহদাতা হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক সংস্কৃতি রক্ষার স্বার্থে এসব কর্মকাণ্ড বন্ধের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি একজন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তমা রশিদের এমন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আজকের এই নোটিশ প্রদান করছি। যাতে তিনি ভবিষ্যতে আর কোনোভাবেই অশ্লীল শব্দচয়নের মাধ্যমে অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে না পারেন। (সূত্র: সময় সংবাদ)
সংগত কারণেই আমি এই নোটিশের পক্ষে। আমি মনে করি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে দেশের সকল টিকটকার এবং কন্টেন ক্রিয়েটরদের সতর্কবার্তা দেওয়া উচিত যে অচিরেই তারা যেন আর কখনো অশ্লীল কনটেন্ট না বানায় এবং ইতিপূর্বে বানানো সকল কনটেন্টগুলো অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে ডিলিট করে ফেলে। এই বিষয়ে তাদেরকে যদি আমরা সতর্ক এবং বাধ্য না করতে পারি, তাহলে আপনার আমার ছেলে মেয়েও এই অশ্লীলতার জোয়ার থেকে বাঁচতে পারবে না। এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও সামাজিক সচেতনতা।
শেষ কথা একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনার হাত থেকে গত ১৬ মে নারী-শিশুসহ ৭১ জন যাত্রীকে প্রাণে বাঁচানো বিজি ৪৩৬ বিমানের পাইলটের নাম ক্যাপ্টেন জামিল বিল্লাহ। তাঁর অসাধারণ দক্ষতা, সাহসিকতা ও নেতৃত্ব দিয়ে প্রযুক্তিগত বিপর্যয়ের মাঝেও তিনি ঠান্ডা মাথায় বিমানটিকে নিরাপদে অবতরণ করান ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে, যেখানে ইমার্জেন্সি টিম প্রস্তুত অবস্থায় ছিল। তাঁর সাহসী সিদ্ধান্ত ও পেশাদারিত্বের ফলে, একটি প্রাণও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এটি ছিল এক জন দক্ষ পাইলটের বিচক্ষণতার ফল। একই বিমানের ফার্স্ট অফিসার ছিলেন জায়েদ, জুনিয়র ফ্লাইট পার্সার জামাল উদ্দিন আরিয়ান, ফ্লাইট স্টুয়ার্ড খাদিজা সুলতানা শিমু। তারাও জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিজ নিজ অবস্থানটিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
আসুন আমাদের এই জাতীয় সেলিব্রিটিদের স্যালুট জানাই।
আকাশের হিরো, আমাদের হিরো ক্যাপ্টেন জামিল
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
১৮ মে ২০২৫
ছবি: ফাঁপরবাজ আইডি থেকে নেওয়া।
0 মন্তব্যসমূহ