Ticker

6/recent/ticker-posts

বই হোক আমাদের নিত্য সঙ্গী।


পৃথিবীর আঁধার দূর করে যে আলোকপিণ্ড- তার নাম সূর্য। মানুষের মনের আঁধার দূর করে যে আলোকপিণ্ড- তার নাম বই। শুধু কি তাই ? পৃথিবীতে এমন কোনো ভালো, এমন কোনো আলো নেই- যা বই থেকে আসেনি।


বই মস্তিষ্কের সন্তান। মাতৃগর্ভে যার জন্ম হয় তার মৃত্যু আছে, তবে একটি বইয়ের মৃত্যু নেই। লেখকের মস্তিষ্কের গর্ভে উৎসারিত নানা চিন্তা-ভাবনা, তার দেখা, উপলব্ধি করা ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে পাণ্ডুলিপি নামক ভ্রূণের জন্ম হয়। লেখক-এর নানা যত্ন তথা ঘষামাজা শেষে পাণ্ডুলিপি নামক সেই ভ্রূণ ধীরে ধীরে বই হওয়ার দিকে এগিয়ে যায়। তারপর একজন প্রকাশকের হাত ধরে জন্ম হয় একটি বইয়ের। প্রকাশক বা প্রকাশনীর ভূমিকা এখানে একজন ডাক্তার বা নার্সের।


বই নিয়ে আমাদের অনেকের মধ্যে এরকম একটি ভ্রান্ত ধারণা আছে যে, আমি তো বই পড়ি না, তাহলে কিনবো কেনো ? অর্থাৎ যেহেতু আপনি বই পড়েন না, তাই বই কিনে অযথা টাকা নষ্ট করতে চান না। কিন্তু আপনি জানেন কি ? এটি আপনার একটি ভুল ধারণা। আসলে আপনি বই কেনেনা না বলেই বই পড়েন না।


ধরুন- আপনার অফিস টেবিলে, বাসার সেলফে, বিছানার কাছে কয়েকটি বই আছে। আপনি যতই বই না পড়ার মানুষ হন। আপনার আশেপাশে বই থাকলে একটা সময় আপনি ঠিক বইগুলোর পাতা উলটাবেন এবং সেখান থেকে কিছু কিছু অংশ পড়বেন। এই পড়তে পড়তেই একদিন আপনার মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হবে। আসলে আমাদের হাতের কাছে বই থাকে না বলেই আমরা বই পড়ি না, পড়ার সুযোগ পাই না এবং এ জন্যই আমাদের বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হয় না।


বই কিনলেই বই পড়তে হবে এটিও আমাদের ভুল ধারণা। আপনি বই পড়েন না, অথবা আপনি পড়া লেখাই জানেন না তো কি হয়েছে ? কিছু বই কিনে আপনার অফিস টেবিলে, সেলফে, বাসার টেবিলে, বিছানার পাশে রেখে দিবেন। এতে করে আপনার মধ্যে যদি এই পড়ার অভ্যাস তৈরি নাও হয়, এই বইগুলো দেখে আপনার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হতে পারে। তাছাড়া আপনার বাসায় বা অফিসে কোনো মেহমান আসলে তাদের মধ্যে কেউ থাকতে পারে যারা বই পড়তে ভালোবাসেন। তাদের জন্য হলেও কিছু বই আপনার সংগ্রহে থাকা দরকার।


বই সংগ্রহ করা আপনার মনের সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। না পড়লেও আপনার পড়ার টেবিলে, আপনার সংগ্রহের কিছু বই আছে- এটা আপনার ব্যক্তিত্ব এবং আভিজাত্যকে বাড়িয়ে তোলে। আগন্তুকের কাছে আপনার সম্পর্কে একটি পজিটিভ ধারণা তৈরি হয়। কাজেই বই না পড়লেও বই কেনা উচিত। আপনার হাতের পাশে বই রাখা উচিত।


বই পড়া বিষয়ে বিখ্যাত প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী তার বই পড়া প্রবন্ধে বলেছেন, ‘বই কিনলেই যে পড়তে হবে, এটি হচ্ছে পাঠকের ভুল। বই লেখা জিনিসটা একটা শখমাত্র হওয়া উচিত নয়, কিন্তু বই কেনাটা শখ ছাড়া আর কিছু হওয়া উচিত নয়।’ বিখ্যাত মার্কিন সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেন ‘বইয়ের মত এত বিশ্বস্ত বন্ধু আর নেই।”


বর্তমানে ইন্টারনেট, স্মার্টফোন ও প্রযুক্তির যুগে সব মানুষ, বিশেষত নতুন প্রজন্ম বই পড়া থেকে অনেকটাই দূরে সরে যাচ্ছে। ফলে আগামী প্রজন্ম বেড়ে উঠছে জ্ঞানহীনভাবে। এই অবস্থাটা থেকে ফেরাতে পারে কেবল বই। আমরা আমাদের ছেলে মেয়েদেরকে নিয়ে অভিযোগ করি যে তারা বই পড়ে না, সারাক্ষণ খেলাধুলা, বিশেষ করে মোবাইল এবং টিভি নিয়ে বসে থাকে। আপনাকে যদি প্রশ্ন করি যে, আপনি আপনার ছেলে মেয়েকে কয় দিন, কয়টি বই কিনে দিয়েছেন। উত্তরে দেখা যাবে আপনি না বলছেন। অর্থাৎ আপনি ছেলেমেয়েদেরকে বিকল্প হিসেবে আরেকটি কিছু তাদের হাতে না দিয়ে তাদের উপরে দোষারোপ করছেন। এটি কি ঠিক ? 


পরিবারের জন্য দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে, ব্যবসা-বাণিজ্য চাকরিবাকরি করে আপনি টাকা পয়সা উপার্জন করছেন। মাসে মাসে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করছেন পরিবারকে একটু ভালো রাখার জন্য। অথচ প্রতিমাসের ক্রয় তালিকায় বই কেনার জন্য আপনার এক হাজার টাকা বাজেট নেই। পরিবারের সদস্যদের মানসিক প্রশান্তি, জ্ঞান, মেধা, চিন্তা ও চেতনার বিকাশের জন্য আপনার বাসায় কোনো বই নেই। সেই আপনি সমাজ, রাষ্ট্রকে দোষারোপ করছেন- আপনার সন্তান মানুষ হচ্ছে না। আপনার অভিযোগ কি তাহলে মেনে নেয়া যায় ? একটি বইহীন পরিবারে আপনার সন্তানেরা মানুষের মতো মানুষ হবে কীভাবে ?


আইরিশ কবি ও উপনাসিক অস্কার ওয়াইলড বলেন- একজন মানুষ ভবিষ্যতে কী হবেন, সেটি অন্য কিছু দিয়ে বোঝা না গেলেও তার পড়া বইয়ের ধরন দেখে, তা অনেকাংশেই বোঝা যায়। আপনি আপনার ছেলে-মেয়েদের বই পড়তে দিচ্ছেন না, তাহলে আপনি কীভাবে বুজবেন যে তারা ভবিষ্যতে কী হতে চয়। মনে রাখবেন যে বাসায় কিছু বই আছে, তা ওই পরিবারে এক ধরনের আলাদা জ্যোতি ছড়ায়। এই পরিবার সমাজের আট দশটি পরিবার থেকে আলাদা হয়।


প্রশ্ন করতে পারেন এত হাজার হাজার বই। আপনি কোন বই কিনবেন। উত্তর হচ্ছে সম্ভব হলে আপনি বই বাছাই করে কিনবেন। নিজের আগ্রহ, পরিবারের সদস্যদের আগ্রহ অথবা আগন্তক পাঠকদের আগ্রহ কথা ভেবে বই  নির্বাচন করুন। আর যদি বই বাছাই করা সম্ভব না হয় তাহলে চোখের সামনে যে বই পাবেন, যে লেখকের বই পাবেন সে বই কিনুন। কেননা পৃথিবীতে বই এর মত সুন্দর, পবিত্র ও প্রয়োজনীয় আর কিছু নেই।


কানাডিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান লেখক ভিনসেন্ট স্টারেট বলেন “আমরা যখন বই সংগ্রহ করি, তখন আমরা আনন্দকেই সংগ্রহ করি।”- তাই আসুন বই পড়ি আর না পড়ি, আমরা সবাই বই কিনি। প্রতিমাসে আমাদের প্রত্যেকের কেনাকাটার তালিকায় একটি করে বই থাকুক। আমাদের প্রত্যেকের ঘরে ছোট একটি লাইব্রেরি গড়ে উঠুক। শেষ করছি বই নিয়ে  সৈয়দ মুজতবা আলী বিখ্যাত উক্তি দিয়ে তিনি বলেছেন- 'বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না”। তাই আসুন বই কিনি, বই পড়ি, বই হোক আমাদের নিত্য সঙ্গী।


মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

১৯ মার্চ ২৪



নোট: শুরু হয়েছে অমর একুশে বইমেলা ২০২৫। আপনার গ্রাম, শহরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নবীন-প্রবীণ লেখকের অসংখ্য বই প্রকাশ হবে। একটি আলোকিত পরিবার সমাজ ও ব্যক্তি জীবন গঠনে আপনার উচিত হবে কিছু বই সংগ্রহ করা। তাই পরিবার নিয়ে ঘুরে আসুন অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ