পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া জমিতে বিভিন্ন শাকসবজি ফলান আব্দুল আলি। তার বসতভিটের পাশে, উঠোনের কোনায় কোথাও পেঁপে, কোথাও পেয়ারা, কোথাও লেবু, ডালিম, আম, জামের গাছ লাগানো। কোনোটি গাছ তার বাবা লাগিয়েছে, কোনটা তার মা। সে ও তার বৌও লাগিয়েছে কয়েকটি গাছ।
সবচেয়ে পুরোনো আমগাছটা লাগিয়েছিল তার দাদা। ফলে নানা মৌসুমে নানা জাতের ফল খেতে পারে আব্দুল আলি ও তার পরিবার। কিন্তু সব কিছু কী আর নিজেরা খেয়ে শেষ করা যায় ! তাই খাওয়ার উপযুক্ত হলেই গাছ থেকে ফল পেরে, জমি থেকে সবজি তুলে কিছু নিজেরা খায় আর বাকিগুলো ঝুড়িতে তুলে শহরের দিকে রওনা দেয় আব্দুল আলী।
তার বাড়ি থেকে জেলা শহর খুব দূরে নয়। ২০ টাকা অটো ভাড়া দিয়েই শহরে আসে আব্দুল আলী। ঝুড়ি নামিয়ে রাস্তার পাশে কোথাও খালি জায়গা দেখে বসে যায়। যেখানে মানুষের চলাচল বেশি এমন কোনো জায়গায় বসে সে । রোজ ভালোই বিক্রি হয়। বেচা বিক্রি শেষে যেই ঝুঁড়ি দিয়ে শাক-সবজি, ফুল-মূল নিয়ে এসেছিল সেই ঝুঁড়ি ভরে বাড়ির জন্য নানা সওদাপাতি কিনে নিয়ে যায়। ছেলে-মেয়ের জন্য এটা সেটা নিতেও ভুল করে না সে।
সেই দিনের ঘটনা ১৬/১৭ বয়সী দুজন ছেলে দ্রুতগতিতে মোটর চালিয়ে সে পথেই যাচ্ছিল। বিপরীতমুখী আরেকটা গাড়ি ছুটে আসায় হঠাৎ তারা সংঘর্ষ এড়াতে তাল সামলাতে না পেরে আব্দুল আলির ফলের ঝুড়িতে মোটরসাইকেলটা লাগিয়ে দেয়। তারা নিজেরাও চলছিল অত্যন্ত বেখেয়াল ভাবে। নিমিষেই রাস্তায় গড়াগড়ি খায় ঝুড়িতে থাকা ফল ও সবজি । মোটরসাইকেলটি পড়তে পড়তে একটু সামনে ব্রেককষে দাঁড়িয়ে যায়।
পায়ে সু-জুতো, গায়ে জিন্স প্যান্ট। তার উপরে টি-শার্ট, টি-শার্টের বুকের কাটা জায়গায় একটি সানগ্লাস লাগানো। হাতে ব্রেসলেট, কানে হেডফোন। দুজনের প্রায় সেম পোশাক। চেহারার জিওগ্রাফি দেখে বোঝা যায় বাবা-মার বখাটে ছেলে।
ছেলে দুটি মোটরসাইকেল থেকে নিমে গিয়ে আব্দুল আলী গালের কষে একটা চড় মারে। আর ধমকের সুরে বলে- এই ব্যাটা রাস্তা কি তোর বাপের জায়গায়। এখানে হকারি করতে বসেছিস কেনো ? রাস্তায় হকারি করলে আমরা মোটরসাইকেল চালাবো কই। বলেই- ছেলে দুটো মটর সাইকেল নিয়ে চলে গেলো ।
হঠাৎ ঘটে যাওয়া দুটো ঘটনায় হতবিহ্বল আব্দুল আলি। একে তো নিজের মালামাল রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে, তার ওপর পুত্র বয়সী ছেলের হাতে চর খেয়ে নিমেষেই আব্দুল আলী চোখের জল গড়িয়ে পড়লো রাস্তায়।
ইতিমধ্যে লোকজনের জটলা পেকে গেছে। ততক্ষণে ছেলে দুটো হাওয়া। ভিড়ের মধ্যে কয়েকজন এগিয়ে আসলো আব্দুল আলির মালামালগুলো ঝুড়িতে তুলে দিতে। বাকিরা ছেলে দুটোকে ইচ্ছামতো বকাঝকা করছে। ফুটপাতে বসার জন্য আব্দুল আলিকেও দোষারোপ করছে কেউ। কেউবা মোটরসাইকেল আরোহী ছেলেগুলোকে বকছে।
একজন বলল- এসব গাঁজাখোর পোলাপান, গরীব মানুষের কষ্ট বুঝবে না। আরেকজন বলল- মোটরসাইকেলে চললে এদের আর হুঁশ থাকে না। হয় গাঞ্জা খেয়ে আসছে না হয় খাইতে যাইতেছে।
নানা কথার ফাঁকে একজন ক্ষোভের সংঙ্গে বলল- এই মুহূর্তে ছেলে দুটোর বাপকে কাছে পেলে ওদের বাপের গালে দুটো চড় দিয়ে বলতাম- আপনার ছেলে কি এমন জরুরি কাজ করে যে, এই বয়সে তাকে মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছেন ?
—---------
মোটরসাইকেল আরোহী ও সবজি বিক্রেতা
চলতি পথের গল্প: ০২
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
১৩ নভেম্বর ২৩
0 মন্তব্যসমূহ