Ticker

6/recent/ticker-posts

চুলের বারো মিশালী


বয়স দৌড়াচ্ছে চল্লিশের ঘরে। এর মধ্যে শরীর আর মনে নানা ধরনের পরিবর্তন লক্ষণীয়। ইদানীং মাথায় বেশ কিছু চুল সাদা হয়ে যাচ্ছে। চুল সাদা হওয়ার এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে আরো প্রায় আট বছর আগে। মনে পড়ে- সেদিন বিয়ের জন্য মৌলভীপাড়ার এক সেলুনের চুল কাটতে গিয়ে কাচি কর্মী জানালো- ভাই আপনার মাথার চুলতো পেকে যাচ্ছে। আটকে উঠে বললাম- তাই নাকি ! আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না। সে কয়েকটি সাদা চুল তুলে আমার হাতে দিল। দেখলাম- সত্যিইতো সাদা চুল দেখা যাচ্ছে। তাকে রসিকতা করে বললাম- বিয়ের পরে বউ এসে নানা ধরনের টেনশন দেবে, তারপরে না হয় চুল পাকবে, তার আগেই পাকা ধরল কেন ! চুল কি তাহলে টের পাচ্ছে, টেনশন দেওয়ার জন্য জীবনে কেউ আসছে ? মনে মনে বললাম- পাকবেই না কেনো ? এই ক্ষুদ্র জীবনে টিকে থাকার সংগ্রামতো নিতান্তই কম নয়। সব চাপতো মাথার ঘিলুর উপরইতো গেলো। তো ঘিলুর গরমে চুল পাকা স্বাভাবিকই বটে। 


সে যাই হোক, তারপর থেকে মাঝে মাঝে মাথার এখানে ওখানে সাদা চুল উঁকি দেয়। আয়নায় মুখ দেখতে গিয়ে বা চুল আঁচড়াতে গিয়ে যখন যেটাকে সামনে পাই টেনে টেনে উপরে ফেলি। ফেলবই না কেন, তখন বয়স মাত্র ৩১। চেহারাতেও নেই বয়সের ছাপ, এই বয়সে পাকা চুল মেনে নেয়া যায় না। তার ওপর একগাদা কালো চুলের মাঝখানে দুই একটি সাদা চুলের নির্লজ্জ হাসি মোটেই সহ্য হয় না। ফলে সুভ্র মণ্ডিত চুল উৎখাতে আমার সংগ্রাম চলতেই থাকে। মাথার সামনের অংশের চুল নিজে নিজে উৎখাত করতে পারলেও মধ্যখানে এবং পেছনের অংশের চুলের জন্য গিন্নির শরণাপন্ন হতে হয়। সে-ই মাঝে মাঝে পাকা চুল তুলতে সহায়তা করে। 


চুল উঠানোর কাজে তাকে রাজী করাতে একটি চাতুরীতার আশ্রয় নিয়েছিলাম। তাকে প্রায় বলতাম আমার মাথায় সাদা চুল থাকলে তোমাকে মানুষ বুড়ো ব্যাটার জামাই বলবে। কাজেই নিজের সম্মান রক্ষার্থে আমার মাথার সাদা চুল তোলা নিজের স্বার্থ, ব্যক্তিগত দায়িত্ব। এভাবেই চলছিল বিগত আট বছর। সম্প্রতি আমার দ্বিতীয় কন্যার জন্মের পর গিন্নির ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় আমার মাথার সাদা চুল খোঁজার সময় পাবে দূরের কথা, মনেই করতে পারেন না যে এক সময় এটা তার নিয়মিত কাজ ছিল।  তাই বাধ্য হয়ে আমি নিজেই সাদা চুল উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে রেখেছি। প্রতিদিন যতবার আয়নার সামনে যাচ্ছি খুঁজে খুঁজে এক একটাকে ধরে ধরে টেনে টেনে মাথা থেকে ছাঁটাই করছি। 


এই চুল যুদ্ধ করতে গিয়ে আমার মধ্যে এক অদ্ভুত মনোভাব লক্ষ্য করলাম। মাথার কোনো অংশে; যে অংশে দৃষ্টি যায় সেখানে একটি মাত্র সাদা চুলের উপস্থিতি আমি মানসিকভাবে সহ্য করতে পারছি না। আমার নানা কাজের ব্যস্ততার মধ্যেই সাদা চুল উচ্ছেদ অভিযানে বেশ কিছু সময় ব্যয় করছি। যতক্ষণ পর্যন্ত দৃশ্যমান সাদা চুলকে তার অবস্থান থেকে সরাতে না পারছি ততক্ষণ পর্যন্ত মনের ভিতর একটা উস্ খুস ভাব থেকে যায়। ভাবলাম আমরা বাঙালি- চোখের সামনে ভিন্ন মতালম্বী জলজ্যান্ত মানুষকে সহ্য করতে পারি না, আর মাথায় মানে এক্কেবারে হেড কোয়াটারের উপর কয়েকটা ভিন্ন রংঙের চুল বসে থাকবে তা কি হয়, মোটেই না। ফলে চুলের ভিতর চুল উৎখাতে চিরুনি অভিযান চালুই রাখছি।


দেহ ঘড়ির বয়সের কাটা দৌড়াচ্ছে চল্লিশের ঘরে। এই বয়সে কিছু চুল সাদা হতেই পারে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মন তা মানছে না। তাইতো অমাবস্যার রাতের মতো মাথার আঁধারে মিটিমিটি তারার ন্যায় জ্বলে থাকা একটি সাদা চুলের দেখা পেলেই আমার দুষ্ট হাত তেড়ে যায় তাদের দিকে। ক্ষুধার্ত হায়েনার মতো হামলে পড়ে কালো চুলের জঙ্গলে। এভাবে গত চার মাসে মাথার সামনের অংশের সাদা চুলগুলো ছাঁটাই করতে পারলেও কিন্তু মাথার পিছনের অংশে যে আড়ালে-আপডালে তাহারা রোহিঙ্গাদের মতো ক্রমেই জন্মহার বাড়িয়েই চলছে, এতদিন সেই বিষয়ে আমি একরকম বে-খবরই ছিলাম। 


গত সপ্তাহে ঘুরতে গিয়ে একজন আমার পেছন থেকে ভিডিও করে। সেই ভিডিওতে নিজের মাথার পেছনের অংশের চুল দেখে আমি রীতিমতো আঁতকে উঠি। দেখলাম- পিছনের অংশে অনেকগুলো চুল সাদা হয়ে উঠেছে। মনে মনে বলি- বাছা চুল, তলে তলে এতদূর ! ঐদিন রাতেই গিন্নি বললাম না আর ছাড় দেওয়া যায় না, এই সাদা চুলের দল যেভাবে জোট পাকাচ্ছে তাতে যদি সময়মতো তাদের উৎখাত না করি তাহলে মনে শান্তি পাবো না। অল্প কিছুদিনের ভিতরে মাথায় সাদা চুলের বিরাট গোষ্ঠী দাঁড়িয়ে যাবে। তখন সব চুল তুলে ফেলা সম্ভব হবে না। 


অবশেষে রাতের বেলা বাচ্চার মা টানাটানি করে অনেকগুলো সাদ সাদা চুল তুলে ফেলল। আমি সেগুলোকে দলা পাকিয়ে আমার কম্পিউটার টেবিলে রাখলাম। তাদের সামনে রেখে আমার ওয়ার্ক চলতে থাকলো। এক গুচ্ছ নিরীহ, নিরস্ত্র, সরলমনা চুলের গোষ্ঠীকে উৎখাত করতে পেরে মনের মাঝে পৈশাচিক এক আনন্দ অনুভব করলাম। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার জঙ্গলে প্রাকৃতিক বিধান হলেও মনুষ্য সমাজে জঙ্গল থেকে এ বিধান আমরাই আমদানি করেছি। যাকে বলে পশুবৃত্তি।


এসব ভাবেতে ভাবতে পরক্ষণেই আবার শঙ্কাও অনুভব করলাম- সাদা চুলের পরিমাণ যেভাবে বেড়ে চলছে, তাতে সব চুল উঠে মাথা না আবার বেলে  হয়ে যায়। ভাবছি- কয়েক বছরের মধ্যেই হয়তো আমাকে চুলে কলপ লাগাতে হবে। বেঁচে থাকলে তা না হয় ধরলাম। কিন্তু আমার মাথার মতো দেশের ভিন্ন স্থানে যে একের পর এক সাদা চুলের উৎপাত শুরু হয়েছে, তাদের সমূলে উৎখাত করবে কে ? দেশের সাধারণ মানুষের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্টকারী অনাকাঙ্ক্ষিত এসব সাদা চুলের গোষ্ঠীকে কলপ লাগানোর লোকই বা পাবো কোথায়। কোথায় পাবো সেই মানুষ- যে হাতে ধরবে ধবধবে সাদা চুল কুচ কুচে কালো করার দেশপ্রেমিক ব্রাশ।


চুলের বারো মিশালী

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

২৭ নভেম্বর ২৪


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ