বৃক্ষ পুরাণ- কবি ও কবিতার যাত্রা
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে কোনো এক সন্ধ্যায় কবি আমির হোসেন স্যার বৃক্ষ নিয়ে ফেসবুকে একটি কবিতা পোস্ট করলেন। কবিতাটি আমার অনেক ভালো লাগলো, যা আমি তৎক্ষণাৎ মন্তব্যের ঘরে প্রকাশ করলাম। আমার মতো আরো অনেকেই সেই কবিতার প্রশংসা করলেন। কবিতাটির শেষ দুটি লাইন ছিল সত্যিই অসাধারণ। এর পরের মাসে চেতনায় স্বদেশ গণগ্রন্থাগারের একটি অনুষ্ঠানে (বরণ্যে কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ-এর প্রধান সহকারী পরিচালক জুয়েল রানা ভাইয়ের আগমন উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠান) এতে বাচিক শিল্পী মনির হোসেন ভাই নিজের বক্তব্যে সেই কবিতার কথা উল্লেখ করলেন। তিনি আমির হোসেন স্যারের লেখালেখি, ঘোরাঘুরি এবং প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার কথা উল্লেখ করে তাকে ‘বৃক্ষ পূরণের’ কবি হিসেবে সম্বোধন করলেন।
একদিন জানতে পারলাম ২০২৩ সালে স্যারের ৫০তম জন্মদিন হবে। এই দিনটি বিশেষভাবে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কিছু একটি করতে চাই- এমন মনোভাব স্যারকে বললেন তিনি বললেন- কি করা যায় ? নানা বিষয় চিন্তা ভাবনার পর বললাম- আপনাকে নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা করা যায়। প্রথমে তিনি রাজি হলেন না। বললেন- এই বয়সে এখন এরকম কিছু করলে বিষয়টি সবাই ভালোভাবে দেখবে না। বললাম- এখন যদি না করেন, কখন করবেন। ১০০ বছর বয়স হলে ? ততদিন যদি আমি বেঁচে থাকি তা না হয় করা যাবে, কিন্তু সেই গ্যারান্টি কি দিতে পারবেন। না, এই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না।
উল্লেখ্য এর আগে আমাদের সম্মিলিত একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিলো ‘চেতনায় স্বদেশ গণগ্রন্থাগারের’ পক্ষ থেকে জেলার বিভিন্ন লেখকদের জন্মদিন পালনের। আমির হোসেন স্যারের ৫০তম জন্মদিন একটু ভিন্ন ভাবে পালনের আইডিয়া সেখানে থেকেই আছে। পরিশেষে সিদ্ধান্ত হলো স্যারের ৫০তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে বিশেষ একটি সাময়িকী প্রকাশ করা হবে। এবং তা ‘চেতনায় স্বদেশ গণগ্রন্থাগার’ থেকেই হবে। সম্পাদনা প্রদান করা করা হলো আমাদের দু-বন্ধুর (?) উপর। কাজ করার জন্য আমাদের হাতে এক বছরেরও বেশি সময় ছিল। সংখ্যাটিতে কি ধরনের লেখা থাকবে, কাদের লেখা থাকবে, কোন কোন বিষয়ে কীভাবে সন্নিবেশিত করা হবে- এসবের একটি প্রাথমিক পরিকল্পনা করে ২০২২ সালের প্রথমদিকে আমার ব্লগসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সংখ্যার ঘোষণা দিয়ে দিলাম। ঘোষণার আগেই আমির হোসেন স্যার সম্পর্কে প্রাথমিক একটি ধারণা দিতে একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী দাঁড় করালাম। সেই সময় একটি প্রাথমিক প্রচ্ছদ দাঁড় করালাম গ্রাফিক্স ডিজাইনার হাসানকে দিয়ে। প্রচ্ছদের উপর লিখে দিলাম সেই ‘বৃক্ষ পুরাণ’ কবিতার শেষ দুই লাইন।
‘বৃক্ষের কাছে আমি ধর্মনিরপেক্ষতা শিখি
বৃক্ষ পুরাণ পাঠেই আমি মানুষ হয়ে বাঁচি।’
অবশেষে দীর্ঘ প্রায় আট মাসের প্রচেষ্টা এবং নানা জটিলতা অতিক্রম শেষ পর্যন্ত সংখ্যাটি প্রকাশ হলো। ২৩ ফর্মার এই সংখ্যায় দেশবিদেশের ১১৫ জন লেখকের লেখা স্থান পেয়েছে। ক্ষুদ্র জীবনে অনেক ছোট বড় বড় মানুষের সাথে ছোট-বড় অনেক কাজ করার সুযোগ ও সৌভাগ্য পেয়েছি। এই সংখ্যাটি করা আমার জন্য একটি বিরাট সুযোগ এবং সম্ভাবনা ছিল। এটি কাজ করতে গিয়ে অন্যরকম আমাকে খুঁজে পেয়েছি। নানা ধরনের লেখা ও লেখকের সংস্পর্শ পেয়েছি। সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজ করার নতুন নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চার করতে পেরেছি। যা সাময়িকীটির পাতার পর পাতা উল্টালেই একজন পাঠক বুজতে পারবেন।
আলোচিত এই সাময়িকীতে লেখালেখি শুরু হয়েছে ‘বৃক্ষ পুরাণ’ কবিতা দিয়ে। এ সময় পরিচিত একজন একদিন এক জায়গায় ঘুরতে গিয়ে একটি অজানা গাছের ছবি তুলে নিয়ে আসে। ছবিটি ভালো লাগায় ‘বৃক্ষ পুরাণ’ কবিতার সাথে আমি এই ছবিটি সংযুক্ত করি। এবং তার এই ছবি সংযোজন এর পিছনেও একটি রহস্য ছিল। তা আর সেই ব্যক্তি ছাড়া আর অন্য কেউ জানে না। সে যাই হোক। সংখ্যাটি প্রকাশের পর নিয়ে ২০২৩ সালের ২৮ জানুয়ারি জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে সংখ্যাটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তারপর সংখ্যাটি একে একে পৌঁছে দেওয়া হল দেশের নানা স্থানের লেখকদের মাঝে। একটি সম্পাদনা করতে গিয়ে স্যার সম্পর্কে আমার জানাশোনা আর একটু বৃদ্ধি পেলে সেসব বিষয় নিয়েই রচনা করি আরেকটি প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধটি আবার প্রকাশিত হয়েছে আলোচিত সাহিত্য সাময়িকী ‘নব ভাবনা’র প্রিয় লেখক সংখ্যায়।
এ বছর মাস দেয়েক আগে আমির হোসেন স্যার দুটি বই আমার হাতে তুলে দেন, একটি ‘রাত জাগা পাখি ও কুরচি ফুলের সুবাস’ অন্যটি ‘বৃক্ষ পুরাণের কবিতা’। সেই ‘বৃক্ষ পূরণের কবিতা’ও এই বইয়ের সন্নিবেশিতই করা হয়েছে এবং বইয়ের নামও রাখা হয়েছে কবিতার নামে। এই বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছে তরুণ শিল্পী রূপম ধর। সেখানেও একটি গাছের ছবি। যা বৃক্ষ পুরাণের কবিতার প্রতিনিধিত্ব করছে। রূপম ধর কথাসাহিত্যিক আমির হোসেন স্যারের সংখ্যাসহ আমার বেশ কয়েকটি প্রকাশনায় প্রচ্ছদ ও ছবি শিল্পী হিসেবে বেশ কাজ করেছে এবং এর ধারাবাহিকতা ও অব্যাহত রয়েছে।
সম্প্রতি তিনি আমাদের চারপাশের নানা পশু পাখি জীবজন্তুকে উপলক্ষ্য করে রচনা করছেন বিভিন্ন উপদেশমূলক অনুগল্প। রূপকথা, লোককথা বা পৌরাণিক কাহিনীর আদলে লেখা গল্পগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ হওয়ার পর থেকে বেশ ছাড়া পেয়েছে। আমরা অনেকেই জানি বাংলা সাহিত্যে এ ধরনের গল্পগুলো নতুন না হলেও বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের গল্প খুব বেশি একটি লেখা হয় না। আমির হোসেন স্যারের এই গল্পগুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। ইশপের গল্পের পর বাংলা সাহিত্যে এই গল্পগুলিও জায়গায় করে নেবে বলে আমি আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
নতুন প্রকাশিত দুটি বইয়ে ১১৬টি কবিতা সংযোজিত হয়েছে। কাব্যগ্রন্থ দুটিতে স্থান পাওয়া অনেকগুলো কবিতার সাথে আমি পূর্ব পরিচিত। এর কিছু কবিতা ফেসবুকে তিনি পোস্ট করেছিলেন, কিছু তিনি পাঠ করে শুনিয়েছিলেন। বরাবরের মতোই প্রকৃতির বর্ণনা নির্ভর, কল্পনা প্রবণ, উপমা সমৃদ্ধ, গ্রামীণ ও শহরে জীবনের নানা প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে বই দুটির বিভিন্ন কবিতায়। মানুষ ও প্রকৃতিকে তিনি দেখেছেন অত্যন্ত নিবিড়ভাবে। জীবনের ঘাঁত-প্রতিঘাতে, পাওয়া না পাওয়ার মাঝখানে মানুষের বেঁচে থাকার যে সংগ্রাম- তাই তিনি তুলতে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন এই কাব্যগ্রন্থ দুটিতে। যা কবিতা পিয়াসু পাঠকদের তৃষ্ণা নিবারণে ভূমিকা রাখবে- বলে আমি মনে করি। গ্রন্থ দুটির প্রকাশ করেছে জ্ঞানজ্যোতি প্রকাশনী, ঢাকা। চার ফর্মার বই দুটির প্রতিটির মূল্য রাখা হয়েছে দুইশত টাকা মাত্র। বই দুটি পাওয়া যাবে এছাড়া আসছে অমর একুশে বইমেলাসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ঢাকার খ্যাতিমান লাইব্রেরি সমূহে।
পুনচ: আমার লেখালেখিতে যে কয়েকজন মানুষের বিশেষ অবদান রয়েছে। যাদের সংস্পর্শ আমার লেখালেখিতে প্রভাব সঞ্চারিত হয়েছে আমির হোসেন স্যার তাঁদের একজন। স্বভাবগত কারণেই স্যারের প্রতি আমার আলাদা সম্মান শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রয়েছে। তাই ভাবছি আমির হোসেন আরেকটি সম্পাদনা গ্রন্থপ্রকাশ করার। এটি পূর্বে প্রকাশিত সাময়িকী থেকে বাছাইকৃত বিশেষ কিছু লেখা এবং অন্যান্য আরো কিছু গ্রন্থ থেকে এবং নতুন লেখকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হবে এই গ্রন্থ। এটি প্রকাশ করতে আমাদের এক থেকে দেড় বছর সময় লাগবে বলে ধারণা করছি। বিস্তারিত আগামী কোনো পোস্টে জানাতে পারবো। আপনাদের সবার সহযোগিতা কামনা করছি। সব মিলিয়ে বলতে চাই ‘বৃক্ষ পুরাণের’ কবি ও কবিতার যাত্রা অব্যাহত আছে, থাকবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
শুভেচ্ছাসহ
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
লেখক-সম্পাদক-সংগঠক
১২ নভেম্বর ২৪
0 মন্তব্যসমূহ