‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সংগীত হিসেবে এই গানটি শোনার সময় অথবা গাওয়ার সময় আপনার মনে যদি উঁকি দেয় যে, ‘এই গানটি আপনার নিজ ধর্মের কোনো লেখকের লেখা না, তাহলে আপনাকে অবশ্যই এই গানটি না গাইতে বা না শুনতে অনুরোধ করব।
একইভাবে এই গানটি শোনার সময় যদি আপনার মনে হয়- এই গানটির লেখক আপনার দেশের না, ভিন্ন কোনো দেশের, তাহলেও আপনার এই গানটি গাওয়া বা শোনা উচিত নয়। যে দেশটার প্রতিদিন সকাল দেখেন, দুপুর দেখেন, সন্ধ্যা-রাত দেখেন। যে দেশের ছয়টি ঋতু দেখেন, এই গানটি গাওয়ার সময় যদি সেই দেশের সবুজ-শ্যামল চিত্র আপনার চোখের সামনে ভেসে না উঠে, তাহলে আপনার এই গানটি থেকে দূরেই থাকা বাঞ্ছনীয়।
যদি মনে হয় এই গানটি গাওয়ার সময় বা শোনার সময় আপনার ভিতরে দেশপ্রেম জাগে না, আপনার ঘুম ঘুম আসে, যদি মনে হয় যে- এর সুরটি নকল করা, অন্য কারো কাছ থেকে চুরি নেয়া। যদি আপনার মনে উঁকি দেয়- এই গানটি মহান মুক্তিযুদ্ধ অথবা ৫২,৭১-কে, ৯০,২৪-কে প্রতিনিধিত্ব করে না, তাহলে আপনাকে অবশ্যই ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ এই গানটি থেকে দূরে থাকা উচিত।
এই গানটিকে ‘জাতীয় সংগীত হিসেবে মেনে নিতে যদি আপনার মনে প্রশ্ন আসে- এটি একটি শিরকযুক্ত গান, যদি আপনার মনে হয় যে, এই গানটি গাইলে আপনি চোখে ‘বাংলাদেশ নামক মাতৃভূমি’ না দেখে হিন্দু দেবী ‘কালী মাকে’ দেখছেন- তাহলে আপনার অবশ্যই ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ এই গানটি গাওয়া থেকে দূরে থাকা উচিত, শোনা থেকে দূরে থাকা উচিত।আপনার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অধিকার বা ইচ্ছা কিংবা সাহস কোনোটাই আমার নাই।
কিন্তু আমাদের হিসেবটা ভিন্ন! খুব ছোটবেলায় রেডিও, টিভিতে অথবা বিদ্যালয়ের অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে যখন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ এই গানটি গাইতাম বা শুনতাম তখন আমাদের একবারও মনে হয়নি, এটি কার লেখা, কার সূর ? তার ধর্ম কি, জাত কী, পেশা কি? তার দেশ কি, জাতীয়তা কি? এই গানের লেখার সাল কত, প্রেক্ষাপট কি!? বা এই গানকে কবে, কোথায়, কে জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলো ? কেনো দিয়েছিল ?
ওই যে একটা গান আছে না “বন্ধু যখন বউ লইয়া, আমার বাড়ির সামনে দিয়া, রঙ্গ কইরা হাইটা যায়, ফাইট্টা যায়, বুকটা ফাইট্টা যায়” বিশ্বাস করুন শিল্পী যখন কড়া সুরে এই গানটি গায়, তখন আমার বুক ফাটে না বরং হাসি পায়। আচ্ছা বলুন তো একটি গানে কষ্টের কথা বলা হয়েছে, কষ্টে বুক ফাটার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু আমার বুক ফাটছে না, হাসি পাচ্ছে। এর জন্যতো আমি দায়ী নই বরং সেই গানটাই দায়ী। ঠিক তেমনি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’এই গানটি শোনার সময় যদি আপনার ভিতর ‘দেশপ্রেম’না জাগে তাহলে আপনি মোটেও দায়ী নন বরং সেই গানটাই দায়ী। এর জন্য আমি আপনাকে দোষারোপ করতে পারি না। অন্তত দেশের ঐ পরিস্থিতিতেতো আরো পারবো না। আপনি বরং সেই গানটি পরিবর্তনের পক্ষেই আওয়াজ তুলুন। আমি-আমরা কিন্তু তুলবো না, কারণ আমাদের তো এই গানে দেশপ্রেমে খুঁজে পেতে মোটেও সমস্যা হচ্ছে না।
এখনো সংকটে, সম্ভাবনায় আনন্দ বা বেদনায় কোথাও যখন এই গানটি শুনি একবারওতো মনে হয় না যে, এই গানটি শিরক যুক্ত কোন গান, এখানে কোনো দেবীর উপাসনার কথা বলা হয়েছে। আমার বাংলা মায়ের কথা বলা হয় নাই। কাজেই আমাদের কাছে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ আমাদের জাতীয় সংগীত, প্রাণের সংগীত। শিশুকাল থেকে যেটাকে জাতীয় সংগীত জেনে এসেছি, আমরা সেটাকে জাতীয় সংগীত হিসেবেই মর্যাদা এবং স্বীকৃতি দিয়ে যাব।
আপনি যদি পারেন এটি পাল্টে অন্য একটি গানকে জাতীয় সংগীত করে ফেলেন। পৃথিবীতেতো কোনো কিছুই স্থায়ী নয়, এটিও পরিবর্তন হতে পারে।পরিবর্তন করে আপনারা হয়ত ভিন্ন কোনো গানকে জাতীয় সংগীত হিসেবে দিতে চাচ্ছেন- আমি বিশ্বাস করতে চাই যে, আপনারা নিশ্চয়ই এর চাইতে ভালো কোনো গান কে জাতীয় সংগীত হিসেবে আপনারা নির্বাচন করবেন যা আপনাদের শর্ত অনুযায়ী যাবতীয় মানদণ্ড উত্তীর্ণ হবে অর্থাৎ এই ভূখণ্ডে জন্ম নেয়া কোনো লেখকের গান হতে হবে, গানের ভিতর ৫২,৭১ এর কথা থাকতে হবে, গানের লেখক পুরুষ হবেন না, নারী হবেন? গানের ভিতর কোন শিরক থাকা চলবে না। গানটি মুসলমান লেখকের হতে হবে (কোন মুসলমান- শিয়া, সুন্নি, ওয়াহাবি, কাদিয়ানী, মওদুদী, মাযহাবি, মাজারপন্থী, খারেজি, রাফেজী, দেউবন্দী, বেরলভী, তাবলীগী, এতাতী, কওমি না আলীয়া শিক্ষিত লেখক তাও ঠিক করে নিবেন।)
গানের লেখক কোনো রাজনৈতিক দলের হবে কি, হবেন না। গানের লেখকের অন্য দেশের নাগরিকতা সনদ থাকতে পারবে কি, পারবে না। গানটি কোনো সরকারকে খুশি করার জন্য হবে না। গানের ভিতর কোনো বিদেশি শব্দ যেমন: আরবি, উর্দু, ফারসি, ইংরেজি, ইত্যাদি শব্দ থাকতে পারবে কি না। গানের লেখক কোনো, দালাল, চাটুকার, দুর্নীতিবাজ, মাদকাসক্ত এবং নারী লোভী হতে পারবে না। ইত্যাদি সকল মানদণ্ড বিবেচনায় উত্তীর্ণ একটি গান আপনারা জাতীয় সংগীত নির্বাচন করে দিবেন। এবং সত্যিই যদি সেটা করেনও, আমরা সেটাও গাইবো। কিন্তু মনে রাখবেন- আমাদের বুকের ভিতর ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি; এই গানটিকেই রাখবো।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে মেহেরপুরের সেই শপথ বাক্যের অনুষ্ঠানে আমার ‘সোনার বাংলা আমি, তোমায় ভালোবাসি’ গাইতে গাইতে একদিন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যে বীর মুক্তিযুদ্ধারা, তাদের আনা জাতীয় সংগীত আমরা পরিবর্তন করার দুঃসাহস দেখাই কি করে। তারা যেমন সোনার বাংলার আদ্যপ্রান্ত জানতে চাননি, আমরাও জানতে চাই না । ছোটবেলায় যেমন জাতীয় সংগীতের আদ্যপ্রান্ত জানতে চাইনি, আজও জানতে চাই না। আপনার কাছে মর্যাদা নাই থাকুক, আমাদের মতো আরো অনেকের মনের মাঝে দেশপ্রেমের চেতনা হয়ে থাকবে, আমার ‘সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ ।
গানটি কোথাও গাইলে, লিখলে, সোনার বাংলার কথা বললে আপনাদের হয়ত আপত্তি উঠবে। আপনারা হয়ত হামলা করবেন, মামলা করবেন, মব জাস্টিস করবেন, মেরে গাছে উপরে ঝুলিয়ে রাখবেন, তাই হয়ত ভয়ে প্রকাশ্যে গাইবোও না। কিন্তু মনের ভেতর ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ এই সুরটিই গুনগুন করে উঠবে। যেমনি ভাবে আপনাদের অনেকের বুকে রেখে দিয়েছেন- ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’।
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
১৩ মে ২৫
1 মন্তব্যসমূহ
শ্রাবণ, চমৎকার লিখেছো! অভিনন্দন...
উত্তরমুছুন