আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শহিদ অধ্যাপক লুৎফর রহমান, অ্যাডভোকেট আকবর হোসেনসহ যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ নাগরিকদের কুরুলিয়া খালে পাশে পাকিস্তান বাহিনী হত্যা করতে নিয়ে যায় সেই দলে কমান্ডার পুলও ছিলেন। তাকেও সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হত্যার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে তিনিসহ আরো ১২ জন সেদিন বেঁচে যান। এরকম আরো অনেক ঘটনা উঠে এসেছে এই বইয়ে।
কমান্ডার পুলুর নেতৃত্বে বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনসহ যুদ্ধকালীন সময়ে বিভিন্ন ঘটনা উঠে এসেছে উপন্যাসের নানা চরিত্রে। স্থানীয় ইতিহাস ছাড়াও উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর ক্ষুদ্র বা বিশদ বিবরণ। সব মিলিয়ে এই বইটিকে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধদিনের একটি দালিলিক উপন্যাস হিসেবেই বিবেচনা করছেন গ্রন্থটির ভূমিকা লেখক কমান্ডার পুলুর যুদ্ধসঙ্গী বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীর প্রতীক।
গ্রন্থটি লিখেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তরুণ লেখক গাজী তানভীর আহমদ। বয়স যার ৪০ না পেলেও লেখালেখির অভিজ্ঞতায় অতিক্রম করেছেন নিজের বয়সকে। বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার ও লেখক চাচা গাজী জাহাঙ্গীর ও গাজী মাহবুবের পরম সান্নিধ্যে কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর। তিনি ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে লেখালেখি করে আসছেন। ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, প্রবন্ধ ও গবেষণাধর্মী লেখার পাশাপাশি স্কুলকলেজের পাঠ্যবই রচনা এবং সম্পাদনার কাজ করছেন নিয়মিত।
গাজী তানভীর আহমেদের জন্ম ১১ এপ্রিল ১৯৮৫ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সদর উপজেলার থলিয়ারা গ্রামে। বাবা গাজী আব্দুল মজিদ ও মা আম্বিয়া খাতুন। জামরুলের ভাষা, মিশন পৃথিবী, মায়ের হাসি ভালোবাসি, ঝিলমিল মাছরাঙা, বয়স যখন চল্লিশ ছুঁইছুঁই, যেভাবে বাঁচি বেঁচে তো আছি এবং সুন্দর করে সাজুনসহ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। সম্পাদনা করেছেন বাংলা সংগীতের কিংবদন্তি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল স্মারকগ্রন্থ। এনসিটিবি অনুমোদিত উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবই উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও বিপণনসহ শিশু-কিশোর সাময়িকী ‘শিশু বিচিত্রা’র সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
আমার সমবয়সি ও বন্ধুবৎসল এই লেখক নিজের গুণ ও কর্মদক্ষতায় অতিক্রম করেছে আমাদের বয়সী আরো অনেককে। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ টহরঃবফ ঘধঃরড়হং ঝপযড়ড়ষং ঙৎমধহরংধঃরড়হ ড়ভ ইধহমষধফবংয (টঘঝঙই) বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এবং প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়াসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও প্রতিযোগিতামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্জন করেছেন বিশেষ সম্মাননা। ২০১১ সালে ‘আমার পৃথিবী তুমি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেন একজন গীতিকবি হিসেবে। বর্তমানে তিনি একটি খ্যাতনামা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগে কর্মরত আছেন।
‘কমান্ডার পুলু’র বাড়ি কোথায়, কীভাবে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসলেন, কীভাবে বেঁচে ফিরলেন- সুরের দেশে মৃত্যুর হাতছানি থেকে। লেখক এই বীরের সন্ধান পেলেন কোথায়, এসব কিছু জানতে হলে আপনাকে পড়তে হবে ‘কমান্ডার পুলু’ নামক এই উপন্যাসটি। ‘কমান্ডার পুলু’ গ্রন্থের ভাষা অত্যন্ত মার্জিত ও সাবলীল। লেখকের উপস্থাপন ভঙ্গি ও চমৎকার। সব বয়সী পাঠকরাই খুব সহজেই-এর রস আস্বাদন করতে পারবেন। গল্পের দোলায় জানতে পারবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ বিশেষত ব্রাহ্মণবাড়িয়া কেন্দ্রীয় বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন অপারেশনের দুঃসাহসিক ঘটনাগুলো একদিকে শিহরন যোগাবে রক্তে অন্যদিকে প্রেরণা যোগাবে মনে। গবেষণা ইতিহাস সংরক্ষণ কিংবা উপন্যাসের স্বাদ পেতে গ্রন্থটি সবার সংগ্রহ থাকা প্রয়োজন বলে মনে করছি।
যেকোনো উপন্যাস লেখা নিঃসন্দেহে কষ্টের বিষয়, ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখা আরও দুরূহ আর মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস লেখা রীতিমতো দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত। এই দুঃসাহসিক ও স্পর্শকাতর এই বিষয়গুলো নিয়ে লিখতে লেখককে সহায়তা নিতে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থের। মুখোমুখি হয়ে হয়েছে সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের। এসব কিছুর সমন্বয়েই এ গ্রন্থে বর্ণিত ইতিহাস ও ঘটনা প্রবাহের সত্যতা নিশ্চয়ন করা হয়েছে।
‘কমান্ডার পুলু’ গ্রন্থটি সম্পর্কে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্তিযুদ্ধ গবেষক কবি জয়দুল হোসেন বলেন - কমান্ডার পুলু মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহের ওপর লেখা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার অদম্য সাহস আর নিরেট দেশপ্রেমের আখ্যান। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্তিশালী ভীত কাঁপিয়ে দিতে এদেশের প্রতিটি পাড়া-মহল্লা থেকে অসংখ্য গেরিলা যোদ্ধা বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। দেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করতে সেই বীর যোদ্ধাদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। তাঁদেরই একজন হলেন রইসউদ্দিন পুলু। তিনি ছিলেন ঢাকার ক্রার্ক প্লাটুনের দুর্র্ধষ গেরিলা যোদ্ধা, এক্সপ্লোসিভ বিশেষজ্ঞ, যাত্রাবাড়ী ইউনিটের কমান্ডার। যুদ্ধের দিনগুলোতে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ একাধিক পয়েন্টে দুঃসাহসিক অপারেশনে সফল নেতৃত্ব দিয়ে দেশবাসীসহ বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছেন তিনি। পুলুর যুদ্ধদিনের সেসব ঘটনা-স্মৃতিকথার সংমিশ্রণে গাজী তানভীর আহমদ ঔপন্যাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে সার্থক রূপায়ণের চেষ্টা করেছেন কমান্ডার পুলু বইয়ে। আশা করছি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং রোমাঞ্চকর ও সরল গল্পপ্রিয় সকল শ্রেণির পাঠকের জন্য কমান্ডার পুলু সুখপাঠ্য হয়ে উঠবে।
ক্রাউন সাইজ, হার্ড বাঁধাই সম্বলিত ৯৬ পৃষ্ঠার এই বইটি প্রকাশ করেছে আদিল প্রকাশ প্রকাশ। এর প্রচ্ছদ এঁকেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। পাঠকের একঘেয়েমি কাটাতে গ্রন্থে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার ছবি স্কেচ আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। এই ছবিগুলো এঁকেছেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী শেখ সাদী। বইটির পরিবেশনায় রয়েছে পঙ্কিরাজ ও বাবুই প্রকাশনী। অমর একুশে বইমেলা স্টল নম্বর ৮৭৩-৮৭৪। এছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মেও বইটি পাওয়া যাবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আগ্রহী পাঠকগণ সরাসরি বইটি কিনতে পারবেন মসজিদ রোডস্থ মদিনা লাইবেরি থেকে। মুদ্রিত মূল্য ৩৫০ টাকাম মাত্র।
---------------------
গাজী তানভীর আহমেদের ‘কমান্ডার পুলু’,
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অনন্য ও রোমাঞ্জকর এক উপন্যাস
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
৪ ফেব্রুয়ারি ২৫
ব্রাহ্মণবাড়িয়া
০১৭১৭-০৯৫৭৫১
0 মন্তব্যসমূহ