উৎপাদন বৃদ্ধি ও অসাধু ব্যবসায়ীদের দফারফা না
হলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসবে না কখনোই
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
কয়েক বছর আগের কথা। পেঁয়াজ নামক ঝাঁঝালো এই মসল্লাটি দেশজুড়ে বেশ তোলপাড় করেছিল। রান্না-বান্নার অতি প্রয়োজনীয় মসলাটি রান্নাঘর ছেড়ে বেশ ঝাঁজ ছড়িয়েছিল দেশের হাট-বাজার, রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে। পত্র-পত্রিকার বড় বড় কলাম আর সোশ্যাল মিডিয়ার হট টপিক ছিল পেঁয়াজ। তারপর এই পেঁয়াজ নিয়ে বঙ্গদেশে রং ঢং-এর কত কাহিনি, কত কীর্তি ঘটে গেল। সোনার ব্যবসায় ফেলে অনেকে তখন পেঁয়াজের ব্যবসায় চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে ছিল, সে তথ্য কারো কাছে আজ অজানা নয়।
পেঁয়াজের দেখা দেখি কাঁচা মরিচও সাম্প্রতিক সময়ে তার ঝাল নিয়ে মাথা উঁকি দিয়েছে। তার ভাষ্য হচ্ছে- 'আমিতো পেঁয়াজের মত সমজাতীয় মর্যাদা সম্পন্ন মসল্লা। দেখতে ছোট হলেও আমার ঝাল অনেক বেশি। পেঁয়াজ যদি ২০০/২৫০ টাকা সম্মানী নিতে পারে, তাহলে আমি কেন নয়? সে পেঁয়াজের চেয়ে আরো ২০ টাকা মূল্য বৃদ্ধি করে বাজারে এখন ২৭০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। সে তো না হয় ভালোই ছিল তাই বলে এবার বারোশো টাকা কেজি ! একে তো আকাশ ছোঁয়া না বলে বরং মঙ্গল গ্রহের ছোঁয়া দাম বলা যায়।
বঙ্গদেশে ঝাল-ঝাঁজ থাকলেই যে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে বিষয়টি তা নয়। তার বিপরীত স্বাদ জাতীয় খাদ্য দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিও অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাইতো মিষ্টি, চিপস চকোলেটের দামও বাড়ে। এই মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় ডিমের মতো নিতান্ত গুলুমুলু, হাবাগোবা খাদ্যও তার নিজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। দুই হালি ডিমের দামে এখন এক হালি ডিম পাওয়া যায়। ডিমের এই এ গ্রেড ফলাফলে বেশ ঈর্ষান্বিত হয়ে সীম, আলু, মুলা, বেগুন, ঢেঁড়সের মত নিরীহ সবজিও উত্তাপ ছড়াচ্ছে বেশ। সবজি বিক্রেতা যতই তাতে পানি ছিঁটায় সবজির দাম ততই বাড়ে। তাই সবজির মৌসুম বলে খ্যাত শীতেও উচ্চ দামে সবজি খেতে হয়েছে বাঙালিদের। ধনেপাতা, শাকও যেন আজকাল দারোগার নৌকার মাঝি।
মূল্য বৃদ্ধির এই দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে মাছ, মাংস, চাল, ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র। চিনি দৌড়াচ্ছে মিলকা শিং এর গতিতে। গরুর মাংস, ইলিশতো বিসিএস-এর প্রিলি উৎতীর্ণ খাদ্য। রিটেন টিকলে যে কী অবস্থা হবে আল্লাহই জানে। এর মধ্যে ভোজ্যে তেলের লুকোচুরি দেখে বেশ মজা লেগেছিলো। লুকাতে লুকাতে কারো কারো বাড়ির খাটের নিচে লুকিয়েছিল নানা কোম্পানির সয়াবিন তেল। পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট, ভোক্তা অধিকারের বেরসিক কর্মকর্তা অবশ্য তাদের কাউকে কাউকে কান ধরে টেনে বের করে নিয়ে এসেছে।
অপচনশীল খাদ্য হওয়ায় সয়াবিন তেলের লুকোচুরি দেখে আফসোস করেছিল পচনশীল সব খাদ্যশস্য। ইশ্ তারা যদি অপচন শীল দ্রব্য হতো তাহলে হাজার টাকা দাম না হওয়া পর্যন্ত তারা নিজেদের লুকিয়ে থাকতে পারতো। দাদা পরদাদার লুকিয়ে রাখা, আলু, পেঁয়াজ খুঁজে পেয়ে হঠাৎ বড়লোক হয়ে যেতো নাতি-পুতিরা। প্রত্নবিদরা মাটি খুঁজে পেয়ে যেতো মহা মূল্যবান শাক-সবজি। ভাবা যায় বিষয়টি! সে যাই হোক এই বঙ্গদেশে নানান সময় নানান জিনিসপত্র গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের নাইকাদের মত উত্তাপ ছড়াতে থাকে এবং থাকবে আর ধোয়া উঠতে থাকবে ক্রেতাদের পকেট থেকে।
এতো গেল খাদ্য পণ্যের কথা। খাদ্যপণ্য ছাড়াও নিত্যব্যবহার্য আরও বস্তুগত ও অবস্তুগত জিনিসপত্রের দাম হরহামেশাই বেড়ে চলে। তাই জ্বালানি তেল, পানি, বিদ্যুৎ গ্যাস এর মতো জরুরি সেবাগুলো মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় থেমে থাকে না। 'যুগের সাথে তা মেলাতে না পারলে, কোটা দিয়েও তাদের এগিয়ে রাখা যাবে না।' একথা তারা ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছে।
দেশের একটি বিরাট অংশ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং উল্লেখযোগ্য একটি অংশ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। দেশের বেশিরভাগ এই মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে রীতিমতো হাঁপিয়ে ওঠে তাদের। সীমিত আয়ে কারো সংসার ১৫-২০ দিন ঠিকঠাক ভাবে চললেও বাকি দিনগুলো আর ঠিকমতো চলতে চায় না। তখন মনের সব রাগ-ক্ষোভ দেখায় সরকার, প্রশাসন আর ব্যবসায়ীদের ওপর।
তখন সাধারণ মানুষ ক্রমবর্ধমান মূল্য বৃদ্ধির সাথে জীবন যাত্রার মান খাপ খাওয়াতে না পেরে নীরব যন্ত্রণায় তখন ভিন্ন পথ অবলম্বন করে। যাদের টাকা পয়সা আছে তারা তখন খাদ্যশস্য মজুদ করে বাজারে আরো কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। আর যাদের নাই তারা যখন যে জিনিসের দাম বাড়ে তখন তা বাদ দিয়ে বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো জিনিসকে খাদ্য তালিকায় যুক্ত করে। নিতান্তই যেগুলো খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায় না, সেগুলোর পরিমাণ কমিয়ে ব্যবহার করে। গরিব-মধ্যবিত্ত এভাবেই চলছে, ভবিষ্যতেও হয়ত এভাবেই চলবে।
অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকারগুলো যে দেশে রমরমা ব্যবসা, সেই দেশের মানুষ নানা দাবিতে তুমুল আন্দোলন করতে রাজপথ গরম করতে পারলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্ব গতিতে বাড়িতে বসে নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মাঝে মাঝে প্রশাসনে তৎপরতায়, (ব্যবসায়ীদের ভাষায় পড়ুন অপতৎপরতায়) কিছু জিনিসপত্রের দাম কমলেও পরবর্তীতে ব্যবসায়ীরা তাদের কৌশল পাল্টে নতুনভাবে আবার মূল্যবৃদ্ধি করে।
নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য বিদেশ থেকে আমদানি করা কখনোই স্থায়ী সমাধান নয়। কোনো কারণে আমদানি বন্ধ হয়ে গেলেই সংশ্লিষ্ট পণ্যর দাম হঠাৎ করে বেড়ে গেলে বেকায়দায় পড়ে সাধারণ মানুষ।নিত্য প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যের দেশীয় উৎপাদন অবশ্যই বৃদ্ধি করার দিকে নজর দিতে হবে সরকারকে। বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমেই বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
মোট কথা আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি করা, ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে অপচয় রোধ ও মিতব্যয়ী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সেটা, পেঁয়াজ, মরিচ, চাল, ডাল, তেল, ডিজেল, পেট্রোল, গ্যাস বা বিদ্যুৎ যাই হোক না কেনো। সেই সাথে নিয়মিত বাজার মনিটরিং জোরদার করা। পণ্যের সঠিক দাম নির্ধারণ, প্রান্তিক কৃষক থেকে সরাসরি ভোক্তা পর্যায়ে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করা। মজুতদার, আড়তদারদের গুদামের ওপর নজরদারি করা। ক্ষেত্রবিশেষে অসাধু, সিন্ডিকেট ও অতিরিক্ত মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের ধরে ধরে জেলে পুরতে না পারলে দ্রব্যমূল্য সাধারণ জনগণের হাতের নিয়ন্ত্রণ আসবে না কখনোই।
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
লেখক, সংগঠক
0 মন্তব্যসমূহ