Ticker

6/recent/ticker-posts

চির উন্নত হোক শিক্ষাগুরুর শির


১৯৯৭ সালের ঘটনা। ষষ্ঠ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা চলছিল। বাবার চাকরির সুবাদে আমরা তখন থাকতাম গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলায়। এখানকার স্বনামধন্য পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমরা দুই ভাই। সেবার স্কুলের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশের বিল্ডিং-এ আমাদের পরীক্ষার সিট পড়ল। 

কী এক পরীক্ষার দিন পরীক্ষার হলে দায়িত্ব থাকা শিক্ষক পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে চেয়ারে বসে বই পড়ছিলেন অথবা কোন শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলছিলেন (আমার ঠিক মনে নেই)। সে সময়  ঐ এলাকার টিএনও ( বর্তমান ইউএনও) অফিসার আসলেন স্কুল পরিদর্শনে। তিনি আমাদের পরীক্ষার রুমে এসে যখন দেখলেন দায়িত্বরত শিক্ষক সঠিক অবস্থানে নেই, তিনি তখন ক্লাসে ঢুকে ঐ শিক্ষককে খুবই উচ্চস্বরে গালাগালি করতে লাগলেন।

টিএনও স্যার বড় মাপের কোনো সরকারি কর্মকর্তা তা আমরা প্রাইমারি স্কুলে থাকতেই বুঝে গিয়েছিলাম। কারণ আমরা দেখতাম- মাঝে মাঝেই উপজেলা/জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা অথবা টিএনও স্যার আসবেন বলে স্কুলে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বাইরেও অতিরিক্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। যেদিন তারা আসতেন, সেদিন স্কুলে সব শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রীদেরকে অনেক পরিপাটি হয়ে এবং শান্ত সৃষ্টভাবে ক্লাস পরিচালনা করা হতো। 

আমরা তাদের এক রকম ভয় পেতাম। যদিও অনেক শিক্ষা কর্মকর্তারা এসে আমাদের সঙ্গে খুব দারুণ দারুণ গল্প করতেন।  পরিদর্শনকারী কর্মকর্তাদেরকে আমাদের শিক্ষকরা যথেষ্ট সম্মান এবং আপ্যায়ন করতেন এবং তাদের আচরণে ভীতির প্রকাশও ছিল। আমরা যে সকল শিক্ষকদের ভয় পেতাম, সেই সকল শিক্ষকরাই যখন অন্য কর্মকর্তাদের ভয় পেতেন তখন আমরা বুঝতাম তারা স্যারদেরও স্যার, মহা রকম কিছু ! হাই স্কুলে উঠেও দেখলাম একই অবস্থা।

যাইহোক পরীক্ষার হলে টিএনও স্যারের এমন রাগারাগির কারণে আমরা যথেষ্ট ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এবং এই স্যারের জন্য চিন্তাও হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এই স্যারকেও কোনো ধরনের শাস্তি দেওয়া হতে পারে। কিন্তু ঘটনার মোড় ঘুমিয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। স্কুলের এই অংশের পাশেই ছিল যাতায়াতের রাস্তা। যাতে ছাত্রছাত্রীরাসহ সাধারণ মানুষের চলাচল করত। সে সময় এলাকার এক ছাত্রনেতা ক্লাসের ভিতরে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে এই দিকে উঁকি দিয়ে দেখে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে বকাঝকা করছেন।

ইউএনও স্যার শ্রেণি থেকে বের হওয়া মাত্রই ওই ছাত্রনেতা তার সাথে উচ্চবাচ্য করতে লাগলো। ছাত্রনেতা দাবি হচ্ছে- একজন শিক্ষক যতই ভুল করুক তাকে আপনি তার ক্লাসের ভিতরে, তারই ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে বকাঝকা করতে পারেন না। এতে ছাত্রছাত্রীদের সামনে শিক্ষকের মর্যাদাহানী হয়। শিক্ষক যদি ভুল করে থাকে আপনি তাকে অফিস রুমে ডেকে নিয়ে কথা বলতে পারতেন। বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পারতেন। টিএনও মহোদয় সরকারি কর্মকর্তা, তিনিওতো তার জায়গা থেকে অনড়। নিজের যুক্তির পক্ষে জোর গলায় কথা বলছেন। ছাত্র নেতাও সেই কর্মকর্তাকে এক বিন্দু ছাড় দিয়ে কথা বলছে না। 

বলা বাহুল্য এই ছাত্রনেতা কোন দলের তা আমার মনে নেই। সে সময় যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল ধারণা করি সে ছাত্রলীগের নেতা হতে পারে, আবার সেই এলাকা ছিল জাতীয় পার্টি অধ্যুষিত এলাকা, সে হিসেবে ছাত্রসমাজের নেতাও হতে পারে অথবা অন্য কোনো দলের।

এই ছাত্রনেতাকে আমি এক ধরনের ভয় পেতাম । তার কারণটা বলি । পূর্বেই বলেছি আমার বড় ভাই একই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিল। আমরা থাকতাম শিল্পী আপাদের বাসায়। যেটি ঘাঘট নদীর পাড়ে, বাজারে যাওয়ার রাস্তার পাশে অবস্থিত। একদিন সন্ধ্যায় বড় ভাই তার পাঠ্য বই থেকে মুনির চৌধুরীর কবর নাটকটি পড়ছিলো। একই টেবিলে পড়তে বসেছিলাম আমি। সে সময় রাস্তার পাশে যেতে থাকা ওই ছাত্রনেতা আমাদের দরজায় টোকা দেয় এবং দরজা খুলতে বলে। দরজা খোলার পর সে, ভাইয়া পড়ার সময় যে ভুলগুলো করেছিল সেই ভুলগুলো শুধরে দিতে থাকে এবং এই কবর নাটক কোন প্রেক্ষাপটে রচিত এই বিষয়ে বর্ণনা করতে থাকে।

সে যখন ভাইয়ের সাথে কথা বলছিল তখন ভাইয়াকে অনেক বিনয়ের সঙ্গে তার সাথে কথা বলতে দেখলাম। তিনি তিনি চলে যাওয়ার পর ভাইয়া জিজ্ঞেস করেছিলাম সে কে ?  ভাইয়া বলেছিল এই ছেলেটি একজন ছাত্র নেতা। নেতা-তেতা কি জিনিস তখন ঠিক বুজতাম না। আব্বা পাশের রুমে ছিল। কিছুক্ষণ পর তিনি এসে বললেন এদের সাথে যেন কখনো ঝামেলায় না জড়াই। বুঝলাম ছাত্র নেতা খারাপ কিছু, তাদের সাথে ঝামেলায় জড়ালে খবর আছে !

এই ছাত্রনেতা সাধারণ ছেলেদের অন্যদের থেকে একটু ব্যতিক্রম ছিল। কিছুটা রাগী রাগী ভাব এবং সিরিয়াস মুডে থাকতো। দেখলে আমার কেমন যেন একটা ভয় ভয় কাজ করতো। এই ছেলেটি যখন টিএনও স্যারের সাথে ঝগড়া জুড়ে দিল তখন আমাদের পরীক্ষার অবস্থা প্রায় বারোটা। কাঁপা কাঁপা হাতে আমরা আমাদের লেখা শেষ করছিলাম। বাইরে তখনও প্রচুর হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে। কেননা  স্কুলের অন্যান্য শিক্ষক ও আশেপাশের অন্যান্য লোকজন স্কুল মাঠে জড়ো হয়ে গেছে। এই হট্টগোলের মধ্যে শিক্ষকরা ঐ অফিসারকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আসেন। এবং তিনি চলে যান স্কুল থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে তার কর্মস্থলে। 

এর মধ্যে সকলের পরীক্ষা শেষ হয়। পরীক্ষার হলে থাকা যে সকল শিক্ষার্থীরা বিষয়টি তখনো বুঝে উঠতে পারেনি, তারা হল থেকে বের হয়েই মানুষের ভিড়ে যোগ দেয়।এবং সবকিছু শুনে সবাই খুব ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। পরক্ষণে সবাই নানা ধরনের স্লোগান দিতে থাকে। এই সময় ওই ছাত্রনেতার নেতৃত্বে স্কুলের বড়  ভাইয়েরা একটি মিছিল নিয়ে রওনা দেয় টিএনও অফিসের দিকে। যাবার সময় হাতের কাছে যে যা পায়- নানা ধরনের লাঠি ও গাছের ডাল সাথে নিয়ে নেয়। তাদের সাথে যোগ দেই আমরা ছোটরাও। 

কর্মকর্তা বিরোধী নানা স্লোগান দিতে দিতে সবাই এক সময় পৌঁছে যায় টিএনও অফিসে। পরীক্ষার সম্ভবত দুপুরের দিকে ছিল। অফিসে মিছিল নিয়ে যেতে যেতে তখন প্রায় সন্ধ্যার কাছাকাছি। ইউএন অফিসের সামনে সবাই জড়ো হয়ে নানা ধরনের স্লোগান দিতে থাকে। স্লোগানগুলো মনে নেই, তবে শিক্ষকের অপমান মানি না, মানবো না//ইউএনওর চামড়া তুলে নিব আমরা, শিক্ষক অপমানের বিচার চাই- এই টাইপের স্লোগানই হবে হয়ত।

পরবর্তীতে শুনলাম অবস্থা বেগতিক দেখে টিএনও মহাশয় দোতালায় কোনো একটি কক্ষে লুকিয়েছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে আমাদের স্কুলের শিক্ষকগণ ছাড়াও এলাকার আরো গণ্যমান্য ব্যক্তি ইতিমধ্যে সেখানে জমায়েত হয়েছে। তারা বিষয়টি মীমাংসা করার চেষ্টা করছেন। আমরা ভিড়ের মধ্যে থেকে শুনলাম সেই কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ আর করবেন না বলে ওয়াদা করেছেন। এতেই বিষয়টি মীমাংসিত হয়। সবাই স্যারকে নিয়ে বিজয়ী বেশে মিছিল করতে থাকে।

এখানে একটি স্মরণযোগ্য বিষয়- আমি আমার সাথে থাকা কয়েকজন বন্ধুরাও হাতে কিছু গাছের ডাল রেখেছিলাম। স্লোগানের মাঝখানে দেখলাম কয়েকজন পুলিশ এসে আমাদের হাত থেকে ডালগুলো নিয়ে নিল । বলল তোমরা ছোট মানুষ তোমাদের হাতে এসব কেনো। পুলিশ দেখে আমরা একটু ভয় পেয়েছিলাম, তবে পুলিশকে তখন এমন মনে হয়নি যে তারা আমাদের প্রতিহত করতে আসছে। ভিড়ের মাঝখানে ঢুকে সবার হাত থেকে তারা লাঠি ছোট গুলো সরিয়ে নিচ্ছিল। আর এখনকার পুলিশ……?

যাইহোক- আমার জীবনে অনেক স্মরণীয় ঘটনার মধ্যে এটি একটি ঘটনা। বলতে গেলে প্রথম কোনো আন্দোলনে শরিক হওয়া। এবং তা ছিল শিক্ষক নির্যাতন বা অপমানের বিরুদ্ধে। সে আন্দোলনে ছোট্ট আমি কোনো ভূমিকাই রাখিনি কিন্তু তারপরেও এটা ভেবে আমার গর্ব হয় যে একজন শিক্ষকের অপমানের প্রতিবাদে ছাত্ররা সবাই একত্রিত হয়েছিল। এবং তা আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো।

পরবর্তীতে ওই ছাত্রনেতার প্রতি হয় আমার ভয় কেটে গিয়েছিল এবং তাকে দেখে আমার এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ কাজ করত। এত বছর পরে আমি যদি তার নাম মনে রাখতে পারতাম, তাহলে তাই তাকে খুঁজে বের করে একটু ধন্যবাদ জানাতে পারতাম।

জাতির মেরুদন্ড করার কারিগর এই শিক্ষকরা সব সময় সমাজের মানুষকে কাছে শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত, তা সত্ত্বেও দেশে নানা সময়, নানা জায়গায় শিক্ষকদের অপমান, অপদস্থ বা নির্যাতন করার কথা শুনতে পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে এই সকল অন্যায় অবিচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে শিক্ষক ছাত্রছাত্রীসহ সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের কথাও জানা যায়। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে একটি সফল ছাত্র অান্দোলন সংগঠিত হওয়ার পরেও শিক্ষকদের সম্মান করার এই জায়গাটায় একটি প্রচণ্ড ধাক্কা খেলো !

 লেখার বাকি অংশ পড়ুন পরবর্তী পোস্টে….

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

৩০ আগস্ট ২৪


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ