প্রবন্ধ- ভালোবাসার শক্তি: বিল গেটস-এর বিবাহ বিচ্ছেদ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
অর্থ জীবনধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও এই অর্থই যে সবসময় সুখের কারণ হয় না তার প্রমাণ আমরা মাঝে মাঝেই পাই। এবার সেই প্রমাণটি আবারও আমাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। বিশ্বের অন্যতম ধনী বিল গেটস ও তার স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে যৌথ বিবৃতিতে তারা তাদের ২৭ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটানোর ঘোষণা দেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ এই ধনী দম্পতি। টুইটবার্তায় তারা বলেন- 'জুটি হিসেবে এগিয়ে যেতে পারি; এটা আমরা আর বিশ্বাস করি না। আমাদের সম্পর্কটি নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা ও কাজের পর আমরা আমাদের বিয়ের সমাপ্তি টানার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।' (বিবিসি নিউজ বাংলা, ০৪ মে ২০২১)।
দাম্পত্য জীবনে তাদের সম্পর্কের টানাপড়েন ছিল কি-না সেই বিষয়টি স্পষ্ট করে তারা না বললেও, সম্পর্কের অবনতি না ঘটলে কেউ এমন সিদ্ধান্ত নেয় না মনে করে সকলেই ভাবছেন সাম্প্রতিক সময়ে তাদের সম্পর্ক অন্তত সমান্তরাল ছিল না। অর্থ-সম্পদ তাদের দাম্পত্য বন্ধনকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হলেও আমাদের দেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশের কৃষক, শ্রমিক, গরিব, দিনমজুর, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের দম্পতিরা সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে জীবন পাড়ি দিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিয়েছেন। এই জায়গাতে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনী বিল গেটস দম্পতি ব্যর্থ হয়েছেন। আমরা প্রায়ই ভাবি অর্থ এবং ক্ষমতা আমাদেরকে সুখে রাখবে। এজন্য আমরা মরিয়া হয়ে যাই অর্থ ও ক্ষমতাকে হস্তগত করতে, আর ভুলে যাই জীবনের প্রকৃত সুখের সন্ধান। জীবনে সুখী হতে হলে অর্থ নয়, প্রয়োজন হয় ভালোবাসা। প্রয়োজন একজন মানুষ, যে আপনাকে ভালোবাসবে, একজন মানুষ যাকে আপনি ভালোবাসবেন। পৃথিবীতে যদি এই ভালোবাসার সত্যিকারের একজন মানুষ আপনি পেয়ে যান, তাহলে অবশ্যই আপনি জীবনে প্রকৃত সুখের দেখা পাবেন।
বিবাহ বিচ্ছেদের মাধ্যমে বিল গেটস দম্পতি আমাদের সামনে আরেকটি উদাহরণ দিয়েছেন। তা হচ্ছে তার জীবন সঙ্গিনীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটালেও তারা তাদের দাতব্য প্রতিষ্ঠানে মানব সেবায় একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। টুইটার বিবৃতিতে তারা বলেন- 'গত ২৭ বছর ধরে আমরা তিনটি অসাধারণ সন্তানকে বড় করেছি এবং একটি ফাউন্ডেশন তৈরি করেছি যা বিশ্ব জুড়ে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করে। ফাউন্ডেশনে আমরা এক সাথে কাজ করে যাবো। কিন্তু জীবনের পরবর্তী ধাপে আমরা একসাথে এগিয়ে যেতে পারবো বলে আমরা আর বিশ্বাস করি না।' (বিবিসি নিউজ বাংলা, ০৪ মে ২০২১)।
আমরা আমাদের আশেপাশে প্রায়ই দেখি কোনো স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হলে সেটার চূড়ান্ত পর্যায়ে হয়ে যায়। মামলা, জেল তো আছেই, মারামারি-খুনোখুনি পর্যন্ত হয়ে যায়। এক ছাদের নিচে থেকে, এক বিছানায় ঘুমিয়ে, এক প্লেটে খাবার খেয়ে, একসঙ্গে জীবনের অনেক মধুর ও গুরুত্বপূর্ণ সময় পাড়ি দিয়ে দুজন মানুষ কীভাবে একে অপরের চিরশত্রু হয়ে যায়, তা আমার মাথায় আসে না। কারো সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করলে এটি কম থাকতেই সম্পর্কের উন্নয়ন করা উচিত। আর তা না হলে তখন থেকেই আলাদা হওয়া উচিত, যেন বন্ধুত্ব শত্রুতায় পরিণত না হয়। সুখের পরিণয় যেন দুঃখের পরিণতি না হয়। বিল গেটস দম্পতি সেই উদাহরণটাও আমাদের সামনে রেখেছেন।
একজন নিঃস্ব মানুষ থেকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনী হওয়া। ধনী হয়েও সাদামাটা জীবন যাপন করা। অদম্য ইচ্ছাশক্তি, সৃষ্টিশীল চিন্তাশক্তি ও পরিশ্রমী ব্যক্তিসত্তা, তার প্রেম, বিয়ে, ছেলেমেয়েদেরকে কঠোর অনুশাসনে লালন পালন করা, তাদের সম্পদের বিপুল একটি অংশ মানব সেবায় দান করা, বিচ্ছেদের পরও সাবেক স্ত্রীর সাথে একসঙ্গে কাজ করা ও পারস্পরিক গোপনীয়তার রক্ষার অঙ্গীকার, বিলগেটস-এর এসব কিছুই আমাদের কাছে উদাহরণ অনুসরণ ও অনুপ্রেরণার।
মাঝেমাঝেই শুনি অনেকে আত্মহত্যা করেছেন। তরুণ বয়সের ছেলে-মেয়ে এবং অনেক বিবাহিত নারী-পুরুষের মধ্যেও এই আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়। আমি মনে করি তারা সত্যিকার অর্থে কাউকে ভালোবাসতে পারেনি, অথবা কেউ তাকে সত্যিকারভাবে ভালোবাসেনি। এজন্যই এত মানুষের ভিড়ে একটি ভালোবাসার মানুষ খুঁজে না পাওয়ার চরম ব্যর্থতা তাদের আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করে। মানুষের জীবন একটাই, কত সহজেই সেই জীবনের সব বন্ধনকে ছিন্ন করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেয়। সম্ভবত ভালোবাসার ঘাটতি তাদেরকে এই পথে ধাবিত করে।
এই যে ভালোবাসার কথা বললাম। অনেকেই ধরে নেবেন আমি কোন যুগলের কথা বলছি। না ভালোবাসা শুধু একজন নর-নারীর জৈবিক সম্পর্কের কারণেই সৃষ্টি হয় না। আত্মিক সম্পর্কেও ভালোবাসা থাকে, থাকে রক্তের সম্পর্কেও। কাজেই আপনার ভালোবাসার মানুষ হতে পারে আপনার বাবা-মা, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, বন্ধু বা অন্য কেউ। আর কাউকে না পেলে ভালোবাসতে পারেন প্রকৃতিকে। এই সুন্দর পৃথিবী, এতো চমৎকার, মায়াময়, কত রোমাঞ্চকর, রহস্যে ভরপুর। বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে উপভোগ না করে সহজেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা মেনে নেওয়া যায় না। প্রকৃতি আর পশু পাখিকে ভালোবাসে কত মানুষ নিঃসঙ্গ জীবন পাড়ি দিচ্ছে তার হিসেব কি আত্মহত্যাকারীরা রাখে ?
আমি মনে করি বিল গেটস ভালোবাসার শক্তিতে বলীয়ান একজন মানুষ। তিনি নিজেকে ভালোবেসেছেন, নিজের জীবনকে ভালোবেসেছেন। ভালোবেসেছেন নিজের কাজকে। তিনি নিজের পরিবারকে ভালোবেসেছেন। সর্বোপরি মানুষকে ভালোবেসেছে। আর ভালোবাসার শক্তিতেই তিনি আমাদের কাছে একের পর এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। ভালোবাসা এমন এক শক্তি যা আপনাকে সুখ এনে দেবে। আপনার জীবনকে রঙিন, ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে তুলবে। কাজেই নিজেকে, নিজের কাজকে ভালোবাসুন, প্রকৃতি আর প্রাণিজগতকে ভালোবাসুন। মানুষকে ভালোবাসুন। আপনাকে যে ভালোবাসে তাকে আরো বেশি করে ভালোবাসুন। একটি কথা মনে রাখবেন একমাত্র ভালোবাসাই এই জগৎ সংসারকে সুন্দর, সার্থক ও সফল করে তুলতে পারে।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক, ঝিলমিল একাডেমি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
0 মন্তব্যসমূহ