তাসফিয়ার বিশ্বকাপ দেখা ও আমার প্রত্যাশা
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
আমার শিশুকন্যা তাসফিয়ার প্রথম বিশ্বকাপ খেলা দেখা এবার, অন্য হিসেবে দ্বিতীয় বার। পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়াসহ বাসায় আজ দুই দলের সাপোর্টারই ছিল। ফলে যেই দলই গোল করুক না কেন; কেউ না কেউ চিৎকার-চেঁচামেচি করে ওঠে, সেইসঙ্গে তাসফিয়ারও সমান উল্লাস। অর্থাৎ বুজে না বুজে সে আজ দুই দলেরই সাপোর্ট করেছে।
তাসফিয়ার এই বিশ্বকাপ মুহূর্তকে স্মরণ করে রাখার জন্য এই মাঝরাতেও জয়-মিছিল দেখার জন্য ওকে নিয়ে রাস্তায় বের হলাম । আমার কাঁধে চড়ে দেখে আসলো মেসি সমর্থকদের জয়উল্লাস। কিছুদিন আগে ওর মা‘র সাথে বাহিরে গিয়ে দেখে এসেছে সাদা-আকাশী জার্সি ওয়ালাদের বিশাল মিছিল। আমার কাছে মাঝে মাঝেই সেই কথা স্মরণ করিয়ে দেয় সে। আজকেও বাইরে মিছিলের আওয়াজ পেয়ে সেই কথা বলল। তাই তাকে নিয়ে বের হলাম আর্জেন্টিনার বাংলাদেশী সর্মথকদের মিছিল দেখাতে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি ব্রাজিল সাপোর্টার। ছোটবেলায় পাঠ্য বইয়ে কিংবদন্তী ফুটবলার প্লে-র জীবনী পড়ে প্লে এবং তার দেশ ব্রাজিলের ভক্ত হয়েছিলাম। পরবর্তীতে বিভিন্ন বিশ্বকাপ উন্মাদনায় নিজের ব্রাজিল সাপোর্ট হওয়ার কথা প্রচার করতাম। কিন্তু নিজে যেহেতু খেলি না বা খেলা দেখি না এবং খেলার অনেক কিছুই বুঝি না তাই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খেলা নিয়ে আমি খুব বেশি আগ্রহ দেখাই না।
যখন থেকে আমাদের দেশে খেলা নিয়ে অতি উৎসাহী, হৈচৈ এবং এমনকি মারামারি ঘটনা ঘটতে শুরু করল। যখন থেকে নিজ দেশে ভিনদেশীদের লম্বা লম্বা পতাকা দেখতে শুরু করলাম। তখন থেকেই খেলা নিয়ে উৎসাহ দেখানো কমিয়ে দিয়েছিলাম। তাছাড়া এই ক্রীড়া উন্মাদনা আমাদের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয়, সামাজিক এবং পারিপার্শ্বিক সমস্যা গুলোকে আড়াল করে রাখে, যা আমার কাছে মোটেই ভালো কিছু মনে হয় না। তাই খেলা নিয়ে উৎসাহ না দেখানোর সেটাও একটা কারণ ।
তবে যাই হোক, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ খেলা দেখে। অসংখ্য মানুষ খেলা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্মকান্ডের জড়িত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। তাই ভবিষ্যতেও এই খেলার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে বই কমবে না। সেজন্যই আজ আমার মেয়েকেও তার স্মৃতিতে এই বিশ্বকাপকে ধারণ করে রাখার সামান্য চেষ্টা করলাম মাত্র।
ক্রীড়া নৈপূণ্যর সাথে সাথে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে খেলার যে একটি বিরাট ভূমিকা রয়েছে সেকথা কে’না জানে। তবে আমার খেলা সাপোর্ট করার কারণটা ভিন্ন। সেটা হচ্ছে “বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব”। এই ফুটবল, ক্রিকেট এবং অন্যান্য খেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশ জাতি ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মাঝে যে বিশ্ব ভাতৃত্ববোধ তৈরি হয়, সেটাই আমি ভীষণভাবে উপভোগ এবং অনুধাবন করি।
ফাইনালে ব্রাজিল বিশ্বকাপ খেলেনি, তাই মনে মনে চাইছিলাম শেষবার বিশ্বকাপ খেলা ফুটবলের আইকন, মেসির হাতেই উঠুক এবারের গোল্ডেন ট্রফি। তাদের ৩৬ বছরের তৃষ্ণাও মিটুক। অবশেষে জাদুর মত সেটাই সফল হল। আজ আর্জেন্টিনা ভালো খেলে জয়লাভ করেছে। ফ্রান্সও হেরেছে সম্মানজনকভাবে। ভাগ্যটা এবার তাদের সঙ্গ দেয়নি শুধু।
খেলা নিয়ে আমাদের দেশে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে। তাদের জন্য এই বিশ্বকাপের শেষ দৃশ্যগুলো নিদর্শন হয়ে থাকুক। যেখানে হার-জিত নির্ধারিত হওয়ার পরেও কারো চোখে দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর প্রাপ্তির অশ্রু, কারো চোখে অপ্রাপ্তির বেদনা নিয়ে দুই দলের কর্মী-সমর্থক একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছে ।
আমি প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখেছিলাম টিভির পর্দায় ১৯৯৮ সালে। যেটি ফ্রান্সে হয়েছিল। এবারের বিশ্বকাপ আয়োজনে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনবদ্য এক উপস্থাপনা দেখিয়েছে মরুর দেশ কাতার। নজরকাড়া প্রযুক্তির ছোঁয়া, বাহারী আলোর ঝলকানি, ব্যতিক্রমী চিন্তা, নিজস্ব ঐতিহ্য ও ধর্মীয় গাভীর্যর সাথে প্রযুক্তির অপূর্ব মিশ্রণে কাতার বিশ্বকাপ বিশ্ববাসীর মনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে বহুদিন।
আজকের এই লেখায় স্মরণ করি সেই সমস্ত বাঙালি শ্রমিক ভাইদের, যারা কাতারে এই বিশ্বকাপ ভ্যেনু নির্মাণ ও অন্যান্য কাজে নিজেদের রক্ত, শ্রম ও ঘাম ঝরিয়েছে। যাদের অর্থে সমৃদ্ধ হবে আমাদের দেশের অর্থনীতি ।
একদিন কোন এক বিশ্বকাপে বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা নিজেদের ঘাম ঝরাবে মাঠে। সেদিন দর্শক গ্যালারি ছেয়ে যাবে লাল সবুজের পতাকায়। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ শুনবে “আমার সোনার বাংলা- আমি তোমায় ভালোবাসি” গানের মধুর সুর, সেই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
সেই দিনের প্রত্যাশায়
মনিরুল
ইসলাম শ্রাবণ
রাত
০১টা
লোকনাথ
দিঘিরপাড়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
ছবি: ২০১৮ ও ১৯ সালে সারা ও তাসফিয়া
0 মন্তব্যসমূহ