Ticker

6/recent/ticker-posts

স্মৃতিতে উদয়......


স্মৃতিতে উদয়......

সময় কত দ্রুত চলে যায়। সময়ের সাথে সাথে স্মৃতিগুলো যেন ঝাপসা হতে থাকে। দেখতে দেখতে উদয়ের মৃত্যুর চার বছর হয়ে গেল। অথচ মনে হয় এইতো সেদিন ২০০৮, ২৮ এপ্রিল যেদিন ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। আমাদের ঝিলমিল পরিবারের সাথে তার ১১ বছরের অবিস্মরণীয় এক যাত্রা। প্রতিটি অনুষ্ঠানে তার কত স্মৃতি। যে স্মৃতি তার সাথে আমাদের বিচ্ছেদের যন্ত্রণার কথা মনে করে দেবে বারবার। 

****
১৪ মার্চ ২০১৯খ্রি. তার মহাপ্রস্থান। চিরতরে চোখের আড়াল হওয়ার দিন। চঞ্চল, প্রাণবন্ত, উদ্যমী, হাসি-খুশি একটি তরুণ কীভাবে এক নিমেষে হারিয়ে গেলো। ভাবতেই বুকের ভিতর খাঁ খাঁ করে ওঠে।

মৃত্যু আমাদের কত কাছে থাকে.......কত কাছে !

সে কি বুজতে পেরেছিলো যে ওর সময় ফুরিয়ে আসছে ! ২০১৯ সালের ১৪ আগস্ট উদয় ফেসবুকে নিজের একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছিলো ‘চোখের পলকে তুমি হতে পারো লাশ’। তার পরের মাসে ১৪ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগের দিন, যেদিন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে। সেদিন ছিল শুক্রবার। দুপুর ১২ টার দিকে তার ফেসবুক পোস্ট ‘আপন মন কে শান্ত করো, এরপর দেখবে আত্মা নিজেই নিজের সাথে কথা বলবে।’ এই পোস্ট দুটি যেন তার মৃত্যু ইঙ্গিত বহন করে। যা সে বুজতে পেরেছিল।-----তারপর ঠিকই নিজের মনকে শান্ত করে তার আত্মা নিজের সাথে নিজেই কথা বলতে চলে গেল।

ঘুরতে পছন্দ করতো, ছবি তোলার খুব আগ্রহ ছিল উদয়ের। যেখানে যার সাথেই দেখা হতো তার সাথেই ছবি তুলত। হয়ত জানতো সময় সংক্ষিপ্ত। তাই সবার সাথে তার স্মৃতি রেখে দিয়ে যাই। 

****
যে গ্রামে উদয় আছে, যে গ্রামে উদয় নেই।

নানা রকম গাছ-গাছালির ছায়া ঢাকা নীরব, নিস্তব্ধ, নির্মল এক পরিবেশ। পাখির কিচিরমিচির শব্দ ছাড়া সেখানে খুব সহজে অন্য কিছু কানে আসে না। টুকরো টুকরো ফসলি ক্ষেত, মাঝে মাঝে ছোট বড় কাঁচা-পাকা ঘর-বাড়ি। পাশে ছোট ছোট জলাশয়, যার মধ্যে ফুটে আছে রঙিন শাপলা-পদ্ম। এসব ঘর-বাড়ি, জলাশয় ক্ষেত গুলিকে ডানে বায়ে রেখে আঁকা বাঁকা পিচঢালা পথ চলে গেছে ঠিক উদয়ের কবরের পাশ দিয়ে। 

এতো সুন্দর তার নীলাখাদ গ্রাম। এই সুন্দর গ্রাম ফেলে কেনো এসেছিল এই ইট পাথর আর যন্ত্রের শহরে। যেখানে একটি হেলমেটের অভাবে চোখের পলকে কোন বাবা-মা হয়ে যায় সন্তানহারা। আদরের সন্তান হয়ে যায় পিতৃহারা। প্রিয়তমা বধূর পড়নে ওঠে বিষাদের সাদা শাড়ি। আড্ডামুখর বন্ধুগুলোর মুখে ভয়ের ছাপ, যন্ত্রণার চিহ্ন।

****
তোর সাথে আমার প্রায় ১২ বছরের পরিচয়। সুখ-দুঃখ, মান-অভিমান, হাঁসি-কান্নার একযুগ। বয়সে ছোট হয়েও তুই আমার ভাই, বন্ধু, সহকর্মী, সহযোদ্ধা ছিলি। তুই ছিলি আমার ছায়া। একসময় ছায়ার মত অনুসরণ করে অনেকটা পথ চলেছিস আমারই সাথে। তারপর এগিয়ে গিয়েছিল আমার চেয়েও বেশি। এতো অল্প সময়ে এতো স্মৃতি রেখে পরপারে পাড়ি দিলি। কি করে সেসব ভোলা যায়। তোর জন্য অনেক দোয়া। পরপারে ভালো থাকিস। আল্লাহ জেনো তোকে জান্নাত নসিব করেন, আমিন। জানি বেহেস্তেই থাকবি তুই, কারণ তোকে কখনো কারো ক্ষতি করতে দেখিনি।

****
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলোকিত তরুণ রেফাতুল ইসলাম উদয় (মোরশেদ)। সদা হাসি খুশি, সদা চঞ্চল, বন্ধু সুলভ, ঘুরতে ভালোবাসা, ভালো কিছু করতে সদা সচেষ্ট এক যুবক।

২০০৮ সালে শিশু সংগঠন ঝিলমিল প্রতিষ্ঠার আগে থেকে ওর সাথে আমার পরিচয়। ঝিলমিল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আমার সাথে সম্পৃক্ত। আমার সাথেই ঝিলমিলের পাশাপাশি যুব রেড ক্রিসেন্ট ও স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে কাজ করেছে। আমার সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাবেক মেয়র মো. হেলাল উদ্দিন স্যারের সহকারী হিসেবেও কাজ করেছে সে। 

***
শিশু সংগঠন ঝিলমিল এর প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে এই সংগঠনের সদস্য, সম্পাদক, পরিচালক ও নাট্যকর্মী হিসেবে কাজ করেছে। দৈনিক দিন দর্পণ, দৈনিক পেন ব্রিজ, চ্যানেল ২৪ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ক্যামেরা পারসনসহ স্থানীয় কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে কাজ করেছে সে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া যুব রেড ক্রিসেন্টের সক্রিয় সদস্য ছিল। ছিল ন্যাশনাল চিলড্রেন ট্রাস্কফোর্স (এন.সি.টি.এফ)-এর জেলা কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য। এক সময় কাজ করেছে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মী হিসেবে।

***
উদয় লেখাপড়া করেছে নিয়াজ মোহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া আইডিয়েল হাই একাডেমি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যম, একটি হাসপাতাল ও উন্মুক্ত কোম্পানিতে কাজ করত।

পাশা পাশি চলা, এক সাথে কাজ করার হাজারো স্মৃতি রেখে এই ভাইটি আমার গতকাল (১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ইং) না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছে। মোটরসাইকেল এক্সিন্ডেন্টে মৃত্যুর সাথে প্রায় ২৬ ঘণ্টা পাঞ্জা লড়ে। কি সান্ত্বনা দিব নিজেকে, কি সান্ত্বনা দিব ওর বাবা-মা ভাইদেরকে। কার সাধ্য আছে ওর স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেওয়ার। উদয়ের চার বছরের আদরের ছোট ছেলে, যে কিনা এখনো বোজে না বাবা হারানোর বেদনা তাকে কী বলব, তাকে কি বলা যায় !।

****
গত শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ খ্রি.) ব্রাহ্মণবাড়িয়া বড় মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়েছিলো সদা হাস্যোজ্জ্বল উদীয়মান যুবক রেফাতুল ইসলাম উদয়। আজ (২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯খ্রি.) শুক্রবার আমরা জুম্মার নামাজ পরলাম ওর নিজ গ্রাম আখাউড়ার উপজেলার মোগড়া নীলাখাদ গ্রামের মসজিদে। যেখানে উদয় থেকেও ছিল না উদয়।

****
উদয়টাকে ভুলতে পারি না। খুব কাছের কেউ না ফেরার দেশে চলে গেছে মানতে পারি না। কীভাবে কি হলো তাও বুজতে পারি না। মৃত্যু সত্যিই আমাদের খুব কাছে থাকে।

***
আজ মরহুম উদয়ের রুহের মাগফেরাত কামনায় কবর জেয়ারত ও দোয়ার আয়োজন করেছিলো উদয়ের পরিবার। জুম্মার নামাজ শেষে মসজিদের ইমাম, মুসল্লি ও আত্মীয়দের সাথে উদয়ের কবর জেয়ারত ও দোয়ায় যোগ দিয়েছিলাম আমরা। ফেরার পথে উদয়ের ছেলেকে নিয়ে এই ছবিটি তোলা। এই ছবিটি হয়ত ভবিষ্যতে আমাদের উদয়ের কথা মনে করিয়ে দিবে। দিবে অন্য কোনো দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে থাকার সতর্কবার্তা।

অনন্তকাল শান্তিতে থাকুক তোমার আত্মা চির সুখের উদ্যানে। তোমার সন্তান হোক তোমার চেয়েও বেশি জ্যোর্তিময় ।

****
উদয়ের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে সকলের কাছে দোয়া চাই। মহান আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করেন। ওর সকল আত্মীয় স্বজনের জন্য দোয়া করবেন। ওর বাচ্চাটার জন্য দোয়া করবেন। আমিন।

(এই লেখাগুলি উদয়ের মৃত্যুর পর খণ্ড খণ্ড ভাবে আগেও পোস্ট করেছিলাম। হয়ত সারা জীবনই করে যাবো।)

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২খ্রি.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ