১০-১২ বছর বয়সে বাবার হাত ধরে পৈতৃক পেশায় এসেছিলেন লিটন রবি দাস। মানুষের ছেঁড়া জুতা সেলাই করে সংসার চালাতেন লিটন দাসের প্রয়াত পিতা জীবন রবি দাস। জেলা শহরের ব্যস্ততম রাস্তার পাশে নিজের বাক্স-পেটরা সাজিয়ে বসতেন তিনি। মানুষের জুতো সেলাই করে কাটিয়ে দিয়েছেন প্রায় ৭০ বছর। মৃত্যু বরণ করেছেন ৯৩ বছর বয়ছে। জীবন দাসের সংসারে ছিল পাঁচ ছেলে-মেয়ে। একদিন ১০/১২ বছর বয়সি বড় ছেলে লিটনকে নিয়ে বাপ-দাদার পৈতৃক পেশায় সংযুক্ত করে জীবন দাস।
সেসব তো প্রায় ৪০ বছর আগের কথা। তখন একপাটি জুতা সেলাইয়ের মজুরি ছিল মাত্র এক টাকা/দুই টাকা। সে-সময় জুতা সেলাই করে দৈনিক ১৪-১৫ টাকা আয় হতো। আর তা দিয়েই কোনো রকমের সংসার চালিয়ে নেয়া যেত। বাবার হাত ধরে মুচি পেশায় আসা লিটন দাসের ৪০ বছর পরে সেই আয় দাঁড়িয়েছে দৈনিক ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। কিন্তু তার চার সদস্যের সংসারতো আর আগের মতো চালানো যাচ্ছে না। নিজের ভাষায় লিটন বলেন- ‘এহন জিনিসপত্রের ম্যালা দাম। বাফে ১৪/১৫ টাকা রুজি কইরাও ছয়জনের সংসার চালাইছে। আর আমি অহন ডেলি ৪০০/৫০০ টাকা রুজি কইরাও চার জনের সংসার চালাইতে পারতাছি না।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের মধ্যপাড়া নিবাসী লিটন দাস। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। অভাব অনটনে নিজে বেশি দূর লেখাপড়া করতে না পারলেও তার নিজের ছেলে-মেয়েকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে চান। তাই দারিদ্রতার শত কষ্টেও ছেলেমেয়েদেরকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। বড় ছেলে এখন স্থানীয় একটি কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র। মেয়ে অন্য একটি স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী।
সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে জেলা শহরের পুরাতন মুহুরি ঘরের সাথের সিঁড়ির মতো যে সামান্য জায়গা তার উপর তার ছোট্ট দোকান। পাশে দিয়ে বয়ে গেছে জেলা শহরের ব্যস্ততম সড়ক টি.এ রোড। একপাশে পুবালি ব্যাংক ও মসজিদ রোড। অন্য পাশে কিছু ফলের ও ফটোকপির দোকান। রাস্তার বিপরীত পাশে পৌর আধুনিক সুপার মার্কেট, পৌরসভার পুকুর, মুক্তমঞ্চ, মঠের গোড়াসহ আরো কিছু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। আছে নানা ধরনের বিপণি বিতান। বেশ ব্যস্ততম রাস্তা। সারাদিন হাজার হাজার গাড়িতে হাজার হাজার লোক চলাচল করে। তার পাশেই বসে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ৮টা ৯টা পর্যন্ত নিজের এই ছোট্ট দোকানে কাজ করে লিটন দাস। তার শরীরের উপর দিয়ে বয়ে যায় রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-বাতাস।
কথা বলতে বলতে লিটন আরো বলেন- শহরের রাস্তায় তখন এখনকার মতো এত গাড়িঘোড়াও চলতো না। এত মানুষ আসতো না। চারিদিকে এখন মানুষ বেড়েছে, এত এত পা বেড়েছে। কিন্তু সেই অর্থে বাড়েনি জুতো। মানুষের হাতে এখন অনেক টাকা। তাই ছেঁড়া জুতা পরে না অনেকেই। আগের দিনের মানুষ একজোড়া জুতা অনেকদিন পরতো। সেই জুতো ছিঁড়ে গেলে বারবার সেলাই করতে হতো। ফলে তাদেরও (মুচিদের) আয়ও ছিল ভালো। কিন্তু এখন মানুষ জুতো একটু পুরোনো হলেই আবার নতুন জুতো কিনে ফেলে। ফলে মানুষ বাড়লেও সেলাই করার মতো জুতো বাড়েনি লিটন রবি দাসের মতো শহরের আরো অনেক মুচির জীবনে।
এখন মানুষ চলাচল করে গাড়িতে। আগের মতো পায়ে হেঁটে চলাচল কম করে বিধায় হুট করে কেউ গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত সেলাই বা পালিশ করতে আসে না। তার ওপর ফুটপাতে বসার কারণে নানা সময় পুলিশ ও পৌর কর্মীদের দৌঁড়ানি খেতে হয়। বাক্স-পেটরা নিয়েও পালিয়ে গেলেও পেটের দায়ে আবার ফিরতে হয় সে আগের জায়গায়। লিটন বলেন- সারা দেশেই তো মুচিরা রাস্তার উপর বসেই জুতা সেলাই করে। মুচিদের জন্য তো নির্ধারিত কোনো জায়গা থাকে না। মুচিরা যদি জায়গা কেনার টাকাই পায় তাহলে তারা কি আর এই পেশায় থাকতো। রাস্তায়র পাশে দোকান বসানোর কারণে কিছুদিন আগেও তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। পরে নানাভাবে কায়দা কসরত করে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হয়েছে। একদিকে আয় বন্ধ। অন্যদিকে বেশকিছু টাকা ধারদেনা করতে হয়েছে।
দুঃখ প্রকাশ করে লিটন দাস বলেন- একদিনের আয় বন্ধ হলে সেদিন সংসারে প্রয়োজনীয় বাজার করা হয় না। ছেলে মেয়েদের খাতা, কলম বা পরীক্ষার ফি দেওয়া যায় না। তাদের পৈতৃক সূত্রে পাওয়া একখণ্ড জায়গা নিয়ে মামলা চলছিল দীর্ঘদিন। ১৫/১৬ বছর মামলা চললেও জায়গা নিয়ে তাদের কোনো গতি না হওয়ায় শহরের মধ্যপাড়ায় ভাড়া বাসায় ছিল এতদিন। কিন্তু আয় কমে যাওয়ায় একটু কম টাকা বাড়িভাড়া পাওয়া যায় বলে বর্তমানে শহরের মারকাজ পাড়ায় ভাড়া থাকেন। কিন্তু সেই ভারাও নিয়মিত পরিশোধ করতে পারে না তিনি। জুতা সেলাই করার জন্য যে সমস্ত জিনিসপত্র দরকার হয় সেসব জিনিসের সস্তায় পাওয়া যায় না। অনেক সময় চামড়াসহ অন্যান্য কাঁচামাল ঠিকমতো পাওয়া যায় না।ফলে এই পেশায় এখন টিকে থাকাই মুশকিল হয়েছে তার।
আক্ষেপ নিয়ে লিটন বলেন- “কত সরহার আইলোা-গেল, কত মন্ত্রী-এমপি, মেম্বার-চেয়ারম্যান দেখলাম। আমরার লাইগাতো তো কেউ কিছু করলো না। তারা যদি আমরার বসার লাইগ্যা শহরের কোনহানে জায়গা নির্দিষ্ট কইরা দিতো দিত। কিংবা আমরার জইন্য এককালীন বা মাসিক ভাতার (অনুদানের) ব্যবস্থা করত। তাইলে আমরার জীবনডা একটু অইলেও আরো উন্নত হইতো। আমরাও তো মানুষ। এই ড্যাশেরই মানুষ। আমরাওতো ভোট দেই, টেক্স দেই- কিন্তু আমরার কথা ভাবে ক্যারা, আর কইবই বা ক্যারা?
====
পা বেড়েছে- জুতা বাড়েনি : বাড়েনি মুচিদের জীবনমান
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
২৪ সেপ্টেম্বর ২৫
সকাল ৯টা ১০
0 মন্তব্যসমূহ