Ticker

6/recent/ticker-posts

সিগারেট শুধু একটি সামান্য খাবার নয়, এটি নেশার প্রথম টান

গত এসএসসি পরীক্ষা চলাকালীন ঘটনা। দুপুর একটার দিকে বাসায় রান্নার প্রয়োজনীয় কিছু মালামাল কেনার জন্য এক দোকানে গেলাম। দোকানে গিয়ে আমার প্রয়োজনীয় মালামালের কথা বলতেই হন্তদন্ত হয়ে এসে কয়েকটি কিশোর দোকানির কাছে সিগারেট চাইলো। তাদের বলার ভঙ্গি এবং ভাবসাব এমন যে আগে আসলেও দোকান দ্বার আমার মালামাল না দিয়ে তাদের সিগারেট আগে দিয়ে দিল। আমি কিছু মনে করলাম না— কারণ পরিস্থিতির ডিমান্ড ছিল এটাই।

সাধারণত কোনো দোকানে কিছু কিনতে গেলে যে দোকান ফাঁকা থাকে বা কাস্টমার কম থাকে সেই দোকানে ঢুকি। যদিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে দোকানে ঢোকার পরে অতিরিক্ত কাস্টমার এসে আমার কেনাকাটায় ডিস্টার্ব করে। সেদিনও তাই ঘটলো। কিন্তু একবার নয় বা একজন দুজন নয়, এক দলের পর আরেক দল, এভাবে কয়েক দল। তারা প্রত্যেকেই ছিল পরীক্ষার্থী। তাদের গায়ে ছিল স্কুলের পোষাক, হাতে পরীক্ষার সরঞ্জাম। (সংগত কারণেই স্কুলের নাম উল্লেখ করলাম না) তারা সিগারেট নিতে নিতে দোকানে আরো কিছু নিয়মিত কাস্টমার জমে গেলে।

আমাদের সময় এবং আমাদের আগের বড়ো-ভাইদের বোনদের দেখেছি পরীক্ষার হল থেকে বের হয়েই একে অপরের সাথে আলাপ করতো কে কতটি পরীক্ষার উত্তর দিতে পেরেছে, কে কোনটি দিয়েছে, কত নাম্বার পাবে- এই সব নিয়ে। যাদের পরীক্ষা খারাপ হতো তাদের মুখ দেখেই বোঝা যেত।

আর এই তরুণদেরকে দেখলাম পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে সোজা সিগারেট কিনতে এসেছে। পরীক্ষা নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো আলোচনা নেই। নেই আনন্দ বা হতাশার চিহ্ন। মাত্র তিন ঘণ্টা সময় সিগারেট না খেতে পারায় এদের আচরণে যে বেপরোয়া ভাব- তাতে স্পষ্টই বোঝা যায় সিগারেট খাওয়াটা শুধু এদের কৌতূহল নয় বরং মারাত্মক বদঅভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

বিরক্তির সীমা ছাড়িয়ে গেল তখন- যখন দেখলাম তারা দোকানের সামনের ঝুলে থাকা লাইটার নিয়ে সেখানেই আগুন জ্বলিয়ে আশেপাশে থাকা সিনিয়রদের সামনেই সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে লাগলো। কিন্তু আমরা তাদের কিছুই বললাম না। কেননা এই বেয়াদব প্রজন্মের সাথে কথা বলা মানেই ঝগড়ায় জড়ানো, হাতাহাতি করা কিংবা তর্ক করে নিজের মানসম্মান খুইয়ে ফেলা।

টেংকের পাড় এরিয়াতে এই চিত্র নিত্য দিনের ঘটনা। টেংকের পাড়ের আশেপাশে আছে ১০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দুটি মসজিদ, কয়েকটি মাদ্রাসা এবং ২০টির অধিক হাসপাতাল। এসব ছাড়াও পার্ক এরিয়া হওয়ায় শহরের নানা স্থান থেকে এখানে নানা বয়সের লোকজন অবসর কাটাতে বা ব্যায়াম করতে আসেন।
বাবা-চাচার বয়সি মুরুব্বিরা মসজিদে আসেন, পুকুর ঘাটলায় বসে আড্ডা দেন। বিভিন্ন টিমের খেলোয়াড় মাঠে খেলাধুলা করে। অনেকে পুকুরে গোসল করে। নাদুসনুদুস শরীর দোলাতে দালাতে হাঁটাহাঁটি করে সদস্য হাঁটা শেখা শিশুরা। দেখতে ভালোই লাগে। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের এই সিগারেট খোর, বখাটে এবং কিশোর গ্যাং টাইপের ছেলেদের দৌরাত্ম্য দেখে অভ্যস্ত-বিরক্ত।

এই অবুঝ কিংবা বখাটেরা মাঝে মাঝেতো নিজেরা নিজেরাই ঝগড়াই লিপ্ত হয়। লাঠি-সোঁটা নিয়ে একের ওপর একে অপরের উপর থামলে পড়ে। শিশু, বৃদ্ধ, নারী কিংবা অসুস্থ রোগী কারো কোনো পরোয়া না করে তাদের সামনেই সিগারেট খেতে থাকে। একে অপরের সাথে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলে। একটু একা পেলেই স্কুলগামী মেয়েদের টিজ করে। আশেপাশে যারা স্থানীয় এবং সিনিয়ররা রয়েছেন তারা মাঝে মাঝে এদের প্রতিরোধ করে কিন্তু বেশিরভাগ সময় করেন না- ঝামেলা এড়ানোর জন্য।

ট্যাংকের পাড় এরিয়াতে প্রত্যেকটি দোকানের সিগারেট বিক্রয় একটি লাভজনক ব্যাবসা। বড়রাতো খায়ই— ছোটোদের কাছেও তা মহা পছন্দের খাবার। প্রত্যেক দোকানেই নিয়মিত কেনাকাটার সঁদাই যারা করেন তারা সবাই সিগারেট খোরদের বিড়ম্বনায় শিকার হন। সিগারেট কিনতে গেলে দোকানে দাঁড়িয়ে মানুষকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য নেওয়ার সুযোগ দিতে নারাজ। কেমন যেন একটা তাড়ার মধ্যে থাকে। মনে হয় এক্ষুনি সিগারেট খেতে না পালে তারা মারা যাবে। তাই শিশু, নারী, বৃদ্ধ কিংবা অসুস্থ রোগীর স্বজনদের প্রয়োজনীয় মালামাল আগে কেনার সুযোগ দিতে চান না। আবার অনেকে সিগারেট কিনে মানুষের সামনেই ধোঁয়া ছাড়ে।

খায় সোনার মাথা! কিন্তু ভাব সাব দেখায় যেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ দামি একটি খাবার খাচ্ছে। আর কিশোর তরুণদের সিগারেট খাওয়ার ভাব দেখলে তো মনে হয় এটি খাওয়া তাদের নৈতিক অধিকার। বাপের পকেট, মায়ের পার্স থেকে চুরি করে আনা টাকা কিংবা টিফিন-পরীক্ষার ফিশ বাঁচিয়ে সিগারেট খায় কিন্তু ওদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয় জমিদারের পুত জমিদার! নিজে টাকা আয় করে- সেই টাকায় সিগারেট খাচ্ছে।

এই ছেলেগুলো আর কেউ নয়, আপনার আমার ছেলে। কিছু ছেলে আছে ছাপরি টাইপের। বাবা-মায় খোদানো কিংবা বন্ধনহীন পরিবারের ছেলে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য ছেলে ভদ্র ঘরের সন্তান। আমার পরিচিত অনেক ভাইদের ছেলেদের দেখেছি এই সিগারেট খোরদের দলে। তারা লজ্জা পাবেন বলে তাদের কখনো জানানো হয়নি যে আপনার ছেলেকে দেখেছি বখাটেদের দলে।

বাংলাদেশে একটি আইন আছে- প্রকাশ্য ধূমপান করা যাবে না। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫ এর ৪ ধারার ১ উপধারায় স্পষ্টভাবে বলা আছে, কোনো ব্যক্তি কোনো পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপান করতে পারবেন না। এই আইন প্রথমবার ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা জরিমানার বিধান আছে। আবার দ্বিতীয়বার বা বারবার একই অপরাধ করলে দ্বিগুণ জরিমানা হবে।

এই আইনটি এখন কার্যকর আছে কিনা জানি না। না থাকলে অতিদ্রুত তা কার্যকর করা উচিত। থাকলে তার সঠিক প্রয়োগ করা উচিত। প্রকাশ্যে ধূমপান করলে জরিমানার টাকা ৫০০০ টাকা করা উচিত। শিশুদের কাছে সিগারেট বিক্রয় না করতে দোকানীদের উৎসাহ দেওয়া উচিত। যেহেতু একবারে তা বন্ধ করা যাবে না তাই প্রকাশ্যে সিগারেট না খেতে সচেতনতা বাড়ানো উচিত।

কারণ আমরা সবাই জানি- সিগারেট শুধু একটি সামান্য খাবার নয়, এটি নেশার প্রথম টান- যা আমাদের তরুণ প্রজন্মের জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। আজ সৌদি আরব চমৎকার একটি ঘোষণা দিয়েছে। তারা মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমানে সিগারেট বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশেও এমন আইন করা উচিত।

আসুন নিজেদের সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে আমরাও উপরিউক্ত দাবিগুলোতে সম্মিলিত আওয়াজ তুলি।

------
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
১৪ অক্টোবর ২৫

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ