Ticker

6/recent/ticker-posts

রম্যগল্প : মশারি

প্রচণ্ড পেট ব্যথা নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলাম। ডাক্তার সাহেব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা। মনে মনে যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই হলো। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো দিনক্ষণ ঠিক করে একদিন ঢুকে গেলাম অপারেশন থিয়েটারে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেই অপারেশন কক্ষে ডাক্তারের গ্রাউন পড়ে প্রবেশ করলেন দেশের জনপ্রিয় হার্টথ্রব নায়ক বায়েদ খান। তাকে দেখেই আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলাম। দেশের রূপালী পর্দার এতো বড় এক নায়ক; অভিনয় পেশার পাশাপাশি তিনি যে ডাক্তারিও করতেন তা আমার জানা ছিল না। এই নায়ক কাম ডাক্তারের হাতে আমার অপারেশন হবে ভেবে আমি বেশ খুশি হলাম। আমার মতন এমন সৌভাগ্যবান রোগী আর কয়জনই বা হতে পারে।


যথারীতি অপারেশন সম্পন্ন হল। অভিনয় দক্ষতার সাথে তার সার্জারির দক্ষতাও অসাধারণ। কয়েকটি দিন হাসপাতালে থাকার পর হাসপাতাল ছাড়ার আগে ডিউটি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, বায়েদ খান স্যার কি চলে গেছেন? আমি কী তার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি ? ডিউটি ডাক্তার বললেন- তাকে কি বলতে চান। আমি বললাম- না, তেমন কিছু না। আসলে তিনি যে কখনো ডাক্তারি পড়েছেন তা আমার জানা ছিল না। তাই একটু আলাপ করতে চাইলাম আর কি। ডিউটি ডাক্তার আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন- তিনিতো ডাক্তার নন। তিনি নায়কই। শখের বসে তিনি মাঝে মাঝে অপারেশনও করেন। রোগীরা সেলিব্রেটিদের দিয়ে চিকিৎসা করাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আমি অবাক হলাম- বাহ দারুণ তো, শখ হলেই, ইচ্ছে হলেই এ দেশে যে কেউ যে কোনো পেশায় সংযুক্ত হতে পারে, ব্যাপারটাতো মন্দ না।

হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে এলাম। বেশ কিছুদিন বিছানা-বিশ্রামে ছিলাম। সুস্থ হয়ে একদিন বাজারে গেলাম। অসুস্থতার জন্য কতদিন বাজার করি না ! দেশের সব অনলাইন সেলিব্রিটিরা একেকজন একেক দোকানে বসে ব্যবসা পরিচালনা করছে। টিকটক, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ছেড়ে সবাই হঠাৎ মাছ ব্যবসায়ী, সবজি ব্যবসায়ী, মুদি দোকানদারি করতে আসলো কেন ? কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করাতে তারা জানালো- তাদের ভিউ বাড়ানোর জন্য, লাইক, সাবস্ক্রাইব বাড়ানোর জন্য। দোকানে বসে এটা কীভাবে সম্ভব ? আমি আবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম- তারা জানালো সবার হাতে হাতে মোবাইল; সবাই রিলস বা টিকটক ভিডিও দেখে কিন্তু লাইক, কমেন্ট বা সাবস্ক্রাইব করে না। পরবর্তী ভিডিও দেখতে চলে যায়। ফলে অনেকেই ভিউ পেলেও লাইক বা সাবস্ক্রাইব পায় না। এই ভাবে তারা পর্যাপ্ত আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

এই সমস্যার সমাধানের জন্য অনলাইন সেলিব্রেটিরা এখন দেশের বিভিন্ন হাটবাজারে, দোকানদারি করতে বসেছে। এতে তিনটা সুবিধা, একদিকে দোকান মালিকদের আয় বেড়েছে অন্যদিকে আগত কাস্টমাররা তাদের পছন্দের সেলিব্রেটির দোকান থেকে নানা ধরনের সদাই পাতি ক্রয় করার পাশাপাশি তাদের সাথে সেলফি তোলার সুযোগ পাচ্ছে। কেউ কেউ বানিয়ে নিচ্ছে নতুন নতুন রিলস বা টিকটক। আর এই ফাঁকে সেলিব্রেটিরা গ্রাহকদের কাছ থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে বা তাদেরকে বলে সরাসরি হাতে হাতে লাইক এবং সাবস্ক্রাইব বাড়িয়ে নিচ্ছে। ছোট ছোট হাট-বাজার এবং মুদির দোকানে পাড়া-মহল্লার গ্রাম গঞ্জের উত্তি সেলিব্রেটিরা অবস্থান নিলেও বড় বড় সেলিব্রিটিরা এখন বড় বড় শপিংমল এবং বিপণী বিতানে অবস্থান নিয়েছে। এটাই এখন ট্রেন্ড। আমি বললাম- বাহ্ বিষয়টা মন্দ না ! এ দেশে কখনযে কোন ট্রেন্ড চালু হয় তা বলা যায় না।

পরদিন সকালে মেয়েকে নিয়ে গেলাম স্কুলে। পরিচিত টিচারদের কাউকে সেখানে দেখতে না পেয়ে একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম- ভাই স্কুলের সব শিক্ষক-শিক্ষিকারা কি চলে গেছেন। তার বদলে নতুনরা শিক্ষকরা এসেছেন ? তিনি জানালেন- জি হ্যাঁ; পুরাতন শিক্ষক-শিক্ষিকারা চলে গেছেন এবং তাদের বদলে নতুনরা এসেছেন, কিন্তু তারা কেউ আসল শিক্ষক-শিক্ষিকা নন। তাহলে তারা কারা- আমি জিজ্ঞেস করলাম। সেই ভদ্রলোকটি জানালেন- তারা আসলে বিভিন্ন যানবাহনের ড্রাইভার এবং হেল্পার। আমি অবাক হলাম, ড্রাইভার হেলপাররা এখন পাঠদান করবেন ? বিষয়টি কি ঠিক হচ্ছে ? তিনি জানালেন- কেন নয়- তারা সবাই বাস্তবমুখী জ্ঞান দিতে সক্ষম। কেননা ভাঙ্গা রাস্তায় লাইসেন্সবিহীন পুরাতন যানবাহন নিয়ে গাড়ি চালানোর চ্যালেঞ্জিং পেশা যারা পরিচালনা করতে পারে, অতিরিক্ত মালামাল লোড নিতে পারে, ওভারটেক করতে পারে, পাবলিক রোডে কার রেইস করতে পারে, তবে শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী করে গড়ে তোলায় তারা কেন পাঠদান করতে পারবে না। তাছাড়াও নানা শ্রেণি পেশার মানুষ সঙ্গে কথা বলতে বলতে এরা এতটাই দক্ষ যে, আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে যেকোনো পরিস্থিতিতে যে কোনো মানুষের সাথে কথা বলা বা খাপ খাইয়ে নেওয়া শেখাতে পারবে। শিক্ষার্থীদের বাস্তবসম্মত জ্ঞানদানে শিক্ষা পদ্ধতির এই পরিবর্তনে আমি যারপরনাই খুশি হয়ে বললাম- বাহ্ ভালোই তো, বিষয়টা মন্দ না। তা ভাই স্কুলের শিক্ষকরা এখন কোথায় আছেন ? তিনি উত্তরে বললেন- জানি না।

শিক্ষক-শিক্ষিকারা পাঠদান ছেড়ে এখন কোথায় আছে ? তা জানতে খুব ইচ্ছা হলো। বাইরে বেড়িয়ে খোঁজখবর করতে শুরু করলাম। অনেক খোঁজা খুজির পর শুনলাম শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনেকেই এখন হাল চাষ, মাছ চাষসহ নানান চাষাবাদে সম্পৃক্ত হয়েছেন। বই-পুস্তক পড়ে তারা কৃষিকাজ সম্পর্কে যে সমস্ত জ্ঞান অর্জন করেছেন সেই সমস্ত জ্ঞানই এখন সরাসরি মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ করবেন। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও অনেক বেশি সমৃদ্ধ হবে। ভেবে দেখলাম- বিষয়টা মন্দ না, কৃষি প্রধান দেশে আরও বেশি ফলন হবে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে। বিষয়টাতো মন্দ না, একদম মন্দ না।

এসব ভাবতে ভাবতেই রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। এসময় দেখলাম বিরাট এক মিছিল আসতেছে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মিছিল দেখা আমার ছোটবেলার শখ, তা যে দলেরই হোক। তাই রাস্তার এক কোনায় দাঁড়িয়ে মিছিল দেখতে দেখলাম। নানা ধরনের ব্যানার, প্লেকার্ড নিয়ে এক প্রতিবাদী মিছিল এগিয়ে যাচ্ছে রাস্তার এক প্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম- এতদিন মিছিলে যে ধরনের ব্যক্তিদের চেহারা দেখে আমরা অভ্যস্ত, এই মিছিলের সবাইকে একটু অন্যরকম মনে হলো। মিছিলে থাকা একজনকে ডাক দিতেই তিনি মিছিল ছেড়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমি বললাম- ভাই আপনারা কোন দল, কি নিয়ে মিছিল করছেন।

তারা জানালেন- বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পদ্ধতি মোটেই ভালো না, আমরা এই পদ্ধতির পরিবর্তন চাই। সরকারের পরিবর্তন চাই। আমাদের সরকার গঠিত হলে, দেশের যত ধরনের সমস্যা আছে, সব সমস্যার সমাধান হবে। আমি বললাম ভালো কথা বলেছেন, কিন্তু আপনাদেরকে আগেতো কখনো মিছিল করতে দেখি নাই, আপনারা কারা, কোথায় থেকে এসেছেন। সে বলল- চিনবেন কীভাবে, আমরাতো আগে আগে খেতে খামারে চাষাবাদ করতাম, খালে বিলে মাছ চাষ ধরতাম। আমরা এখন রাজনীতিতে যোগ দিয়েছি। হঠাৎ আমার মনে পড়ল আরে হ্যাঁ, সব শিক্ষক-শিক্ষিকারাতো চাষাবাদে নেমেছে, তাই তাদের এখন কোনো কাজ কর্ম নাই। কথায় বলে অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। কিছু একটা কাজতো করা দরকার তাই, এখন কৃষক-জেলেরা নেমে পড়েছে রাজনীতিতে। রাজনীতিতে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হচ্ছে, এটি একটি দেশের জন্য ভালো দিক, বিষয়টা মন্দ না, মোটেই মন্দ না !

মিছিল শেষ হলে আমি হাঁটতে হাঁটতে গেলাম দেশের সংসদ ভবনের দিকে। শুনলাম সংসদে তখন অধিবেশন চলছে। সংসদে দর্শনার্থীদের জন্য সিট বরাদ্দ আছে। টিভিতে সংসদ অধিবেশন দেখার পাশাপাশি এখন সরাসরি সংসদে বসে সাংসদের কার্যকলাপ দেখা যায়। সিকিউরিটির কাছে নিজের পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন হলো না। কারণ আমার গলায় তখন ৬/৭ পত্রিকার আইডি কার্ড ঝুলছে। সিকিউরিটি গার্ড আমাকে দেখেই রাস্তা ছেড়ে দিলো। আমি ঢুকে গেলাম সংসদে। অধিবেশন তখন তুঙ্গে চলছে। কী বিষয় নিয়ে সবার মধ্যে ভীষণ মতানৈক্য দেখা দিয়েছে তাই নিয়ে খুব হৈচৈ হচ্ছে।

আমি পুরো সংসদের দিকে চোখ বুলিয়ে বেশ অবাক হলাম। সংসদ সদস্য হিসেবে যাদের দেখলাম তারা বাংলাদেশের নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। নানা ধর্মের মানুষ। ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, খেলোয়াড়, কবি, শিল্পী, নায়ক, গায়ক, জেলে, মাঝি, তাঁতি, ড্রাইভার, হেলপার, নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে, শিশু, বৃদ্ধা, হিজরা সবাই সংসদে নিজ নিজ শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছে। এইরকম একটি সার্বজনীন সংসদ দেখে বুকটা আমার আনন্দে ভরে উঠলো, এমন একটা বৈষম্যহীন সংসদইতো আমরা চেয়েছিলাম। কিন্তু খারাপ লাগলো এই ভেবে যে- এতজন সংসদ সদস্যের মধ্যে একজনও প্রকৃত রাজনীতিবিদ ছিল না।

কিছুটা ভালো লাগা আর কিছুটা মন খারাপ নিয়ে অধিবেশন শেষ হলে সংসদ থেকে বের হয়ে আসলাম। মন উসখুস করছিলো দেশের রাজনীতিবিদ সবাই কোথায় আছে তা জানার জন্য। সংসদ ভবন থেকে বের হয়ে মাঠের এক কোনায় বসে পকেট থেকে স্মার্টফোন বের করলাম। ওমা একটার পর একটা রিলস ভিডিও আসছে, টিকটক ভিডিও আসছে । হাসির, ফাজলামোর, উপদেশ মূলক, ওয়াজ-নসিহত, বেসুরো গলার গান, অদ্ভুত দু:খের, সুখের ,কান্নার, শিক্ষামূলক এমনকি অশ্লীল কথা বার্তার ভিডিও আসছে। আর এইসব ভিডিও বানাচ্ছে দেশের পরিচিত সব রাজনীতিবিদরা।

বড় নেতা, ছোট নেতা, পাতি নেতা, উট্টা নেতা, মুইত্তা নেতা, অৎকা নেতা- সব নেতারা এখন ফেসবুক সেলেব্রিটি হয়ে গেছে। তারা সবাই এখন সোশ্যাল সেলিব্রিটি হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আসলে রাজনীতিবিদরা ভেবেছে রাজনীতির গ্যারান্টি নাই। লাইফ সিকিউরিটি নাই। ৫-১০ বছর ক্ষমতা থেকে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করলেও পরবর্তী জীবন কাটাতে হয় হয়তো জেলে, নয়তো পালিয়ে পালিয়ে। আর নইলে রাজপথে পুলিশের প্যাঁদানি খেয়ে। তারচেয়ে ভালো সোশ্যাল সেলিব্রেটি হওয়া। নাম ডাক পাওয়া যায়, টাকা পয়সা পাওয়া যায়, জীবনেরও নিরাপত্তাও মোটামুটি নিশ্চিত। আমি ভাবলাম- বিষয়টা মন্দ না। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, চুরি, বাটপাড়ি, মিথ্যা বলা, জনগণকে মিথ্যা আশ্বাস দেয়া, ব্যাংক-শেয়ার বাজারসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুট করার চেয়ে রাজনীতিবিদরা এসব ছেড়ে দিয়ে এখন সোশ্যাল সেলিব্রিটি হওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত আছে। বিষয়টা মোটেও মন্দ না বরং দেশের জন্য নিঃসন্দেহে ভালো কাজ।

দেশের এই পরিবর্তন দেখে হঠাৎ আমার মনে হল পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ঠিক কী কী ধরনের পরিবর্তন হয়েছে, তা সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করা দরকার। যেই ভাবা সেই কাজ, হুট করে চলে এলাম এয়ারপোর্টে। কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে নিয়ে ঢুকে গেলাম বিমানে। গন্তব্য আমেরিকা। সিটে বসে দেখলাম ফ্লাইট পরিপূর্ণ হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমান টেক-অফ করবে। একটু পরেই ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট মাইকে ঘোষণা দিলেন- সম্মানিত যাত্রী সাধারণগণ- আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বাংলাদেশ বিমানের এই স্পেশাল এয়ারবাস আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে। আপনারা আপনাদের নিজ নিজ সিটবেল্ট বেঁধে নিন। যারা সিটবেল্ট বাঁধতে পারবেন না, আমাদের সহকর্মীরা আপনাদের সহযোগিতা করবেন।

আমি আমার বেল্ট বাঁধতে যাব, ঠিক তখনই মাইকে আবার ঘোষণা হল- আজকে আমাদের এই উড়োজাহাজের পাইলট হিসেবে রয়েছেন দেশের বিশিষ্ট অভিনেতা, কাম রাজনীতিবিদ, কাম সোশ্যাল সেলিব্রেটি হিরো জালম। তিনি এখন আপনাদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলবেন। হিরো জালমের নাম শুনে কিছুটা কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম, ব্যাটা বিমান ঠিকঠাক মতো চালাতে পারবে তো ! উড়োজাহাজ আবার ক্রাশ করবে নাতো !

টেনশনের মধ্যেই হিরো জালম মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে তার মধুর সুরে বলতে লাগলেন- সম্মানিত যাত্রী সাধারণ, সবাইকে আমার সালাম এবং আদাব ও নমস্কার রইল। আমি আপনাদের প্রিয় অভিনেতা ও রাজনীতিবীদ হিরো জালম। আমার বহুদিন থেকে ইচ্ছা ছিল আমি একদিন পাইলট হব। আপনারা জানেন আমি জীবনে অনেক কিছু হয়েছি, অনেক কিছ করেছি কিন্তু কখনো পাইলট হইনি। অবশেষে আজকে আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। আমি আমি আজ আমি আপনাদেরকে ফ্লাইট নাম্বার বি.জি-৪২০ নিয়ে আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করব।

হিরো জালম আরো বলল- সম্মানিত যাত্রীগণ আজকের এই বিমান উড্ডয়নের জন্য আমি বিশেষ এক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছি। দেশের স্বনামধন্য বিমান উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান নভ-৪৪০ এয়ার প্রশিক্ষণ কোর্স থেকে আমি ৭ দিনে বিমানচালনা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছি, তাও আবার ১০০% গ্যারান্টিসহ। আপনারা জেনে খুশি হবেন- আমাকে তারা ১০০ টাকা ছাড়ে ৩৯৯ টাকা প্যাকেজে অত্যন্ত যত্ন সহকারে এই প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। সেই প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান নিয়েই আমি আজকে এই বিমানটি উড্ডয়ন করব।

হিরো জালমের কথা শুনে আমরা সবাই আশ্বস্ত হলাম। যথা সময়ে বিমান সঠিকভাবেই টেকঅফ করলো এবং আকাশপানে উড়ে চলল। সবকিছু ভালোই ছিল। কিন্তু সমস্যা হল মাঝ আকাশে গিয়ে হঠাৎ বিমানে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিল। বিমান একবার বামে কাত হচ্ছেতো আরেকবার ডানে কাত হচ্ছে। একবার সামনে যাচ্ছে তো, একবার নিচের দিকে যাচ্ছে, আবার উপরে উঠছে। আমরা সবাই আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বরের নাম জপতে শুরু করলাম।

এমন সময় মাইক থেকে হিরো জালম ঘোষণা দিলেন সম্মানিত যাত্রী সাধারণ আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, আমাদের বিমানে একটি ভয়ংকর যান্ত্রিক গোলযোগ মনোযোগ দেখা দিয়েছে। যা যা সমাধানের কোনো উপায় আমাকে প্রশিক্ষণের সময় শিখানো হয় নাই। যদি বেঁচে থাকি আমি সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ কোম্পানির নামে মামলা করব। আপাতত সবাই যার যার প্যারাসুট নিয়ে নিচে অবতরণ করুন। যেকোনো মুহূর্ত বিমান ক্রাশ করতে পারে।

হিরো জালমের কথা শুনে ওকে বকাবকি কী আর করবো আগের জান বাঁচানো ফরজ, আমরা সবাই ঝটপট নিজের প্যারাসুট নিয়ে বিমানের ইমারজেন্সি দরজা খুলে লাফিয়ে লাফিয়ে নিচে পড়তে লাগলাম। এতো উপর থেকে পরতে আমার প্রচণ্ড ভয় হচ্ছিল, কিন্তু কিছু করার নেই। বিমানে থাকলেও মারা যাবো। তারচেয়ে বরং প্যারাসুট নিয়ে লাফ দেই। বাঁচলেও বাঁচতেও পারি। এসব ভাবতে ভাবতে আমি লাফ দিলাম।

নিচে পরে হঠাৎ আমার পিঠ ও মাথায় প্রচণ্ড ব্যথায় চিৎকার করে উঠলাম। আমার চিৎকার শুনে পাশে থাকা আমার গিন্নি বললো কি হয়েছে, কি হয়েছে ? ইতিমধ্যে সে ঘরের লাইটও জ্বালিয়েছে। দেখলাম প্যারাসুট ভেবে মশারি ছিঁড়ে-ফুঁড়ে আমি খাটের নিচে পড়ে রয়েছি। বুঝলাম- এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম।

রম্যগল্প : মশারি
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
১০ অক্টোবর ২৪
লোকনাথ দিঘিরপাড়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
-----
লেখক-সম্পাদক কাদের বাবু সম্পাদিত সাহিত্য সাময়িকী বাবুই ঈদ সংখ্যা-২০৫৫ এ প্রকাশিত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ