আরব্য গল্প থেকে ভাবানুবাদ
আরব দেশের এক মালিকের একজন ক্রীতদাস ছিল। মালিকটি ছিল খুবই দয়ালু প্রকৃতির। সে নিজে যা খেতো তার ক্রীতদাসকে তাই খেতে দিত। ক্রীতদাসকে সব রকম সুযোগ-সুবিধা দিত। ক্রীতদাসের কষ্ট হয় তাকে এমন কোনো ভারী কাজকর্ম করতে দিত না।
সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু সেই ক্রীতদাস একবার ভাবল- আমি এখন যে মালিকের কাছে আছি তার থেকে যদি অন্য মালিকের কাছে যাই তাহলে নিশ্চয়ই আমি এখনের চেয়ে আরো ভালো থাকবো। তাছাড়া এক মালিকের কাছে আর কত দিন ভালো লাগে। ক্রীতদাসটি তার এক বন্ধুর সঙ্গে এই বিষয়ে পরামর্শ করলো। কীভাবে সে এই মালিকের কাছ থেকে ছাড়া পাবে তার উপায় জানতে চাইলো।
সব শুনে তার বন্ধু বলল- তুই কিছুদিন তোর নিজের কাজকর্ম ঠিকঠাক মতো করবি না। অসুস্থতার ভান করে পড়ে থাকবি। কিছুদিন ঠিকমতো কাজ না করলেই দেখবি তোর মালিক তোকে অন্য মালিকের কাছে বিক্রি করে দেবে।
বন্ধুর কথার মতো সেই ক্রীতদাস কয়েকদিন অসুস্থতার ভান করে পড়ে রইল। সুস্থ হওয়ার পরও সব কাজে ঢিলেমি শুরু করল। ঠিকমতো পানি আনে না। কাঠ কাটে না। বাজার সদাই করে না। কাজ করলেও ভুলভাল করে। এই রকম আর কি!
মালিক দেখল তার ক্রীতদাসটি আগের মত নেই। প্রয়োজনীয় কাজকর্ম ঠিকঠাক মতো করছে না । মালিকের সাথেও ভালো ব্যবহার করে না । মালিক তখন রাগ করে একদিন এই ক্রীতদাসটিকে আরেক মালিকের কাছে বিক্রি করে দিল।
ক্রীতদাসতো মনে মনে খুশি। সে যা চেয়েছিল অবশেষে তাই হল। কিন্তু ঘটনা ঘটলো তার উলটো। আগের মালিকের তুলনায় নতুন মালিকের ঘরে বেশী ভারী কাজকর্ম করতে হয়। তাছাড়া আগের মালিকের মতো আদরযত্ন পায় না। নতুন মালিক নিজে খায় গমের রুটি আর ক্রীতদাসকে খেতে দেয় যবের রুটি।
ক্রীতদাস ভাবলো- না এই মালিকের কাছে বেশিদিন থাকা যাবে না। সে তখন অন্য মালিকের কাছে যাওয়ার জন্য ফিকির করতে লাগলো এবং তার বন্ধুর পূর্বে দেয়া পরামর্শ মতো নিজের কাজকর্ম ঠিকমতো না করা, অসুস্থতার ভান ধরাসহ নানা অজুহাত দিতে লাগলো। বর্তমান মালিক কৃতদাসের মতিগতি ভালো না দেখে তাকে আবার অন্য একজনের কাছে বিক্রি করে দিল।
এবার নতুন মালিকের কাছে আরও ভালো থাকার আশায় বুক বাধলো ক্রীতদাস। কিন্তু সে ভাগ্য তার হলো না। নতুন মালিক নিজেই খায় জবের রুটি ক্রীতদাসকে দেয় আটার রুটি । এখানে কাজকর্মের কাজকর্মের চাপও পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি। ঠিক মতো খাবার দিত না।
ক্রীতদাস আবারও এই মালিকের কাজে টালবাহানা শুরু করে দিল। মালিক দেখলো এই দাস দিয়ে সে আর নিজের কাজকর্ম করাতে পারছে না। ফলে এই মালিকও তাকে বিক্রি করে দিল। টাকা খরচ করে কেই বা অচল মাল কেনে বলুন। এই মালিক নিজেই খেতো আটার রুটি। আর ক্রীতদাসকে খেতে দিত ময়লা মাখা আটার রুটি। ফলে সেই দাস এই মালিকের ঘরে সে বেশিদিন রইলা না। টালবাহানা করে চলে গেলো অন্য জনের ঘরে।
নতুন মালিক একজন ব্যবসায়ী। কিন্তু সে ছিল কিপটে। সে নিজেই খেতো ময়লা আটার রুটি। আর নিজে যা খেতো কৃতদাসকে দিত তার অর্ধেক। কখনো কখনো তাকে না খাইয়ে রাখতো। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর নানা কাজকর্ম করিয়ে রাতের বেলায়ও তাকে অবসর দিত না। মালিক অনেক রাত পর্যন্ত তার ব্যাবসায়িক হিসাব-কিতাব করত। আর ক্রীতদাসটিকে সেই মালিকের তেলের বাঁতি মাথায় উপর বসিয়ে দাঁদ করিয়ে রাখতো। যতক্ষণ হিসাব শেষ না হতো ততক্ষণই তাকে এভাবেই দাঁড়িয়েই থাকতে হতো।
এভাবেই বেশ কিছুদিন হয়ে গেল । একদিন বাজারে তার পূর্বের বন্ধুর সাথে দেখা হল। বন্ধুটি বারবার তার মালিক বদলের বিষয়টি জানতো। সে ক্রীতদাস থেকে বলল কি ব্যাপার বন্ধু অনেকদিন হয়ে গেল বর্তমান মালিকের কাছ থেকেতো চলে যাচ্ছ না। তার মানে এইবার বুঝি মনের মতো মালিক পেয়েছো।
কৃতদাসটি তখন কাঁদতে কাঁদতে তার দুঃখের কথা বলল। বলল- বর্তমান মালিকের কাছেও সে ভালো নেই। পূর্বের সব মালিকের চেয় এই মালিক আরো বেশি খারাপ। তাকে খেতে দেয় না, বেশি কাজ করায় ইত্যাদি।
বন্ধু যদি তখন বলল- তাহলে এই মালিকের কাছে পড়ে আছ কেনো ? অন্য মালিকের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করো। তখন কৃতদাস বলল- নারে দোস্ত এবার আর অন্য কোনো মালিকের কাছে যাব না। বন্ধুটি বলল কেন?
কৃতদাস উত্তর দিল- যতবার মালিক পালটিয়েছি ততবারই আগের চেয়েও খারাপ মালিক পেয়েছি। বর্তমান মালিকতো ওপর তেলের বাঁতি আমার মাথার বসিয়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখে। আমি আশঙ্কা করছি এবার যদি মালিক পালটাই তাহলে সামনে হয়ত এমন মালিক পাবো যে মালিক আমার মাথার ভিতরে গর্ত করে সেখানে তেল ঢেলে বাঁতি জ্বালাবে। কাজেই যতই কষ্ট হোক; এখন যেখানে আছি সেখানেই ভালো। এই মালিকের কাছে থেকে আর নড়ছি না।
—------
ছোটবেলায় পড়া এই গল্পটি আজ হঠাৎ মনে পড়ল। খুব ভালোভাবে মনে নেই। নিজের স্মৃতি থেকে লিখলাম। সম্ভবত মহা কবি শেখ সাদীর লেখা গল্প এটি। আজকে হঠাৎ মনে পড়লো। কেনো মনে পড়ল জানি না।
আমাদের সমাজে অনেক লোক আছে যারা এক জায়গায় স্থির থাকে না। এক সম্পর্কে স্থায়ী হয় না। নানা জায়গায় ছোটাছুটি করে। বেশি খেতে গিয়ে তারা একসময় কমও খেতে পায় না।
লেখা শেষ করতে করতে আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি প্রবাদও মনে পড়ল:- লইরা চইরা বারো, জাগাৎ বইয়া তেরো।
-----
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
২৪ জানুয়ারি ২৫
0 মন্তব্যসমূহ