(পূর্ব
প্রকাশের পর)
যদিও তীরে ভেরা বা ঘরে ফেরার তাড়া ছিল না, তবুও আমাদের নৌকাটি মেঘনার ঢেউ কেটে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে তীরের দিকে। যেতে যেতে কবি আমির হোসেন স্যারের একটি গল্পের দিকে মনোযোগ দিলাম সবাই। তিনি বললেন- আমাদের নৌকাটি যেখানে নোঙর করবে তার কাছেই এক সময় ব্যক্তির একটি পাকা করা কবর ছিল। এই কবরের কথা তিনি তার চরকেদেরখলা উপন্যাসে উল্লেখ করেছেন।‘ উপন্যাসটিতে এই কবর নিয়ে একটি জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। স্থানীয়রা বিশ্বাস করতো এই কবরের নিচে একটি বিশাল বড় গজার মাছ লুকিয়ে আছে। মেঘনা ভাঙতে ভাঙতে যখন এই কবরের কাছে পৌঁছাবে আর গজার মাছটি যেদিন এই কবর ভেঙে করে বের হতে পারবে। সেদিন থেকে এই এলাকার নদী ভাঙন বন্ধ হবে।’
স্থানটি বীরগাঁও ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত একটি লঞ্চঘাট। এটি ‘গাছতলা লঞ্চঘাট’ হিসেবে পরিচিত। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ে কর্তৃক নির্ধারিত জেটির পাশেই ভিড়লো আমাদের ছোট তরী। নৌকা থেকে নেমে পাশে থাকা একটি চায়ের দোকানে বসলাম সবাই। তারপর চা খেতে খেতে আমির স্যারের বলা কবরের উপস্থিতির কথা একজন স্থানীয় বয়োবৃদ্ধি ব্যক্তির কাছে বলতেই তিনি এর সত্যতা নিশ্চিত করলেন।
চা খাওয়া শেষ করে কয়েকটি অটোরিকশাযোগে রওনা হলাম মালিক ভরসা মাজারের দিকে। মিনিট পনেরোর মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম সেখানে। আমি ও হেলাল উদ্দিন হৃদয় ভাই ছিলাম শেষ অটোতে। বীরগাঁও স্কুল অ্যান্ড কলেজ সামনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন আমির স্যার, সানাউল স্যার, হুমায়ূন কবির ভাইসহ কয়েকজন। বাকিরা মাজারের দিকে চলে গেছেন। হেঁটে হেঁটে আমরা সেখানে পৌঁছলাম। আশেপাশে বেশ কিছু দোকানপাট আর সেগুলোতে প্রচুর মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করলাম। সাথীদের কয়েকজন ভিতরে চলেও গেলেও মাসউদ-উর-রহমান ভাইসহ দুজন মাজারের সদর দরজায় সামনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
সুদৃশ্য বড়সড়ও দরজাটি পেরিয়ে আমরা একসাথে মাজারের ভিতরে ঢুকলাম। প্রাক সন্ধ্যা। দুই পাশে থাকা ছোট দুটি বকুল গাছে ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ুই পাখি আশ্রয় নিয়েছে। গাছ দুটি মাঝখান দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই পাখিগুলোর একটানা কিচিরমিচির ডাক শোনা গেলো। হয়ত তারা সন্ধ্যাকালীন প্রার্থনা করছিল। নয়তো সারাদিন কে কোথায় গেলো, কে কি পোঁকা-মাকড় খেলো। অন্য পাখিরা শিকারির জ্বালে আটকা পড়লো কি না, কোনো শিকারি পাখির খপ্পরে পড়ল কি না- এসব নিয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছে। আবার ইরান-ইজরাইল যুদ্ধে তাদের কি কোনো ভূমিকা রাখার উচিত- এসব নিয়ে হয়ত গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছিল। সে যাই হোক পাখিদের ডাককে আমরা ভাবলাম- পাখিরা বুজি মাজারে আমাদের স্বাগত জানাল।
মালিক ভরসা মাজারে এর আগেও একবার এসেছিলাম। সেবারের তুলনায় ভেতরে আজ একটু বেশিই ভীর বলে মনে হলো। মালিক ভরসা মাজার একটি প্রসিদ্ধ মাজার। এই এলাকায় এই মাজারের যথেষ্ট পরিচিত ও প্রভাব আছে। এখানে সমাহিত আছেন পীর হজরত খাঁজা শাহ্ হাছান সাইয়্যিদ নুরুল হোসাইন আহম্মদ চিশতী (র.)। তাঁর জন্মস্থান উপজেলার বড়াইল গ্রামে, জন্ম তারিখ অজ্ঞাত। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক। শিক্ষকতার পাশাপাশি এলাকার মানুষদের হোমিও চিকিৎসা দিতেন। ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত এই সাধক কখনও পায়ে জুতা পরতেন না। নিজেকে সবসময় নিয়োজিত রাখতেন মানুষের কল্যাণে। তিনি তাঁর প্রত্যেক কাজের শুরুতে বলতেন ‘মালিক ভরসা’। সেই থেকে তাঁর নাম হয় ‘মালিক ভরসা’। তিনি জীবিত থাকা অবস্থাতেই তাঁর অনেক ভক্তকুল তৈরি হয়।
২০০৪ সালের ২৪ এপ্রিল, শনিবার পীর হজরত খাঁজা শাহ্ হাছান সাইয়্যিদ নুরুল হোসাইন আহম্মদ চিশতী (র.) মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে যেখানে সমাহিত করা হয় সেখানেই তার মৃত্যুও পর থেকে প্রতি শনিবার ভক্তিমূলক গানের আসর বসে। এই সময় তার ভক্তরা এখানে সমবেত হয়। ধীরে ধীরে এটি পূর্ণাঙ্গ মাজারে রূপ লাভ করে এবং ‘মালিক ভরসা’ মাজার নামে পরিচিতি লাভ করে। সাপ্তাহিক আসর ছাড়াও অনুষ্ঠিত হয় বাৎসরিক ওরস। আরবি রবিউল আওয়াল মাসের ৩ ও ৪ তারিখে অনুষ্ঠিত বাৎসরিক ওরস। এই ওরসের সময় সারাদেশ থেকে হাজার হাজার ভক্তবৃন্দ এখানে সমবেত হন। এসময় মাজারকে সাজানো রঙিন লাইট, ইসলাম ও মাজারের সিম্বল সম্বলিত রঙিন পতাকা দিয়ে। এসময় ভক্তদের দেওয়া শত শত ছাগলসহ নানা উপঢৌকনের পাহাড় জমে যায়। এসব দিয়েই আবার তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এই মাজারের আসে বলে এখানে গরুর মাংস খাওয়ার প্রচলন নেই।
ব্যক্তিগত বিশ্বাসে আমি মাজার ভক্ত মানুষ নই। তবে তিনটি মাজারে প্রায় ৮ দিন অবস্থানসহ দেশের আরো কিছু মাজার পরিদর্শন করেছি। মাজার ভক্ত মানুষদের সঙ্গে মিশে আমি বুঝেছি মাজার বা মাজার সম্পৃক্ত পীরের প্রতি বিশ্বাস, ভক্তি এবং শ্রদ্ধার ভিত্তি অনেক গভীর। বিশ্বাস ও আচারে মাজার সংস্কৃতি যেন ধর্মের ভেতরে বেড়ে ওঠা আরেকটি উপধর্ম। ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো মাজারের আলাদা রীতিনীতি ইসলাম ধর্মের মূল বিশ্বাস পাশ কেটে এগিয়ে গিয়েছে । কোনো কোনো মাজার, মাজারের পীর ও খাদেমের নানা অলৌকিক কারামতের কথা ভক্তবৃন্দসহ লোকমুখে প্রচলিত। যার অনেকগুলোই অসত্য এবং মিথ্যা। এজন্যই এক শ্রেণীর আলেম-ওলামাগণ তীব্রভাবে মাজার বিরোধিতা করতে দেখা যায়।
তবে এটাও ঠিক যে, দেশের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী কোনো না কোনো মাজারের ভক্ত। কেউ একাধিক মাজারের ভক্ত। দেশের শিক্ষিত এবং বিপুল সংখ্যক অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর এই মাজার ভক্তির কারণে এবং মাজারকেন্দ্রিক বিভিন্ন কালচারের বিশ্বাসী হওয়ার কারণে বাংলাদেশে মাজার কেন্দ্রিক ধর্ম চর্চা একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করে আছে। এর একটি ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক শক্তিশালী ভিত্তিও রয়েছে। যে ভিত্তি একটি এলাকার জনগণের জীবন, সংস্কৃতি, জীবিকা এবং স্থানীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে নিয়ন্ত্রণ করে। ভবঘুরে সমাজ-সংসার ত্যাগী বা বঞ্চিত মানুষের থাকা খাওয়ার নিশ্চয়তা দেয় দেশের হাজার হাজার মাজার। ফলে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে মাজারের গুরুত্বকে অস্বীকার করার উপায় নেই বলে আমি মনে করি।
ভ্রমণ সাথী লেখকদের নিয়ে মালিক ভরসা মাজারের পুরো এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। মূল ফটকের ভেতর দিয়ে মাজারের ভিতরে প্রবেশ করে দেখা যাবে মাজারি সাইজের চমৎকার একটি বৃত্ত আকারের স্থাপনা। এইটিই মূল মাজার শরীফ। যেখানে শায়িত আছেন ভক্ত কূলের আধ্যাত্মিক পীর ‘মালিক ভরসা’। প্রথমেই সকলের দৃষ্টি কেড়ে নেয় বৃহৎ একটি গম্বুজ। গম্বুজের চূড়ায় একটি ছোট মিনার। এই গম্বুজের চারপাশে আছে ছোট ছোট ৮টি মিনার। এর পরের সারিতে আছে কিছুটা বড় আকারের আরো ৮টি মিনার।
ছাদের ঝুলন্ত কার্নিসের চারধারে মোঘল ও ইরানীয় ইসলামিক স্থাপত্য রীতির ভাব আনার প্রয়াস লক্ষণীয়। লতাপাতা ফুলের কারুকাজ করা হয়েছে তাতে। বামপাশের একটি এসএস নির্মিত ছোট সিঁড়ি সাপের মতো পেঁচিয়ে চলে গেছে উপরে চলে গেছে ছাদের দিকে। এর ভিতরের প্রবেশদ্বার ও সাইড বাউন্ডারির উপরে এসএস শিটের মাধ্যমে আরেকটি বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে। বেষ্টনী ও মূল মাজারের মাঝের খালি জায়গাটি চকচকে টাইলস করা। গুরুত্ব বিবেচনায় এই স্থাপনাটি ইসলামিক কারুকার্যের সমন্বয়ে নান্দনিক একটি ডিজাইন ফুঁটিয়ে তোলা হয়েছে। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। মাজারের সামনে কিছুটা খোলা মাঠ। পাকা করা। পূর্বদিকে আরেকটি বিশেষ ঘর রয়েছে। অনেকটা মাজার-সদৃশ্য ছোট স্থাপনা। এটিকে হুজরাখানা বলা হয়। এর উপরেও রয়েছে মিনার। হুজরাখানা কি এটি ঠিক বুজতে পারিনি। একজনে জিজ্ঞেস করলেও তিরি এর সদুত্তর দিলেন না। তার পরেই উত্তরপূর্ব কোণায় একটি ছোট মসজিদ। এই তিনটি স্থাপনার ডান পাশে মুসল্লিদের অজুর কারার স্থান।
মূল মাজারের ভেতরে প্রবেশ করিনি বলে এর ভেতরের দিকটা দেখা হলো না। অবশ্য ভেতরে না ঢোকার আরেকটি কারণ আছে । একবার খরমপুর মাজারে যখন প্রথম প্রথম গিয়েছে ভিতরটা দেখে বের হওয়ার সময় এক আগন্তুক আমাকে ধমকের স্বরে বললো আরে মিয়া আপনি মাজারে পীঠ দেখিয়ে বের হচ্ছেন কেন, জানেন না মাজারে উলটা পায়ে হেঁটে বের হতে হয়। সত্যিই মাজারের এই আদবটি আমার জানা ছিল না যে মাজারের দিকে পীঠ দিয়ে বের হওয়া যায় না। আমি যেমন মাজার ভক্ত মানুষ নই, কাজেই এই নিয়মটি ফলো করতেও আগ্রহী নই। আবার মাজার ভক্তদের মনে কষ্ট দিতেও রাজি নই। এজন্য আর কোনো মাজারের মূল স্থাপনায় কখনোই প্রবেশ করিনি।
আমরা ঘুরে ঘুরে পুরো মাজার এলাকাটি দেখতে লাগলাম। উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত আয়তক্ষেত্র বিশিষ্ট আয়তনের এই মাজারের জায়গা দান ও ক্রয়সূত্রে নিজের এলাকা বিস্তৃত করেছে। বিশাল এড়িয়া নিয়ে তৈরি মাজারের চতুর্থদিকে তোলা হয়েছে লম্বার লম্বা আধাপাকা ঘর। অসংখ্য কামরা সমৃদ্ধ ধাপে ধাপে বানানো ঘরগুলো দেখতে প্রায় একই রকম। বেশিরভাগ ঘরেই আলাদা পার্টিশন দেওয়া কেনো রুম নেই, তবে বারান্দা আছে। লম্বা লম্বা টিনের ঘরগুলোতে ভক্ত আশেকানদের জন্য আস্তানা তৈরি করা হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছিল মাজারের ওরস চলাকালীন সময়ে এখানে বিভিন্ন সাধক পীর ফকিরদের আধ্যাত্মিক আসর বসে। বিভিন্ন এলাকার পীর খাদেমদের জন্য আস্তানা নির্ধারণ করে তাদের নাম লিখা রয়েছে । মাজার সংশ্লিষ্ট একজনের কাছে জানতে পারলাম দক্ষিণদিকে আরো কিছু জমি ক্রয় করা হয়েছে। সেখানে পুকুর খনন করে মাছ চাষের পরিকল্পনা আছে তাদের।
মূল মাজারের পরে খোলা মাঠ পেরিয়ে কিছুটা জায়গাজুড়ে ফলজ বাগান। তারপরে কয়েকটি উত্তর দক্ষিণে লম্বা লম্বা চারটি ঘর। এই ঘরগুলো বিশেষভাবে তৈরি করা এবং এগুলো আলাদা বাউন্ডারি ঘেরা। দেখতে অনেকটা কটেজ বা রেস্ট হাউজের মত। সম্ভবত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি আসলে তাদের ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করে রাখা আছে এই ঘরগুলো। পশ্চিমের ঘরগুলো স্বাভাবিক বাড়িঘরের মতো । গতবার যখন এসেছিলাম দক্ষিণ-পশ্চিমপাশের একটি বড় ঘরের সামনে অনেক ছাগল, খাসি বাঁধা দেখেছিলাম, এবার সেরকম কিছু দেখলাম না।
এর আগে এসে এই মাঠের উত্তর পাশে বিশাল পেয়ারা বাগান দেখেছিলাম। সেটা এখন নেই। ডালে ডালে ঝুলে থাকা পেয়ারাগুলোর ছবি এখনও চোখে ভাসছে। এবার সেখানে সারিবদ্ধভাবে আম কাঁঠালসহ নানা গাছ লাগানো হয়েছে। কটেজ সাদৃশ্য ঘরেরগুলোর পরেই এই বাগানের স্থান। বাগানে পূর্বে পশ্চিমে বিস্তৃত পাঁচ সারিতে অন্তত অর্ধশত গাছ লাগানো হয়েছে এখানে। এই বাগানের পরেই মাজারের দক্ষিণ পাশের বিরাট খোলা মাঠ। মাঠের পশ্চিম পাশে একটি মঞ্চ তৈরি করা। এখানে ধর্মীয় আলোচনা তথা ওয়াজ মাহ্ফিল আয়োজন করা হয়। এছাড়াও সেখানে বাউল সংগীতসহ বিভিন্ন ভক্তিমূলক গানের আয়োজন করা হয়। এই মাঠে কয়েক হাজার মানুষের বসার মতো জায়গা রয়েছে।
নির্ধারিত ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখা যায় পুরো মাজার এলাকাই সবুজের চাদরে ঢাকা। শত শত ফলজ গাছগাছালিতে ভরা। পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছ লাগানো হয়েছে। আম-কাঁঠাল গাছের উপস্থিতিই বেশি মনে হলো। কোনো কোনো গাছে ঝুলছে কাঁচা পাঁকা কাঁঠাল। তাদের যত্নের ছাপ স্পষ্ট। কোথাও কোথাও বাগান রক্ষা করতে মজবুত লোহার গ্রিল দিয়ে পুরো এরিয়া সিল করে দেওয়া হয়েছে। ছায়া সুনিবিড়, নানা পাখির ডাক আর ভক্তিময় একটা আমেজ। এত মানুষের আনাগোনাতেও সবুজের সমারোহে এক নির্মল আনন্দ বিরাজ করে এখানে। গাছগুলো বড় হলে এখানকার পরিবেশ আরো ভালো লাগবে।
এ পর্যন্ত আমি যতগুলো মাজারে গিয়েছি তাদের মধ্যে এই মাজারটি একটু ব্যতিক্রম মনে হলো। অন্যসব মাজারের মতো তথাকথিত পীর খ্যাত অর্ধউলঙ্গ, মাদকাসক্ত ও ভবঘুরেদের দেখা নেই এখানে। আমরা ঘুরে ঘুরে পুনরায় আমরা মূল মাজারের কাছে আবার এসে লক্ষ করলাম সেখানে বিশেষ একটি আনুষ্ঠানিকতা পরিচালিত হচ্ছে। মূল মাজারের চারপাশে ভক্তরা দাঁড়িয়ে পীরের নামে সম্মিলিতভাবে ভক্তি প্রদর্শন করছে। প্রথমে বুজতে না পারলেও পরে বুজলাম সবাই জিকিরের মতো শব্দে ‘মালিক ভরসা’ শব্দটি উচ্চারণ করছে। পরে তারা এখান থেকেই বেরিয়ে পূর্ব পাশে থাকা হুজরাখানায় প্রবেশ করে একই ধরনের আনুষ্ঠানিকতা পালন করলেন। আমরা দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তা উপভোগ করলাম।
আমির হোসেন স্যার জানালেন এখানে একটি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে। মাজারের পীর সাহেব যে হোমিও সেবা দিতেন, সেই ব্যবস্থাটি এখনো চালু রাখা হয়েছে। মাজার কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয় এই হোমিওপ্যাথি প্রতিষ্ঠানটি। মাজারের আসা ভক্তবৃন্দ, খাদেম ছাড়াও এলাকাবাসী এখান থেকে বিনামূল্যে হোমিও সেবা নিতে পারে। অনেক সেবা গ্রহীতা চিকিৎসা সেবা নিয়ে জন্য স্বেচ্ছায় অর্থ প্রদান করে থাকেন। আমি জানতে চাইলাম এই মাজারের আওতাভুক্ত কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যেমন: মসজিদ, মাদ্রাসা কিংবা জেনারেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে কি না। তারা জানালো- মসজিদ আছে, তবে মাদ্রাসা বা স্কুল নেই। আমি ভাবলাম দেশের অনেক মাজারের আওতায় মাদ্রাসা বা স্কুল পরিচালনা করা হয়, এখানেও এই ব্যবস্থা থাকলে মন্দ হতো না। যেহেতু মাজারের প্রচুর আয় আছে, কাজেই সেই আয়কে সমাজসেবায় লাগানো যেতে পারে। কিন্তু কথাটি বলতে গিয়েও বললাম না।
আমরা এখানে আসার আগেই কবি ও শিক্ষক শাহজাদা জালাল আংকেল ও প্রাবন্ধিক-প্রভাষক মাসউদ উর রহমান ভাই আমাদের আগমনের খবর মাজারের দায়িত্ব খাদেমদের কাছে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তারা এই নবীনগরেরই মানুষ, ফলে মাজারের খাদেমদের সাথে তাদের পূর্ব পরিচয় ও সুসম্পর্ক ছিল। খাদেমগণ আমাদের স্বাগত জানালেন। উপস্থিত খাদেমদের সাথে আমাদের সেকল-লেখকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন । সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও বিশিষ্ট লেখক ড. শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক স্যারের পরিচয় পেয়ে তারা বেশ উৎফুল্ল হলেন।
তারা আমাদের পশ্চিম পাশের একটি রুমের বারান্দায় মাদুর পেতে বসালেন। আমাদের দলে যারা কিছুটা বয়জ্যৈষ্ঠ তারা এভাবে নিচে বাসা নিয়ে কিছুটা সমস্যায় পড়লেও মাজারের গাম্ভীর্যতার কারণে কারো কারো মনে সংকোচ দেখলাম না। মাদুর পেতে দুই পাশে সারিবদ্ধ হয়ে বসে আছেন একদল লেখক- আমার কাছে দৃশ্যটা ভালোই লাগলো। খাদেমগণ সবাইকে মিষ্টি খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। কিছুক্ষণ পর মাটির সানকিতে মাজারের ভক্তদের জন্য রান্না করা খিচুড়ি দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। মাজারের তাবারক ভেবে আমরা তা খেলাম। আমাদের সাথে ইতোমধ্যেই আরেকজন শিক্ষক যুক্ত হয়েছিলেন তার নামও শাহজাদা। তিনি আমাদের মাজারের পাশেই থাকা তার বাড়িতে যেতে আমন্ত্রণ জানালেন।
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে আরো আগেই। এতক্ষণ বাড়ি ফেরার তারা না থাকলেও, আঁধার ঘনিয়ে আসতেই আমরাও বাড়ি ফেরা তাড়া অনুভব করলাম। খাদেমদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মাজারের মূল ফটকের কাছে আসতেই দুই পাশের বকুল গাছে থাকা চড়ুই পাখিদের কিচিরমিচির ডাকগুলো আর শুনতে পেলাম না। প্রবেশের সময় তারা আমাদের স্বাগত জানালেও বিদায় বেলা তারা একদম চুপ। আমি ভাবলাম হয়ত এখানে এটাই নিয়ম।
হয়ত তারা মনে মনে বলছে-
আবার এসো এই আঙিনায় ভালোবাসার কবি,
আসলে আবার এই শ্যামলে ভরিয়ে দেবো গানে
বিদায় বেলায় চুপ থাকি তাই কষ্ট রেখে প্রাণে।
ভবের দেশে কবির বেশে তোমরা আসো যদি
ভাব-ভক্তি প্রেমের লীলায় ভরে ওঠে নদী,
মোদের বুকে ঢেউ খেলে যায় তোমার আগমনে
নদীর বুকে জোয়ার যেমন চাঁদের আকর্ষণে।
নাইবা ছোঁয়া নাইবা ধরা নাইবা মুখোমুখি
ভবের দেশে ভাবের কথা বলবো চোখাচোখি,
তোমার কবি আমরা পাখি মালিক ভরসায়
কিচিরমিচির কাব্য কথায় ভবের মেলা বসাই।
তুমি আমি আমি তুমি বাঁধা এমন প্রেমে
ঢেউয়ে বুকে লেপ্টে যেমন থাকে পাটাতনে।
----
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
২৩ জুন ২৫
এই লেখার প্রথমঅংশ পড়তে পারেন এই লিংকে ঢুকে
https://www.facebook.com/reel/1357626941994916
আর শেষাংশ পড়তে অপেক্ষা করুন।
0 মন্তব্যসমূহ