হারিছ মিয়ার সদ্য এসএসসি পাস করা ছেলেটি বেশ কিছুদিন যাবত তার মায়ের কাছে বায়না ধরেছে পাঁচ হাজার টাকার জন্য। তার সব বন্ধুরা এসএসসির পর কক্সবাজারে ঘুরতে যাবে। বন্ধুদের সাথে সেও যাবে বলে মনস্থির করেছে। প্রথমে তার ইচ্ছে ছিল না দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার। কিন্তু তার বন্ধুরা খুব জোর করছে তাকে। সে না গেলে নাকি তাদের ভালো লাগবে না। এমনিতেই জন্মের পর বাবা মা ছাড়া এতদূর কখনো সে থাকেনি। তার ওপর এতগুলো টাকা তার বাবা দিবে কী না এই সংশয় ছিল। তাই বন্ধুদের সরাসরি না করেছিল কক্সবাজার যাবে না বলে। কিন্তু বন্ধুরা সব নাছোড়বান্দা। রাকিবকে ছাড়া তারা ভ্রমণে যাবে না। অগত্যা রাকিব তার মাকে নানান ভাবে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ভ্রমণের টাকাটি দেওয়ার জন্য।
হারিছ মিয়ার ছোটখাটো একটি চাকরি আছে। একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির গাড়ির ড্রাইভার। অল্প বেতন। শহরের বাসায় ভাড়া বাসায় থাকে তারা। হারিছ মিয়ার ছোট মেয়ে জুঁই সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। বাসাভাড়া, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া খরচ চালিয়ে সংসার চালাতে রীতিমতো তার হিমশিম খেতে হয়। তার উপর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে অবস্থা আরো নাজুক। এমন অবস্থায় পাঁচ হাজার টাকা ভ্রমণের জন্য দেওয়া তাদের জন্য বিরাট সমস্যা।
মধ্যবয়সী হারিছ মিয়ার স্বভাব চরিত্র ভালো। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন তিনি। সৎ বিনয়ী বলে তার যথেষ্ট সুনাম আছে। অফিসের বড়ো কর্মকর্তাকে বাসা থেকে অফিসে, অফিস থেকে বাসায় এবং অন্যান্য জায়গায় যাতায়াত করে দিন পার হয়ে যায় হারিছ মিয়ার। ফলে চাকরির পাশাপাশি অন্য কিছু করার সুযোগ নেই তার। তাই তাদের সংসারে নিত্য টানাপড়েন লেগেই থাকে।
রাকিবের মা দু-একবার ছেলেকে বুঝিয়েছে এখন কক্সবাজার না গিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক দেবার পর যাওয়ার জন্য। কিন্তু ছেলে নাছোড়বান্দা, মার পিছনে ঘুরঘুর করছে আর টাকার জন্য বিনয় করছে। রাকিব তার বাবার মতোই ভালো ছেলে- বিনয়ী, পড়াশোনায় যথেষ্ট মনোযোগী। স্কুলে তার নামে কেনো দুর্নাম নেই। বরাবরই ক্লাসে ভালো রেজাল্ট করে সে। এবার এসএসসি পরীক্ষায়ও ভালো রেজাল্ট করবে এমনটাই আশাবাদ তার শিক্ষক ও বন্ধুদের। এসএসসি পরীক্ষা উপলক্ষ্যে গত প্রায় দেড় বছর যাবত পড়াশোনায় খুব বেশি ব্যস্ত ছিল সে। তাই ছেলেকে জোর গলায় না করারও কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না শিউলি বেগম। বললেন, তোর বাবাকে তো একবার বলেছিলাম, না করেছে। ঠিক আছে; আবার বলবো।
সেই দিন রাতের বেলা হারিছ মিয়া বাসায় ফিরলে শিউলি বেগম স্বামীর কাছে সবকিছু বুঝিয়ে বললে- ছেলেটি আমার পড়াশোনায় ভালো। কখনো তেমন কিছু বায়না করে না। আমরাও তো তাকে তেমন কিছু দেইনি। এখন বন্ধুদের সাথে বেড়াতে না যেতে পারলে তাদের কাছে ওর মান-সম্মান থাকে না। তুমি একটু চেষ্টা করে দেখো, কোথাও থেকে পাঁচ হাজার টাকা জোগাড় করতে পারো কী না। আমার গয়নাগাটিতো আরো আগেই বিক্রি ও বন্ধক দিয়ে রেখেছি। তা না হলে তোমাকে বারবার বলতাম না।
স্ত্রীর কথায় হারিছ মিয়ার মন কিছু নরম হলো। বললেন- দেখি কিছু করা যায় কী না। পরদিন অফিসে হারিছ মিয়া তার কিছু সহকর্মীদের কাছে টাকা ধার চাইলেন। কিন্তু সবাই ধার দিতে অস্বীকার করল। হারিছ মিয়া অফিস থেকে লোন তুলতে চাইলেন। কিন্তু আরো আগে মায়ের চিকিৎসার জন্য লোন তোলা ছিল এবং তা পরিশোধ করা হয়নি বিধায় ঊর্ধ্বতনও কর্মকর্তারা পুনরায় লোন দিতে অস্বীকার করল।
হারিছ মিয়ার নিজের কাছে নিজেই খুব লজ্জা পেলো। তার খুব দুঃখ, অনুশোচনা হতে লাগলো। এমনিভাবেই আরো কয়েকদিন চলে গেল। ওইদিকে ভ্রমণের তারিখ ঘনিয়ে আসছিলো ছেলে আর ছেলের মার বায়নাও বেড়েই চলছিল। একদিন হারিছ মিয়া বসে বসে ভাবছিল কী করে টাকার ব্যবস্থা করা যায়। কোনো উপায় না পেয়ে সে ভাবল আমি রোজ গাড়িতে তেল ভরার জন্য অফিস থেকে যা টাকা পাই সেখান থেকে কয়েকদিন একটু বাড়িয়ে বিল করলেই পাঁচ হাজার টাকা জোগাড় করা যেতে পারে।
আবার ভাবল এগুলো তো অসৎকর্ম, হারাম কাজ। ছেলেমেয়েকে কখনো হারাম খাওয়ায়নি। এখন কক্সবাজার ঘোরার জন্য এ অন্যায় কাজটি আমি করতে পারবো না। আবার শত হলেও বাবার মন। ছেলের বায়না সব পূরণ না করতে পারলে ছেলে যদি আবার বকে যায়, সে ভয়ও ছিল। অবশেষে হারিছ মিয়া ভাবলো ঠিক আছে আমি যত টাকা এইভাবে নেবো পরে এক সময় অন্য কোনো ভাবে টাকাটা শোধ করে দেব। তাহলে হয়ত সমস্যাটার একটি সাময়িক সমাধান পাওয়া যাবে।
যেই ভাবা- সেই কাজ। হারিছ মিয়ার গাড়ির তেল খরচ বাবদ দুই তিনশ টাকা বাড়িয়ে বিল তৈরি করতে লাগলো। এমনিভাবে ১৫/২০ দিনের মধ্যেই তার দুই আড়াই হাজার টাকার মত জোগাড় হয়ে গেল। কিন্তু একদিন হলো কি গাড়ির মালিক বিষয়টি কীভাবে যেন টের পেয়ে গেলো যে, তার ড্রাইভার প্রায় অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছে।
বিষয়টি টের পেয়ে তিনি ড্রাইভার হারিছকে জিজ্ঞেস করলেন। যে সমস্ত জায়গা থেকে গাড়িতে তেল লোড করতো সেগুলোর বাজার বর্তমান দর যাচাই করলেন।
পরিশেষে যা সন্দেহ করেছিল তাই হলো। হারিছ মিয়ার চুরি ধরা পড়ল। অফিসার তাকে খুব গালমন্দ করলেন, বললেন- আপনাকে ভালো মানুষ হিসেবে জেনেছি, নামাজ কালাম পড়েন অথচ আপনি নিয়মিত চুরি করে যাচ্ছেন। এর জন্য আপনাকে শাস্তি পেতে হবে। হারিছ মিয়া অফিসারকে অনেক অনুনয় বিনয় করলেন। ছেলের কথা বলেন। অর্থনৈতিক সমস্যা আর বাজারদর নিয়ে কথা বললেন। কিন্তু তার মালিকের মন গলল না।
শেষে তার মালিক হারিছ মিয়ার নামে তেল চুরির অভিযোগে থানায় রিপোর্ট করলেন। পুলিশ এসে হারিস মিয়াকে ধরে থানা নিয়ে গেল। খবর পেয়ে হারিছ মিয়ার স্ত্রী ছেলে মেয়ে থানায় দেখা করতে এসে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো। হারিছ মিয়ার বউ হারিছ মিয়াকে জিজ্ঞেস করল- তুমি কি সত্যিই চুরি করেছিলে।
হারিছ কাঁদতে কাঁদতে বলল- আমি তো চুরি করতে চাইনি। ভাবলাম আমাদের একমাত্র ছেলে। ও যদি খারাপ হয়ে যায়। বিশ্বাস করো আমি একদিন এই টাকাগুলো ফেরত দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার আগেই ধরা পড়ে গেলাম। আল্লাহ আমাকে আমার পাপের শাস্তি দিয়েছেন। তার ছেলে কান্না করতে করতে বলল- আব্বু, আমি কক্সবাজার যেতে চাই না। আমার ভুল হয়েছে। আমি তোমাদেরকে জোরাজুরি না করলে তুমি হয়তো এই কাজ করতে না। আমি আর কখনো এরকম করবো না।
খবর পেয়ে হারিছ মিয়ার শ্যালক ছালেক সাথে আইনজীবী নিয়ে এসে হারিছ মিয়াকে ছাড়াতে এলো থানায়। মুচলেকা দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেলো।
তবে বড় কর্মকর্তা শর্ত দিয়েছিল চুরির দায়ে তাকে চাকরি ছাড়তে হবে। কোনো অসৎ ড্রাইভারকে তিনি তার অফিসে রাখতে চান না। হারিছ মিয়ার চাকরি চলে গেলো। বড় কর্মকর্তা নতুন ড্রাইভারকে তিনি সাথেই করেই থানায় এসেছিল। সাঁইত্রিশ লক্ষ আষট্টি হাজার পাঁচশত নিরানব্বই টাকা দামের গাড়িতে চড়ে বড় সাহেব বাড়ি ফিরে গেলেন। হারিছ মিয়া সাহেবের গাড়িটির দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সে জানে বড়ো সাহেবের প্রিয় এই গাড়িটি সাহেবের দুর্নীতির টাকা কেনা।
ছোটগল্প : বায়না
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
১২ ডিসেম্বর ২২
লোকনাথ দিঘিরপাড়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
(বদরুন নাহার সম্পাদিত সাহিত্যের ছোট কাগজ ‘ঝিনুক’ বই মেলা ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত)
0 মন্তব্যসমূহ