একটি লেখা একজন লেখককে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখে। একটি বই একজন লেখককে শত শত বছর অমর করে রাখে। একটি বই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝখানে সেতু বন্ধন রচনা করে। কাল থেকে কালে- ভাব, ভাষা ও মতাদর্শের বিনিময় করে। আমাদের হাতে থাকা এই বইটি তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। আমাদের দেশে হাজার হাজার এমন লেখক রয়েছেন যারা নীরবে নিভৃতে সাহিত্য চর্চা করেন। যাদের অনেকেই প্রচলিত প্রচার মাধ্যম থেকে যোজন যোজন দূরে। তেমনি একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কবি আব্দুল কাদের মাশরেকী।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্য সমাজে অনেকটা অনুচ্চারিত এই কবিকে আবিষ্কার করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বহুগ্রন্থ রচয়িতা ও সাংগঠনিক ব্যক্তিত্ব কথাসাহিত্যিক আমির হোসেন স্যার। সে ঘটনাও বেশ রোমাঞ্চকর ! প্রায় ২০ বছর আগে জনাব আমির হোসেন বাসা ভাড়া থাকতেন আব্দুল কাদের মাশরেকীর কন্যা সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার কবিতা বেগম-এর বাড়িতে। কবিতা বেগম একদিন কথা প্রসঙ্গে তিনি জানতে পারেন তার বাড়ির ভাড়াটিয়া একজন লেখক। কবি আমির হোসেন জানতে পারেন বাড়িওয়ালির বাবা এক সময় লেখালেখি করতেন। কিন্তু তার কোনো বই প্রকাশিত হয়নি। আমির হোসেন জানতে চান- কবি আবদুল কাদের মাশরেকীর লেখা কোনো পাণ্ডুলিপি আছে কিনা ?
জানা যায় কবির তিনটি বই প্রকাশিত হলেও এগুলোর এবলএইবল কপি পাওয়া যায় না। বইগুলো হলো ‘সুর সপ্তক’, ‘অজানার সন্ধান’ ও ‘মরু বুকে স্বতঃস্ফূর্ত স্নিগ্ধ ফল্গুধারা’। এছাড়াও অপ্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে দুইটি বই, আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ- ‘ভবের রঙ্গ মঞ্চ মাঝে আমার অভিনয়’ অপরটি জীবন সাধনা নিয়ে লিখা- ‘জগৎ ও জীবন’।
একটি বইয়ের পাণ্ডুলিপির খোঁজ পাওয়া যায় ঢাকায়, মরহুম কবির বড় ছেলে আইসিডিডিআরবির ডাক্তার জনাব মিজানুর রহমানের কাছে। যোগাযোগ করে একদিন তিনি চলে যান ঢাকায়। সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন জীর্ণ-শীর্ণ, ইঁদুরে খাওয়া প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া হাতে লেখা এক পাণ্ডুলিপি। সেটি পড়ে পাঠ উদ্ধার করে সম্পাদনা ও কাব্য বিশ্লেষণ করে প্রকাশ করেন ‘দার্শনিক কবি আব্দুল কাদের মাশরেকীর জীবন ও সাধনা’ নামক এই বইটি। বইটি লিখতে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে আমির হোসেন স্যারকে সহযোগিতা করেন কবির ছোটপুত্র মাশরেকী শিপার।
গ্রন্থের ভূমিকা থেকে জানা যায় ১৮৯৭ সালে (বাংলা ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৪ সালে) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার বিদ্যাকূট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সঙ্গীত সাধক ও দার্শনিক কবি আব্দুল কাদের মাশরেকী। তাঁর পিতার নাম শাহ্ সমসের আলী ও মাতার নাম আমিনা জোছনা। বিদ্যাকূট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবন শুরু করে একই গ্রামের বিদ্যাকূট অমর ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯২১ সালে কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করেন তিনি। বেশি দূর আর লেখাপড়া কারার সুযোগ হয়নি তাঁর। কর্মজীবনের প্রথম দিকে তাঁর বড় ভাই মুন্সি তবদিল হোসেনের সাথে যশোর জেলায় ৩০ টাকা বেতনে নকলনবিশের কাজে যুক্ত হন কবি। কিন্তু কাজরে যোগ দেয়ার ৪/৫ মাসের মধ্যই ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আবার বিদ্যাকূটে চলে আসেন কবি। সুস্থ হয়ে পরবর্তীতে চাকরির সন্ধানে চলে যান কলকাতায়। অনেক চেষ্টা তদবিরের পর মাত্র ১৬ টাকা বেতনে পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি পান।
ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্যানুরাগী কবি আব্দুল কাদের কর্ম জীবনেও সাহিত্য সাধানা অব্যাহত রাখেন। কর্মসূত্রে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানো আর নানা মানুষের সাথে মেশান সুযোগ তার সাহিত্য সাধনায় রসদ যোগায়। সুদীর্ঘ ৮০ বছর জীবন শেষে মানবতাবাদী চিন্তাবিদ, সঙ্গীত সাধক ও সুসাহিত্যিক এই কবি ১৯৭৮ সালের ৯ মার্চ পরলোকগমন করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কাজী পাড়াস্থ কাজী মাহমুদ শাহ (রা) এর মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে তিনি চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন।
গ্রন্থটির ভূমিকায় এর রচয়িতা ও সম্পাদক আমির হোসেন বলেন- “দার্শনিক কবি আব্দুল কাদের মাশরেকী সুদীর্ঘ চাকুরি জীবনে অবিভক্ত ভারত বর্ষের বিভিন্ন থানায় তিনি বদলি সূত্রে গিয়েছেন। বসবাস করেছেন বিভিন্ন জায়গায়, মিশেছেন বিচিত্র পরিবেশে, বিচিত্র সব মানুষের সঙ্গে। সান্নিধ্য লাভ করেছেন অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষের। আর অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ করেছেন ষোলকলায়। পুলিশের চাকুরিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেও সঙ্গীত এবং কাব্য সাধনাকে গ্রহণ করেছিলেন নেশা হিসেবে। আর চিন্তা ও চেতনা রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটিয়েছিলেন, দার্শনিক মনোভাব, মানবতাবোধ ও অসাম্প্রদায়িকতাকে কেন্দ্র করে।
আমরা মানুষ, আমরা মানুষ হিসেবে চলার চেষ্টা করে এই পৃথিবীতে সকলে সুখে ও শান্তিতে বসবাস করার ইচ্ছা প্রকাশ করে আসছি এবং বলে থাকি “মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব”। সমাজবিজ্ঞান ও সর্ব ধর্ম মতে সকল মানুষই এক জাতিভুক্ত। “সবার উপর মানুষ সত্য তার উপর নাই”। এই সহজাত সত্যকে অবলম্বন করে ও ভেবেই সারা জীবন পথ চলেছেন এই দার্শনিক কবি আব্দুল কাদের মাশরেকী। ”
কবির কাব্যধারা বিশ্লেষণে আমির হোসেন আরো লিখেন- “প্রত্যেক মানুষ নিজেকে মানুষ বলে মনে করবে এবং পৃথিবীর অন্য সমস্ত মানুষকে (নর-নারী) জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বিশ্বাস, দেশ, ভাষা ও পোষাক নির্বিশেষে নিজের মতো মানুষ বলে বিবেচনা করবে এবং প্রত্যেক মানুষ পৃথিবীর অন্য মানুষের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে বলে মনে করবে। বিপদ আপদে সকলেই সকলের সাহায্যের জন্য অগ্রসর হবে। এমন ধারণাই প্রকাশ করেছেন তিনি তাঁর অধিকাংশ লেখনিতে।
তিনি মনে করতেন আমরা বিশ্ব মানব (নর- নারী) নানাভাবে বিভক্ত হয়ে আমাদের সেই মানবিক মহাসত্য, সরল বিশ্বাস ও ধারণাকে চেপে রেখে নিজেদের মধ্যে বিবাদ, বিসম্বাদ, ঘৃণা, শত্রুতা, হিংসা, বৈরীভাব ও অশান্তি টেনে এনে আস্তে আস্তে আমরা ধ্বংসের পথে চলছি। এরূপ ভাবে চললে আমাদের মধ্যে অশান্তি বাড়বে এবং পরিশেষে আমাদের ধ্বংস ও নির্মূল হতে হবে। এই গ্রন্থে তাঁর ব্যক্তিক জীবনের যে সমস্ত দিক উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁর সঙ্গীত সাধনার যে সমস্ত বিষয়াবলি সন্নিবেশিত হয়েছে এবং সর্বোপরি তাঁর যে সমস্ত কবিতা উপস্থাপন করা হয়েছে সব মিলে আপন মহিমায় তিনি সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন। পরিস্ফুটন ঘটেছে তাঁর সামগ্রিক চিন্তা ও চেতনার।”
ছবিতে: চমৎকার চিন্তাধারার অসাধারণ প্রতিভাধর কবির এই মূল্যবান বইটি সংগ্রহ করছি কবিপুত্র মাশরেকী শিপার ভাই-এর কাছ থেকে। তিনিও যেন বাবার যোগ্য উত্তরসূরি ‘কবিপুত্র কবি’। মাশরেকী শিপার ভাইয়ের কবিতাতেও বাবার কাব্যধারার ছাপ রয়েছে। তবে কিছুটা এগিয়ে আধুনিকতাকেও স্পর্শ করেছেন তিনি। গত মাসে এই বইটি সংগ্রহ করার সময় বাবার জীবনের নানা দিক স্মৃতিচারণ করতে করতে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন কবি শিপার ভাই। তখনই আমার মনে হয় এই বইটি সম্পর্কে দুটি কথা ফেসবুকে না লিখলেই নয়। সেই চেষ্টা থেকেই এই লেখাটি লেখা। ভবিষ্যতে বই ভালোভাবে পাঠ করে জ্ঞানার্জনের চেষ্টা করবো। ইচ্ছে আছে কিছু লেখারও।
কবিপুত্রর কাছ থেকে বইটি গ্রহণ করার সময় উপস্থিত ছিলেন বইয়ের লেখক-সম্পাদক কথাসাহিত্যিক আমির হোসেন। আমির স্যারকে ধন্যবাদ এমন একটি হারিয়ে যাওয়া রত্ন খুঁজে আমাদের সামনে নতুন করে উপস্থাপনের জন্য। ‘দার্শনিক কবি আব্দুল কাদের মাশরেকীর জীবন ও সাধনা’ নামক বইটি চেতনায় স্বদেশ গণগ্রন্থাগার, বুক ফেয়ার লাইব্রেরি, ঝিলমিল একাডেমিসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন লাইব্রেরিতে পাওয়া যায়। শুভেচ্ছা মূল্য ১০০ টাকা মাত্র। আগ্রহীদের সংগ্রহ করার অনুরোধ রইলো।
পাঠকদের ধারণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে কবি আব্দুল কাদের মাশরেকীর লেখা ‘মুসাফির’ নাম একটি কবিতা এইখানে সংযোজন করা হলো :
মুসাফির
দু’দিনের মুসাফিরি মানব জীবন,
ছিল না অস্তিত্ব যার, রহিবে না পরে;
আশা যাওয়া সবি মিছে ক্ষণিক স্বপন,
যা শোভিছে চারিদিকে থরে থরে থরে।
আপন বিস্মৃতি হেতু বৈচিত্র্য সৃজন
নিতি নব রূপ তব এ বিশ্ব মুকুরে
মূলে তব ভুলে যাওয়া স্বরূপ দর্শন
বিস্মৃতির অন্তে তব জ্ঞানের অঙ্কুরে।
নাভি গন্ধে মুগ্ধ ঐ মৃগের মতন
আনমনে আর কত কাল মুসাফির
হবে তুমি প্রতারিত কোন সে রতন
লভিতে বৈচিত্র্য মাঝে হইয়া অধীর?
হের মুসাফির তুমি শান্ত স্থির প্রফুল্ল অন্তরে
কোন রত্ন সিংহাসনে কাহারে করিয়া অভিষেক
কারে বা পূজিছ হৃদয়ের কোন অন্তপুরে
চুপি চুপি তাই তুমি তালাশিয়া দেখছ বারেক।
দর্পণে বিম্বিত তব সহাস্য বদন
কিম্বা মুখ ভ্যাংচানী তব
হেরিয়া কভু কি তুমি ওহে মুসাফির -
বলেছ কখনো তুমি
অথবা বলিতে পার কভু
নহে সে তোমার হাসি মুখ প্রীতি সমুজ্জ্বল
অথবা অপর কেহ কর্তা সেই মুখ ভ্যাংচানীর ?
অনন্ত বৈচিত্র্য পূর্ণ দৃশ্যমান জগৎ
নীতি নব ছন্দে গানে নীতি নব সুরে -
তোমারি সে অন্তহীন ভাবের ব্যঞ্জনা
রূপায়িত তব পঞ্চ মায়া মুকুরে।
তোমারি হাসিতে অই ভূধরে সলিলে
গহণ কান্তারে স্বচ্ছ সরসীর জলে,
নানা বর্ণে নানা ছন্দে ফুটে শত শতদল
করে কলি সেথা কেলি রাজ হংস হংসী দল।
------------------
পুনঃপাঠ: ‘দার্শনিক কবি আব্দুল কাদের মাশরেকীর জীবন ও সাধনা’
শুভেচ্ছাসহ
১৯ ডিসেম্বর ২৪
0 মন্তব্যসমূহ