বেডরুমের খাটটি ছোটো। একটি খাটে আমরা ছয় জন ঘুমাই। বেশ গাদাগাদি করে শুতে হয় আমাদের। উপায় নেই। খাটের একপাশে ছোট বাচ্চাটা ঘুমায়, ওর বয়স চার মাস। তারপর ওর মা। তারপর বড় বাচ্চা, ওর বয়স প্রায় সাত বছর। তারপর আমি।
গত মাসে আম্মা আসলেন বেড়াতে। দাদি আসলে ছোটটার মুখে যেন খই ফোটে। ওর ভাষায় কী কী যেন বলতে থাকে দাদীর সাথে। আর সে কথা তারা দুই বুড়িই ভালো বোঝে। রিমঝিম দাদীর সাথে ঘুমায়ও ভালো। আম্মা কীভাবে যেন ওকে বুকে জড়িয়ে রাখে। আর সেই জড়িয়ে রাখার পরশ পেয়ে রিমঝিম লম্বা এক ঘুম দেয়। আম্মাকে বললাম- রিমঝিম দেখতে তো সুস্থ সবল বাচ্চা। কিন্তু বিছানায় শুয়ে থাকলে সে নড়াচাড়া করে কম। আম্মা বলল- চার মাস বয়সে তো শরীর উলটপালট করার কথা ! তোর মেয়ে নড়া চাড়া করছে না কারণ তোদের বিছানাটি অনেক নরম।
ভেবে দেখলাম আম্মা ঠিকই বলেছে- আমার এই বিছানায় হোম ও তোশক দুটোই বিছানো আছে। দুটোই বেশ নরম হওয়ায় খাটে শুলে প্রায় ২/৩ ইঞ্চি নিচে ডেবে যায়। এমনকি রিমঝিম শুইলেও তার সামান্য শরীরের ভারে সেটি ডেবে যায়। ফলে রিমঝিম চাইলেও বেশি নড়াচড়া করতে পারে না। এভাবে বেশি দিন থাকলে ওর নরম মেরুদন্ড বাঁকা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আম্মা না বললে হয়তো বিষয়টা আমাদের মাথাই আসতো না।
এই আশঙ্কার কথা আম্মার তার ছেলের বৌওকেও বলেছে। এই জন্য বাচ্চার মা গত কিছুদিন যাবত ফ্লোরে আরেকটি তোশক বিছিয়ে ছোটো মেয়েকে নিয়ে নিচে ঘুমাচ্ছে। আমি একটু আলগা পিরিতি দেখাতে গিয়ে বললাম- আমার ছোটো আম্মুকে ফ্লোরে ঘুম পাড়াচ্ছো কেন ? এক খাটে সবার জায়গা না হলে তোমরা দুজন উপরে ঘুমাও, আমরা বাবা-মেয়ে (ঝিলমিল ও আমি) নিচে ঘুমাই। কিন্তু বাচ্চার মা বলল- না, রিমঝিমের ভালোর জন্যই নিচে ঘুমাচ্ছি।
দেখা গেল আমার আম্মার কথাই ঠিক। ২/১ দিনের মধ্যেই রিমঝিম সমান্তরাল বিছানা পেয়ে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। আবার সজাগ থাকলে বেশ নড়াচড়া করছে। আমি মাঝে মাঝেই মুগ্ধ হয়ে তা দেখি। ছোটো মেয়েটির মাথা নড়তে নড়তে কখনো বালিশ থেকে নিচে চলে আসছে। আর সেই মাথা উত্তর থেকে পূর্বে, পূর্ব থেকে দক্ষিণে, দক্ষিণ থেকে পশ্চিমে, পশ্চিম দিকে আবার উত্তরে ঘুরে যাচ্ছে। মেয়ের এই নড়াচড়া দেখে আমার মনে হল- একটি শিশু, একটি অবুঝ শিশু পৃথিবীর বিরাট জমিনে ঘুরে বেড়াচ্ছে মনের আনন্দে, আর বলছে- আমাকে স্বস্তিদায়ক, আরামদায়ক একটি নিরাপদ ও উপযুক্ত পৃথিবী বানিয়ে দাও। এমন পৃথিবী পেলে আমি ইচ্ছে মতো থাকতে পারবো, খেলতে পারবো, বিকোশিত হতে পারবো।
বেডরুমের খাটটি ছোটো। একটি খাটে আমরা ছয় জন ঘুমাতাম। দুজন এখন ফ্লোরে নেমে গেছে। খাটের উপর এখন আমরা চারজন ঘুমাই। আমি, আমার বড় মেয়ে ঝিলমিল আর আমাদের দুজনের দুটো কোল-বালিশ ।
যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
০৩ নভেম্বর ২৪
0 মন্তব্যসমূহ