বলছিলাম বৃষ্টির কথা। জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছে তাসফিয়া। বৃষ্টি দেখতে দেখতে হঠাৎ আমাকে জোরে জোরে ডাক দিল- আব্বু দেখে যাও, ওরা কী করছে, ওরা কী করছে !!! (তাসফিয়া যে বিষয়গুলোতে উৎসাহ দেখায়, আমরাও সেগুলোতে সমান উৎসাহ দেখাই। তাড়াতাড়ি গেলাম জানালার কাছে, বললাম- কে কী করছে, কে কী করছে, দেখাও আমাকে। তাসফিয়া বলল- আব্বু দেখো, একটা পাতা আরেকটা পাতাকে কীভাবে পানি দিয়ে দিচ্ছে।
বাসার উত্তর পাশের কিছুটা জায়গা জুড়ে ঝোপঝাড়। এই ঝোপঝাড়ের আশেপাশে কখনো ইঁদুর-বেজির দৌড়াদৌড়ি, বিড়াল-কুকুরের খাবার খাওয়া দৃশ্য কিংবা পাশের বাসার কয়েকটি পালিত খরগোশের ছোটাছুটি দেখে তাসফিয়া। অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে নিচু এই জমিতে পানি জমে যায়। এ সময়ে মাটির গর্তে থাকা ইঁদুর বেজিদের কী অবস্থা হয়, ওদের বাচ্চাগুলোতো সাঁতার শিখেনি তাদের কী হবে, এসব নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তা তাসফিয়ার !
এই ঝোপঝাড়ের মাঝখানে আছে একটি খেজুর গাছ। চারপাশে কলাগাছ, মেড্ডা, নারিকেল, মেহগনিসহ বেশ কিছু গাছ থাকায় সেসব গাছে নানা রকম পাখির আনাগোনা দেখা যায়। কাক, শালিক, চড়ুই, টুনটুনি, দোয়েল বা বুলবুলির মতো কমন পাখিতো আছেই, মাঝে মাঝে কাঠঠোকরা, ঘুঘু, আর নাম না জানা চমৎকার হলদে ডানার কালো পাখিও দেখা যায়। তাদের কলকাকলিতে ভোর হয়। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা হয়। হঠাৎ হঠাৎ রাত দুপুরেও ডেকে ওঠে কাক, প্যাঁচা কিংবা বাদুড়।
অপরপাশে একটি তিনতলা বাড়ির ছাদ বাগান জুড়ে নানা রকম ফুলের গাছ। পূর্বপাশের দোতলা থেকে ডালপালা নিয়ে নিচতলা অবধি ঝুলে পড়ছে মাঝারি সাইজের একটি বাগান বিলাস গাছ। কী চমৎকার গোলাপি রঙের ফুল ফুটে থাকে সারাবছর । দেখতে বেশ ভালো লাগে। এগুলো হলো তাসফিয়ার ‘প্রকৃতি পাঠ’। আমাদের বাসাটিও তিনতলায় হওয়ায় খুব সহজেই সবগুলো দৃশ্য চমৎকার দেখা যায়।
এই ঝোপঝাড়ের মাঝখানের একটা অংশে একা একাই গজিয়ে উঠেছে অনেকগুলো কচু-বাগান। বৃষ্টির ঝিরঝির ফোঁটা কচু গাছের উপর পড়ছে, সেখানে কিছুটা পানি জমে যেতেই পানির ভারে নাজুক সেই পাতাগুলো আস্তে আস্তে নিচে নুয়ে যেতে থাকে এবং সেই পানিটা গড়িয়ে তার নিচে থাকা অন্য পাতাতে পড়ে। অনেকটা আমরা যেমন দু-হাত এক করে অঞ্জলি ভরে পানি নিয়ে আরেকজনকে দেওয়ার মতো, দৃশ্যটি এরকম। তসফিয়া এই দৃশ্য দেখেই আমাকে ডাকতে থাকে।
তার ডাক শুনে জানালার পাশে গিয়ে আমিও অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম- তাসফিয়া আসলে একদম ঠিক ধরেছে, পাতাগুলো থেকে পানি এমনভাবে একটা থেকে আরেকটাতে গড়িয়ে পড়ছিল যে মনে হচ্ছে একটা পাতা আরেকটা পাতাকে নিজ থেকে পানি দিয়ে দিচ্ছে। হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল, কচু পাতায় পানি জমতে কিছুটা সময় লাগছে এবং সেই পানি গড়িয়ে পড়ছিল স্লো মোশনে, ফলের দৃশ্যটি দেখতে আসলেই খুবই নান্দনিক এবং কার্টুনের মতো মনে হচ্ছিল।
(কচুপাতায় যে পানি থাকে না বা কচু পাতা পানিতে ভিজে না, এই বিষয়টি তাসফিয়া আগেই জানে। আমরা তাকে টেংকেরপাড় পুকুরের পাশে গজে ওঠা কচু পাতায় পানি ঢেলে প্র্যাকটিক্যালি বিষয়টা দেখিয়েছিলাম। তাকে বলেছিলাম কচু পাতা হাইড্রোফোবিক বা ওয়াটারপ্রুফ)
আমি ওর মাকে ডেকে বললাম- দেখো তোমার মেয়ে কী আবিষ্কার করেছে। ওর মা এসে এই দৃশ্য দেখে সেও অবাক হলো। আমি বললাম- সারা জীবন ধরে কচুর গাছের উপর পানি পড়তে দেখলাম, বৃষ্টি পড়তে দেখলাম কিন্তু কখনো মাথার মধ্যে এই চিন্তা আসেনি যে একটা পাতা আরেকটা পাতাকে এভাবে পানি দিয়ে দেয়। কিন্তু তাসফিয়া এটা খেয়াল করেছে, কী অদ্ভুত তাই না। ওর আম্মু বলল- বাবা সাহিত্য চর্চা করে, মেয়েতো তার কিছুটা হলেও পাবেই। আমি বললাম- বড় হয়ে ওর যা ইচ্ছা তাই হবে, আমি করি বলেই ওকে করতে হবে, এমনতো কোনো কথা নেই।
0 মন্তব্যসমূহ