লোডশেডিং থাকায় ডিউটি স্টেশন থেকে বের হয়ে এলাম। বিদ্যুৎ চলে আসবে যে কোনো মুহূর্তে, তার আগে কিছুক্ষণ প্রাকৃতিক আলো বাতাস খেয়ে আসি। লোকনাথ দিঘির পাড়ে চতুর্পাশে সাজানোর বেঞ্চগুলোর একটিতে বসে মোবাইলের স্ক্রিনের উপর উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছিলাম। এসময় পঞ্চাশোর্ধ এক বৃদ্ধা মহিলা খুব করুণ সুরে ভিক্ষা চাইলো। এই পার্কে নানা বয়সী বিভিন্ন ভিক্ষুকের দেখা মেলে। স্বভাবত প্রত্যেক ভিক্ষুকই করুণ সুরে ভিক্ষা চায়। সবসময় তাদেরকে টাকা পয়সা দেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু আজ এই মহিলার করুণ সুরের মাঝে কেমন যেন একটি মায়া অনুভব করলাম।
হাতের মোবাইলটি পাশে রেখে ডান পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলাম, সেখানে একটি বিশ টাকার নোট ও একটি দশ টাকার নোট ছাড়া আর কিছু নেই। টাকা যে খুব বেশি নেই, তা আগেই জানা ছিল। টাকা বেশি থাকলে কত আছে মনে থাকে না, কিন্তু কম থাকলে কত কম আছে ভালো ভাবেই মনে থাকে। দশ টাকার নোটটি বের করে মহিলার হাতে দিলাম। মহিলাটি ছোট্ট করে আমার জন্য দোয়া করে অন্য বেঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল।
আমি পুনরায় মোবাইলে মনোযোগ দিলাম। কি মনে করে মহিলাটি আবারো আমার কাছে ফিরে আসলো। জানতে চাইলো- বাবা একটা কথা কইতাম, কিছু মনে করবা। বললাম- না; চাচি বলেন, কি বলতে চান ? মনে মনে ভাবলাম হয়ত আরো কিছু চাইবে। কাপড় চোপড় অথবা স্বামীর চিকিৎসার খরচ কিংবা ছেলে মেয়ের বিয়ের জন্য সাহায্য। মহিলাটি এসব না বলে আমাকে জিজ্ঞেস করল- আচ্ছা বাবা, মোবাইলের ভিতরেতো অনেক খবর দ্যাহা যায়, তাই না। এবার আমি একটু চমকালাম ! এই মহিলা কী খবর জানতে চায়, সেটি জানতে আমিও উৎসুক হয়ে বললাম- হ্যাঁ দেখা যায় চাচি, আপনি কী খবর জানতে চান?
তিনি বললেন- জিনিসপত্রের দাম কবে কম্বো বাজান; কিছু কি লিখছে ? আমার উৎসাহ কিছুটা কমে গেল। জিনিসপত্রের দাম কবে কমবে, এই জিজ্ঞাসা এখন একটি কমন প্রশ্ন। এটি নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিছুটা তাচ্ছিল্যের স্বরে বললাম- জিনিসপত্রের দাম একবার বাড়লে আর কি কমে চাচি, যে কয় টাকা কমে; বাড়ার হিসেবে তারে আর দাম কমছে বলা চলে না। মহিলা আমার কথা বুঝলো কি; বুঝলো না- গরিবের কি উপায় হবে, গরিব বুজি আর বাঁচবো না, আল্লাহ আমাদের রক্ষা করো- এসব বলতে বলতে অন্য দিকে এগিয়ে গেল।
মহিলাটি চলে যেতেই আমি ভাবলাম, এই মহিলা আমাকে কেনো এই কথা জিজ্ঞেস করল। পরক্ষণে মনে হলো- তাকে টাকা দেওয়ার সময় তিনি আমার মানিব্যাগ ব্যাগের দিকে একপলক তাকিয়ে ছিলেন। তিনি দেখেছেন সেখানে খুব বেশি টাকা নেই। সঞ্চিত ৩০ টাকা থেকে ১০ টাকা আমি তাকে দিয়ে দিয়েছি। হয়ত সে বুঝতে পেরেছিল জিনিসপত্রের দামের প্রভাব আমার মানিব্যাগেও পড়েছে। তাই হয়ত মাতৃ-বয়সী এই মহিলার আমার জন্য কিছুটা মায়া তৈরি হয়েছে। যে মায়ায় আমি তাকে ভিক্ষা দিতে উদ্ভূত হয়েছি, সেই একই মায়া তাকেও আচ্ছাদিত করেছে, তাই আপন ভেবে নিজের মনের কথাটি আমাকে কাছে জানতে চাইছে।
এসব নিয়ে খুব বেশি ভাবাভাবির অবকাশ নেই। দেশে যা হওয়ার হবে। মরলে মরবো। যতক্ষণ বেঁচে আছি, ততক্ষণ প্রাকৃতিক আলো বাতাস খেয়ে নিই। কবে না আবার এসবের উপরেও ট্যাক্স দিতে হয়, কে জানে ? আমি আবার মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। একটু আঙুল চালাতেই মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠল- “আজ পরীমনির ছেলের অন্নপ্রশাসন ॥ প্রথম ভাত খেলো পরিমনি ও রাজের ছেলে রাজ্য।” পোস্টের নিচে খেয়াল করলাম থ্রি-কে লাইক, ওয়ান পয়েন্ট ফোর-কে কমেন্ট, এইট হান্ড্রেড সিক্সটি ফাইভ শেয়ার।
অবাক হলাম না, আজকাল এসব গুরুত্বপূর্ণ পোস্টের ভিড়ে দ্রব মূল্যের মত সাধারণ বিষয়ের খবর খুব বেশি একটা চোখে পড়ে না। একটু পরেই হিরো আলম আর ভিপি নূরের কয়েকটি পোস্টও চোখে পড়ল। মজাদার শিরোনামের ভিনদেশের কিছু খবর নিয়ে পোস্টও চোখ এড়ালো না। এসব দেখতে দেখতে বিদ্যুৎ চলে এলো। আমি কাজে ফিরে এলাম। ক্ষুধার্ত মানুষের পেটের তাড়না নিয়ে আমার কোনো তাড়া নেই, আমার নিজের ক্ষুধা নিয়েও খুব বেশি ভাবি না।
অন্নপ্রাশন
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
২৬ সেপ্টেম্বর ২৩
টেংকেরপাড়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
( ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিষয়ক পত্রিকা ত্রৈমাসিক ‘মনন’ ম্যাগাজিনের এপ্রিল-জুন ২০২৪, সংখ্যায় প্রকাশিত)
0 মন্তব্যসমূহ