মানুষকে মানুষ হয়ে ওঠার জন্য প্রতিনিয়ত নিজের মধ্যে থাকা পশুত্ববোধকে বিসর্জন দিয়ে মানবিকতার গুণকে ফুটিয়ে তুলতে হয়। এই পশুত্ব বিসর্জন করাকেই আমার কাছে ‘কোরবানি’ বলে মনে হয়। যে মানুষ নিজের মনের পশুত্বকে বিসর্জন দিতে পারে না, সে মানবসমাজে বসবাস করা একজন দুপেয়ে পশু। সময়-অসময়ে তার আচার-আচরণে তা প্রকাশ পায়।
মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন-
وَ لَقَدۡ ذَرَاۡنَا لِجَهَنَّمَ كَثِیۡرًا مِّنَ الۡجِنِّ وَ الۡاِنۡسِ ۫ۖ لَهُمۡ قُلُوۡبٌ لَّا یَفۡقَهُوۡنَ بِهَا ۫ وَ لَهُمۡ اَعۡیُنٌ لَّا یُبۡصِرُوۡنَ بِهَا ۫ وَ لَهُمۡ اٰذَانٌ لَّا یَسۡمَعُوۡنَ بِهَا ؕ اُولٰٓئِكَ كَالۡاَنۡعَامِ بَلۡ هُمۡ اَضَلُّ ؕ اُولٰٓئِكَ هُمُ الۡغٰفِلُوۡنَ ﴿۱۷۹﴾و لقد ذرانا لجهنم كثیرا من الجن و الانس لهم قلوب لا یفقهون بها و لهم اعین لا یبصرون بها و لهم اذان لا یسمعون بها اولٓئك كالانعام بل هم اضل اولٓئك هم الغفلون ﴿۱۷۹﴾
অর্থ: আমি বহু সংখ্যক জ্বীন আর মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি, তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দিয়ে উপলব্ধি করে না, তাদের চোখ আছে কিন্তু তা দিয়ে দেখে না, তাদের কান আছে কিন্তু তা দিয়ে শোনে না, তারা জন্তু-জানোয়ারের মত, বরং তার চেয়েও পথভ্রষ্ট, তারা একেবারে বেখবর। (তাইসিরুল)
সুতরাং মানুষ হয়ে জন্ম নিলেই সবাই শ্রেষ্ঠ জীব একথা ভাববার অবকাশ নেই। কোরআনের ভাষ্যানুযায়ী মানবিকতা গুণ বিবর্জিত মানুষ পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট।
পশু কোরবানি বা কোরবানির ঈদ একটি এবাদত/উপাসনা/উৎসব/উপলক্ষ্য মাত্র। মূলত প্রতিবছর কোরবানি ঈদ এসে আমাদের সেই পশুত্ব বিসর্জনের বার্তা দিয়ে যায়। আত্ম উৎসর্গ/আত্মত্যাগ/আত্মশুদ্ধি/আত্মসমালোচনা নামে যা সারা বছর আমাদের চর্চা করতে হয়। কিন্তু আমরা কি তা করি ?
কোরবানির উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন-
لَنْ يَّنَالَ اللهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَٰكِنْ يَّنَالُهُ التَّقْوٰى.
অর্থাৎ ‘কোরবানির গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না বরং কোরবানির মধ্য দিয়ে তোমাদের আল্লাহ্ ভীতিই তাঁর কাছে পৌঁছে। (সুরা হজ: আয়াত ৩৯)
আয়াতের সরল ব্যাখ্যায় বলা যায়- মহান আল্লাহ তায়ালা কোরবানি নির্দিষ্ট করেছেন মানুষের আল্লাহভীতি পরীক্ষা করার জন্য। যে আল্লাহ ভীরু মানুষ কোরবানি ঈদের দিন আল্লাহর হুকুম পালন করার জন্য পশুর গলায় ছুরি চালান। তেমনি ভাবে তিনি সারা বছর আল্লাহর ভয়ে তাঁর সকল আদেশ-নিষেধ পালন করে চলেন। একজন আল্লাহ ভীরু মানুষ কখনো অপর মানুষকে কষ্ট দেয় না, ওপরের ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে না। একজন আল্লাহ ভীরু মানুষের পক্ষে কখনো ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি, ছিনতাই করার মতো ঘৃণিত অপরাধ হয় না।
হাদিসে বর্ণিত আছেন- আবূ হুরাইরাহ (রাযি.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ
অর্থ: যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে সে
ব্যক্তিই প্রকৃত মুসলিম। (তিরমিজি: হাদিস নং- ২৬২৭)।
মানুষ তার প্রায় সকল প্রকার কাজ প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে হাত দ্বারা করে থাকে। আর হাত দিয়ে করা যায় না যে কাজ তা হচ্ছে জিভা বা মুখ অর্থাৎ কথা বলা। এই কথা বলা এবং হাতের দ্বারা অন্য কোনো মানুষের কোনো ধরনের ক্ষতি না করার শর্ত পূরণকারীকেই হাদিসে বলা হচ্ছে মুসলমান।
এই
হাদিস দ্বারা আবার অমুসলমানদের ক্ষতি করা যাবে এমনটি ভাববার অবকাশ নেই। কারণ পবিত্র
কোরআনে আল্লাহ তায়ালা অপর এক আয়াতে বলেছেন-
وَلاَ تَسُبُّواْ الَّذِينَ يَدْعُونَ مِن دُونِ اللّهِ فَيَسُبُّواْ اللّهَ عَدْوًا بِغَيْرِ عِلْمٍ كَذَلِكَ زَيَّنَّا لِكُلِّ أُمَّةٍ عَمَلَهُمْ ثُمَّ إِلَى رَبِّهِم مَّرْجِعُهُمْ فَيُنَبِّئُهُم بِمَا كَانُواْ يَعْمَلُونَ
আল্লাহকে ছাড়া তারা যাদের আরাধনা করে, তোমরা তাদেরকে মন্দ বলো না। তাহলে তারা ধৃষ্টতা দেখাতে গিয়ে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালমন্দ করবে। (সুরা আনআম : আয়াত ১০৮)
সুতরাং একজন মুসলমান হিসেবে ও মুসলমান অমুসলিমদেরও মন্দ বলা ইসলামে নিষিদ্ধ। মন্দ বলা যেখানে নিষিদ্ধ ক্ষতি করারতো প্রশ্নই ওঠে না। সুতরাং একজন আল্লাহ ভীরু মানুষ কখনো মুসলমান/অমুসলমান কারো কোনো ধরনের ক্ষতি করতে পারে না। সেটা হাতের দ্বারা হোক অথবা মুখের দ্বারা। তাদের সহায়-সম্পত্তি, জান-মাল, ইজ্জত, আরু কোনো কিছুর ক্ষতি করার অধিকার ইসলামে মুসলমানদের দেয়া হয়নি।
তাছাড়া সুরা কাফিরুন: لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِىَ دِينِ (লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বিন) আয়াতের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। যেখানে আল্লাহ তার নবীকে বলতে বলেছেন- তোমাদের র্ধম (কর্ম ও কর্মফল) তোমাদের জন্যে এবং আমার ধর্ম (কর্ম ও কর্মফল) আমার জন্য।
উপরিউক্ত আলোচনায় একথা প্রতীয়মান হয় যে, কোরবানির উদ্দেশ্য মানুষের মধ্যে আল্লাহভীরুতা সৃষ্টি করে তাদের মধ্যে সকল খারাপ গুণকে বের করে নিয়ে তাকে ক্রমে মানবিক হয়ে ওঠা। প্রকৃতপক্ষে যিনি কোরবানি ঈদের দিন আল্লাহ ভীরু, তিনি আসলেই সারা বছরই আল্লাহ ভীরু থাকেন এবং আল্লাহ তায়ালার সকল আদেশ নিষেধ মেনে চলেন। এবং সুতরাং সারা বছর আল্লাহকে ভয় না পেয়ে তাঁর সকল আদেশ নিষেধ না মেনে চলে, শুধু কোরবানি ঈদের দিন পশু কোরবানি করা প্রকৃত কোরবানি নয়, বরং পশু হত্যা বা গোস্ত খাওয়ার উৎসবের নামান্তর। আবার গোস্ত বিলির নামে লোক দেখানো মানবিকতা- এবাদতে ‘রিয়া’র নামান্তর।
এখন আপনি নিজেই ঠিক করে নিন আপনি কি আসলেই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করছেন, না কি পশু হত্যা করছেন, নাকি গোস্ত খাওয়ার উৎসবে মেতেছেন ? নাকি একটি ধর্মীয় বিধান পালনে ‘রিয়া’ সংযুক্ত করেছেন।
ঈদ-উল-আযহার প্রকৃত উদ্দেশ্য আমাদের সকলের হৃদয়ে এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক।
সবাইকে
পবিত্র ঈদুল আযহার শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।
কোরবানির শিক্ষা: মানবিকতা বনাম পশুত্ববোধ।
মনিরুল
ইসলাম শ্রাবণ
১৭
জুন ২৪
নোট: এটি একটি পরীক্ষামূলক লেখা। আগামীতে আগামীতে বিষয়টি আরো যথাযথভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা কার হবে। এই লেখায় বর্ণানার সুবিধার্তে বর্ণিত আয়াত ও হাদিসের প্রথম অংশ ব্যবহার করা হয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ