Ticker

6/recent/ticker-posts

আপনা মাংসে হরিণা বৈরী

হাজার বছর আগে চর্যাপদের কবি ভুসুকু পা বলেছিলেন-‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।

একেতো হরিণের মাংস অনেক সুস্বাদু, তার উপর হরিণ দেখতে চমৎকার নাদুসনুদুস এক প্রাণী। আবার সে অনেকটা নিরীহ প্রকৃতির। সব মিলিয়ে বাঘ, সিংহ নেকড়েসহ অন্যান্য শিকারি প্রাণীরা দেখা পেলেই হরিণ শিকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমনকি মনুষ্য শিকারিরাও অবলা হরিণের উপর দয়া দেখায় না।

জঙ্গলের এই চিরন্তন সত্যকে সহজ ও সাবলীল শব্দে চমৎকার কাব্যিক উপস্থাপন করেছেন ভুসুকু পা। তিনি অবশ্য শিকার করার জন্য শিকারিদেরকে দোষারোপ না করে; উলটো হরিণকেই তার সৌন্দর্য, সুস্বাদু মাংস ও নিরীহ হওয়ার জন্য এক ধরনের দোষারোপ ও তিরস্কার করেছিলেন।

কবি এখানে এখানে সঠিক বলেছেন নাকি ভুল বলেছেন, সেই বিষয়টি ব্যাপক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা দেখে, এমনকি নিজের সাথে ঘটে যাওয়া নানা বিষয়গুলো আলোচনা করলে ভুসুকুপার কথাকেই সত্যায়ন করা যায়। অর্থাৎ হাজার বছর আগের জন্ম নেওয়া কবি ভুসুকুপা এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

সৌন্দর্য, জ্ঞান বা গুণ অর্থাৎ সকল প্রকার যোগ্যতা অনেক সময় মানুষের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের পৃথিবীতে এর ভুঁড়ি ভুঁড়ি উদাহরণ রয়েছে। 

প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসকে হেমলোক বিষপানে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল তার জ্ঞানের কারণে। সত্য প্রকাশ করায় বিখ্যাত ইতালীয় পদার্থ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক গ্যালিলিওকে রোমের পবিত্র দপ্তর থেকে একঘরে করার দণ্ড প্রদান করা হয়।

নিজের সততা রক্ষা করতে গিয়ে শাসকের প্রদান করার দায়িত্ব প্রধান বিচারপতির পদ নিতে অস্বীকার করায় কারাবরণ, বেত্রাঘাত, অর্ধহার-অনাহারে রাখা এবং সবশেষে বিষপানে হত্যা করা হয় বিখ্যাত মুসলিম ব্যক্তিত্ব ইমাম আবু হানিফা (রঃ) কে।

স্পার্টার রানি স্ত্রী সুন্দরী হেলেনকে অপহরণ করে ট্রয় নগরীতে নিয়ে যায় রাজকুমার প্যারিস। নিজেদের সম্মান ফিরে পেতে গ্রিকরা আক্রমণ করে ট্রয় নগরী। ১০ বছর চলা রক্তক্ষয়ী ট্রোজান যুদ্ধ শেষে ঐতিহাসিক ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়ে যায়।

উদয়পুরের রাজা ভীমসিংহের একমাত্র আদুরি সুন্দরী কন্যা কৃষ্ণকুমারী। মেয়ের মতই দেশের জনগণকে ও সমানভাবে ভালোবাসেন রাজা ভীমসিংহ। এদিকে কৃষ্ণকুমারীকে পছন্দ করে জয়পুরের রাজা জগৎ সিংহ এবং মেহরাবের রাজা মানসিংহ। কৃষ্ণকুমারীকে পাওয়ার জন্য জগৎসিংহ এবং মানসিংহ উদয়পুর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কি করবেন রাজা ভীমসিংহ? কন্যা কে বাঁচাতে গেলে রাজ্যে ধ্বংস হয় আর রাজ্য বাঁচাতে গেলে কন্যা কন্যাকে রক্ষা করা যায় না। এই কথা জানতে পেরে কৃষ্ণকুমারীর নিজেই আত্মহত্যা করে দেশের জনগণকে রক্ষা করে। ইতিহাস হোক অথবা সাহিত্য কিংবা নাটক- জ্ঞান, গুণ, সৌন্দর্য কিংবা যোগ্যতা অনেক সময় মানুষের ধ্বংসের কারণ হয়ে যায়- এসব তারই প্রমাণ।

ইতিহাস এবং সাহিত্য থেকে বের হয়ে এসে এবার নিজের দিকে বা নিজের আশেপাশে তাকিয়ে দেখুন। আপনাদের মধ্যে কেউ হয়ত ভালো কথা বলতে পারেন, কেউ ভালো লিখতে পারেন, কেউ ভালো ছবি আঁকতে পারেন, কেউ ভালো আবৃত্তি করতে পারেন, কেউ ভালো গান গাইতে পারেন, কেউ ভালো সংগঠক, কেউবা ভালো প্রকাশনা কাজ করতে পারেন। কেউ প্রযুক্তিকে ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারেন, কেউ ভালো রিপোর্ট লিখতে পারেন। 

আপনি অথবা এই ধরনের গুণ বা যোগ্যতা যারা রাখে সমাজের আর অন্য মানুষের চোখে তারা হিরো না হয়ে জিরো হয়ে যায়। পান থেকে চুন খসলেই তাদের উপর অন্যদের চোখ রাঙানো চলে। সামান্য ত্রুটিবিচ্যুতি হলে আর রক্ষা নেই। শাস্তি তার অবধারিত। আর ভুল ক্রমেই যদি বড় অন্যায় করে বসেন তবে তো মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত। সাধারণ মানুষ রক্ষা পেলেও জ্ঞানীগুণীরা পাবেন না। সমালোচনাতো নৈমিত্তিক ব্যাপার। 

এ সমস্ত জ্ঞান গুণ, যোগ্যতা দিয়ে তার কতটুকু সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি হল, সংগঠনে বা প্রতিষ্ঠানে তার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু বাড়লো অথবা তার অর্থনৈতিক লাভ কতটুকু হলো এসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়। বাস্তবিক কথা হল সৃজনশীল কাজ যারা করেন তারা অর্থনৈতিকভাবে খুব বেশি সমৃদ্ধ হতে পারেন না। দু একজন হয়ত ব্যতিক্রম। কিন্তু বেশিরভাগই এমন যে তারা অর্থনৈতিকভাবে একরকম বিপদগ্রস্ততার মধ্যেই দিন পার করেন। 

আবার যে একটু ভালো কাজ জানেন সবাই তখন সবাই তার ওপরেই আরো কাজ চাপিয়ে দেন। কাজের উপর কাজ চাপিয়ে দেবে। আবার দোষ তারই হবে। আর কাউকে বিনে পয়সা খাটানো গেলেতো কথাই নেই। আরেকজনকে খাটিয়ে নিজে অধিক লাভবান হতে পারেন সহজেই। অনেকেতো আবার অন্যের কাজ নিজের নামে চালি দিতে জুড়ি নেই।

কিন্তু দিনশেষে বদনামটা আবার তাদেরই হয় যারা কাজ করে বেশি। গুণের মর্যাদা না দিয়ে আমরা তাদের সমালোচনা করি। এমনকি সুযোগ পেলে তাদের ক্ষতি করতেও পিছপা হই না। এজন্যই বলা যায় গুণাগুণ, যোগ্যতা, সৌন্দর্য অনেক মানুষের ক্ষতির কারণ। এখানে কবি ভুসুকাপা সার্থক। তিনি সত্যিই বলেছেন, সঠিক বলেছেন- ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী। আপনার মত আমি নিজেও এর উদাহরণ।

আপনা মাংসে হরিণা বৈরী

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

৬ নভেম্বর ২৩

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ