Ticker

6/recent/ticker-posts

পাঠকের মৃত্যু


 

পাঠকের মৃত্যু

স্কুল জীবনে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল) রচিত ‘পাঠকের মৃত্যু’ নামে একটি ছোটগল্প পড়েছিলাম। উপরিউক্ত গল্পের সাথে আমার আজকের এই লেখার কোনো মিল নেই। তবে ‘পাঠকের মৃত্যু’ এই শব্দটি নিয়ে আমার এই লেখার অবতারণা।
সংযুক্ত ছবিটি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার, তাঁর নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল হক নাজু। তিনি গতকাল রাতে মৃত্যুবরণ করেছেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
নাজমুল আঙ্কেলের ছবিটির দিকে খেয়াল করে দেখুন তিনি হাসছেন, তাঁকে যখন থেকেই চিনেছি; তখন থেকেই এরকম হাসিখুশি দেখেছি। সম্ভবত আমার মত অন্যরাও তাঁকে হাসিমুখ ছাড়া কখনই দেখেননি। কোনো মানুষ মন থেকে ভালো, সুখী আর সুন্দর না হলে তার মুখে এরকম চমৎকার হাসি আসতে পারে না। ভণ্ডদের মেকি হাসি- দেখলেই বোঝা যায়।
উনার সাথে আমার ব্যক্তিগত কোনো ধরনের যোগাযোগ ছিল না। একই শহরে বসবাসের সূত্রে শুধু মুখ চেনায় পরিচিতি ছিলেন। রাস্তায় চলাচল করতে প্রায়ই উনাকে দেখতাম, উনার এই মিষ্টি হাসিটি অকারণেই ভালো লাগতো। তাছাড়া একজন মুরুব্বি ব্যক্তি ভেবে সালাম দিতাম। এই সালাম পর্যন্ত উনার আর আমার বাহ্যিক সম্পর্ক। তবে আত্মিক একটি সম্পর্ক আছে, সেটি একজন ক্ষুদ্রতম লেখকের সাথে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা পাঠকের সম্পর্ক। সে কথাই বলছি আজ।
প্রায় বছর দেরেক আগে একদিন বিকেলে লোকনাথ দিঘির মসজিদের পাশের পুকুর ঘাটলায় মুরুব্বি বয়সী বেশ কয়েকজন লোক বসা ছিলেন। এখানে সব সময়ই পরিচিত- অপরিচিত মুরুব্বিরা বসে থাকেন। এ পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সেদিন এক পরিচিত বড় ভাই আমাকে ডাকলেন। আমি কাছে গিয়ে সবাইকে সালাম দিতে, সেই ভাই একটা কথা জিজ্ঞেস করলেন, আমি যার উত্তর দিলাম। সেই মুহূর্তে সেখানে নাজমুল হক আঙ্কেল উপস্থিত ছিলেন। তিনি হঠাৎ সকলের সামনে বলে উঠলেন- এই ছেলেকে চেনেন, সে কিন্তু খুব ভালো লেখালেখি করে। আমি ফেসবুকে তার লেখা পড়ি।
নাজমুল আংকেলের কথাটি শুনে আমি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম। ৬০-৭০ বছরের বেশ কয়েকজন মুরুব্বি এবং বড় ভাইদের সামনে আমাকে লেখক পরিচয় করে দেওয়ায় একদিকে আমার লজ্জা লাগছিলো ঠিকই কিন্তু সত্যি বলতে কী- এক মুহূর্তের জন্য মনে তখন একটা ভালোলাগাও কাজ করছিল।
আমরা যারা টুকটাক লেখালিখি করি, আমাদের ফেসবুকে অনেক পাঠক পড়ে বা না পড়ে মন্তব্য করেন, কিন্তু ফেসবুকের কিছু পাঠক আছেন তারা বাইরে, রাস্তায় দেখা হলে- তোমার ঐ লেখাটা খুব ভালো লেগেছে, তোমার লেখালেখি ভালো, আরো ভালো চেষ্টা করো, দোয়া করি তুমি আরো বড় হও- এই জাতীয় কথাগুলো যখন কেউ বলেন তখন লেখালেখির উৎসাহটা আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

ঐ দিন নাজমুল আংকেল সবার সামনে আমাকে এই কথা বলার পর থেকে উনার প্রতি আমার ভালোলাগা আরো বেশি বেড়ে গেল। ফলে রাস্তাঘাটে দেখা হলে সালাম দেওয়াটা আগের থেকে বেশ উৎসাহ এবং জোরালো হতে লাগল। কিন্তু এর আগে বা পরে উনার সাথে আমার কথা হয়েছে বলে মনে পড়ে না।
তিনি এমনিতেই চমৎকার মানুষ, দেখতে স্মার্ট, চেহারায় বয়সের ছাপ নেই, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পড়েন, হাসিমাখা মুখ, তারউপর আবার আমার মত ক্ষুদ্র মানুষের লিখা পড়েছেন, পছন্দ করেছেন- এসব যখন ভাবি তখন উনার মৃত্যুর খবরটি আমাকে শোকাচ্ছন্ন করবে- এটাই স্বাভাবিক।
গতকাল উনার মৃত্যুর খবর শোনার পর দেখলাম ফেসবুকে অনেকেই তাঁকে নিয়ে পোস্ট করেছেন, আমি মূলত ঐ সমস্ত পোস্টের মাধ্যমে উনার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি। আমি আমার আইডি চেক করে দেখি উনার নামে কোন ফ্রেন্ড আমার আইডিতে নেই, তখন আমি নানান জনের পোস্টে উনার আইডি খুঁজতে থাকি এবং একটি আইডি পেয়েও যাই যেটা আমার ফ্রেন্ড লিস্টে নেই। এটি জানার পর আমি একটু অবাক হয়েছি। কারণ আইডিতে যুক্ত থাকলে নিয়মিত পোস্ট পাওয়া যায়, যুক্ত না হলে পাওয়া যায় না।
তাহলে উনি আমার পোস্টগুলো ঠিক কীভাবে দেখলেন বা পড়লেন। পরে মনে হল হয়ত যেহেতু অন্যদের সঙ্গে মিউচুয়াল ফ্রেন্ড আছে, সেই লিংক ধরে আমার আইডি পেয়েছেন এবং আমার লেখা পড়েছেন। অথবা উনার অন্য কোনো আইডি থাকতে পারে, যেটার সাথে আমি যুক্ত আছি। অথবা অন্য আইডি আছে বা ছিল, অনেকের আইডিইতো নানা কারণে ডিজঅ্যাবল হয়ে যায়। তিনি কোনো ভাবে আমার লেখা নিয়মিত পড়েন বা মাঝে মাঝে পড়েছেন এবং সেসব লেখা তাঁর লেগেছিল এজন্যই তিনি আমাকে নিয়ে খুব সহজেই সবার সামনে একটি ভাল মন্তব্য করে ছিলেন।
একজন লেখক নানা কারণে লেখালেখি করেন। কেউ নিজের জন্য, কেউ দেশের জন্য, কেউ সমাজের জন্য লেখেন। কেউ লেখেন পাঠকের জন্য। আমি কি জন্য লিখি বা কাদের জন্য লিখি- তা আমি আজও শিউর হয়ে উঠতে পারিনি। তবে লেখালেখি আমার ভালো লাগা একটি কাজ এবং নিজের ভেতর থেকে একটা তাগিদ অনুভব করিই বলেই কিছু লিখতে চেষ্টা করি। শুধু আমি কেনো ? নবীন-প্রবীণ সব লেখকরাই মূলত এরকম।
এই আমার ভালোলাগেকে যারা ভালোভাবে নেয়, তাদেরকে আমি আরও বেশি ভালোবাসি। তাদের কেউ যখন সরাসরি আমাকে উৎসাহ দেন, তখন সে ভালোলাগাটা যে বেড়ে যায়, তা আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি। সুতরাং একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুতে, একজন ভালো মানুষের মৃত্যুতে, আমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষীর মৃত্যুতে, এবং আমার লেখার একজন পাঠকের মৃত্যুতে, আমি গভীরভাবে শোকাহত।
আমি মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব নাজমুল হক আংকেলের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আমিন। আজকের এই বৃষ্টি ভেজা চমৎকার সন্ধ্যার মতই উনার কবরেও রহমতের বারি বর্ষিত হোক এবং মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করি তাঁকে যেন জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করেন। আমিন।
শ্রদ্ধেয় বাচিকশিল্পী মনির ভাইয়ের পোস্টের মাধ্যমে জানতে পারলাম, তিনি একসময় কলাম লিখতেন। আমার চেষ্টা থাকবে উনার কোনো বই অথবা যে কোনো লেখা পাঠ করার। কারো কাছে এ বিষয়ে কিছু তথ্য থাকলে আমাকে জানালে কৃতজ্ঞ থাকব।
ছবি কৃতজ্ঞতা: শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক আল আমিন শাহিন ভাই। পুনচ: আজ আপনার জন্মদিন। জন্মদিনে অফুরন্ত শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। যখন সাংবাদিকতা শেখার ইচ্ছে হয়েছিল, তখন আপনার কাছে হাতেখড়ি হয়েছিলাম। জন্মদিনের এই শুভ মুহূর্তে কৃতজ্ঞতা চিত্তে তা স্মরণ করলাম।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: পাঠকের মৃত্যু গল্পটি সম্ভবত সময় ১৯৯৮ সালে সপ্তম শ্রেণির সহপাঠ বইয়ে পড়েছিলাম। আমার এই লেখাটি লেখার আগে গল্পটি অনলাইনে খুঁজে নিয়ে আবারও পড়ে নিলাম। আমার এই লেখা থেকেও গল্পটি অনেক ছোটো। ইচ্ছে হলে আপনারাও আবার পড়ে আসতে পারেন।
পাঠকের মৃত্যু
৯ অক্টোবর ২০২৩
লোকনাথ দিঘিরপাড়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
All reactions:
12

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ