দিন দিন যন্ত্র হয়ে যাচ্ছি। অতিরিক্ত প্রযুক্তি নির্ভরতা আমাকে যেন অকার্যকর বানিয়ে ফেলছে ?
এমনিতেই আমি হুডুইরা পার্টির লোক। হুডুইরা মানে বোঝেন তো? মানে তেমন কোনো পরিশ্রমের কাজ করতে না চাও মানুষ। শারীরিক পরিশ্রম হয় এমন কোনো কাজ আমি সাধারণত খুব কমই করি। একেবারেই যে করি না, তা কিন্তু নয়। তবে কম করি। আমার বেশিরভাগ কাজ মনন ও মগজ কেন্দ্রিক। ফলে আমার মন-মগজে সব সময় এক ধরনের চাপ ও উত্তাপ কাজ করে।
সবার প্রতিটি কাজের কিছু ইন্সট্রুমেন্ট, যন্ত্রপাতি বা হাতিয়ার লাগে। আমার যন্ত্রপাতি বা হাতিয়ার মোট চারটি- কাগজ, কলম, মোবাইল, কম্পিউটার। এর মধ্যে প্রথম দুইটির ব্যবহার শতকরা দশ ভাগও করি না দ্বিতীয় দুটির ব্যবহারই সবচেয়ে বেশি।
দিনে ও রাতে খাবার, ঘুম, গোসল আর নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু কাজ বাদ দিলে বাকি সবটাই আমার মোবাইল অথবা কম্পিউটার স্ক্রিনের মধ্যেই কেটে যায়। (প্রতিদিন ১০/১২ ঘণ্টা)। মাঝে মাঝে কিছু ঘোরাঘুরি, আড্ডা, অনুষ্ঠান বা মিটিংয়ে গেলে কম্পিউটারের ব্যবহার বন্ধ হয়, তবে মোবাইল একেবারেই হাতছাড়া হয় না।
কথা, কাজের ফাঁকে ফাঁকে মোবাইলে ছবি তোলা, ছবি বাছাই, ফেসবুকিং অথবা পুরোনো লেখা এডিটিং করি। বলে রাখা ভালো, আমার অসংখ্য লেখা সম্পাদনা করি বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা মিটিং-এ বসে। ফলে আমার কোনো অনুষ্ঠান বা বক্তার বক্তব্য বোরিং লাগে না এবং সময়ও নষ্ট হয় না। আবার ভাববেন না আমি অনুষ্ঠান সম্পর্কে খুব বেশি অমনোযোগী বা তন্ময় থাকি। মোবাইল স্ক্রিন, মাইক্রোফোন বা বক্তার কণ্ঠ সবগুলো একসঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করার সমান চেষ্টা থাকে। অবশ্য বিশেষ বক্তার বক্তব্য পুরোটাই মনোযোগ দিয়ে শুনি। কারণ আমি মনে করি একজন ভালো বক্তার বক্তব্য শোন মানে অনেকগুলো বই পড়ার সমান।
এবার আসি আগের কথায়, প্রায় সবসময় একই সঙ্গে দুই একটি কাজ রান করাতে। আমার উপর ভরসা করে যে সমস্ত সিনিয়ররা নানা কাজের দায়িত্ব দিয়ে রাখেন। এসব না করে আমার অন্য কিছুর করার উপায় নেই। এই যেমন ধরুন মানুষ একটা ফেসবুক আইডিই ঠিক মত চালাতে পারে না। আর আমার নিয়মিত চালাতে হয় ৪/৫টি আইডি। অনিয়মিত হয় আছে আরো কয়েকটি। মাঝে মাঝে পোস্ট দিতে হয়, এমন আইডি আরো কিছু। ভাবছেন এতগুলো ফেক আইডি ? না একটাও ফেক আইডি না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি, সংগঠনের প্রতিনিধি হয়ে এইগুলো চালাতে হয় আমাকে। বেশিরভাগই বিনে পয়সার কাজ। তবে দুই তিনটা আছে প্রফেশনালা। মানে টুকটাক কিছু ইনকাম হয়। অনেকে এসব জানে, অনেকে জানে না। তবে আমার মজা লাগে এই ভেবে যে- আমি ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের কাজ ও লেখা লেখার চর্চা করতে পারি।
আচ্ছা- এই আজাইরা প্যাঁচাল কেন পারতেছি। কাজের কথা বলি।
যে মোবাইলটা আমি ব্যবহার করি তা প্রায় চার বছরের পুরোনো। অফিস থেকে লোন নিয়ে ১৭,৫০০ টাকায় কিনেছিলাম। লোনের টাকা শোধ হতে না হতেই মোবাইলটার কার্য ক্ষমতে কমে গেছে। মোবাইলটা ইদানীং খুব বেশি বিরক্ত করছে। ওর ফাংশনগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না। তাকে একটা করতে বললে, সে আরেকটা করে বসে। আমার যখন প্রচণ্ড স্পিডে কোনো অ্যাপসের ঢোকার কথা তখন সে ধীবরের গতিতে চলে।
আমার দ্বিতীয় প্রধান শক্তি হলো কম্পিউটার। ২০০১ প্রথম নিজ চোখে দেখার স্বপনের কম্পিউটার প্রথম হাতে পরশে পাই ২০০৬ সালে। প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি ১২ সালে। প্রথম হাতে ল্যাপটপ আসে এর পরের বছর ২০১৩ সালে। প্রায় তিন বছরে একটু একটু করে জমানো টাকায় কয়েক ধাপে ৫০ হাজার+ টাকায় কাবিন নামায় স্বাক্ষর করে প্রথম বউ হয়ে আসে সে। নিজের একখানা কম্পিউটার। ভাবতেই এখনো শরীরে রোমান্স অনুভব করি।
মোদ্দা কথা- যে কম্পিউটারটি আমি ব্যবহার করি, এটিও ৮ বছরের পুরোনো। প্রযুক্তির এডভান্সনেস আর আমার কাজের গতির সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না সে। শরীরের কল কব্জার কার্য ক্ষমতা কমে যাওয়ায় আমার সাধের এই কম্পিউটারটির তাই এখন সারাক্ষণ বেশ মেজাজ খারাপ থাকে। ওর মেজাজ ভালো করার জন্য মাউস থেকে কিবোর্ড, প্রসেসর থেকে হার্ডডিস্ক, কিবোর্ড বেশ যাতাকলের মধ্যে রেখেছে আমাকে। মাঝে কয়েকবার তার বেশ কিছু নারী, ভুঁড়ি, ব্রেন ও কলিজা পাল্টাতে হল। কয়েকবার তার ফুসফুসেও সমস্যা দেখা দিয়েছিল। ভাগ্যিস বাইপাস সার্জারি করতে হয়নি, করতে হলে উপায় ছিল না।
পায়ের নিচে থাকা পাওয়ার সাপ্লাইয়ের গুরুত্ব যে কতটুকু, তা হাড়ে হাড়ে টের পাই, যখন পাওয়ার সাপ্লাই এর ভেতরের ব্যাটারিটিও বলে আমাকে আর কত ধরে রাখবে তুমি- এবার তালাক দাও। ফলে তাকেও কয়েকবার পাল্টাতে হলো। তার উপরে ইন্টারনেটের ধীরগতি আর লোডশেডিং। এসব কথা বলতে গেলে লেখা গ্রেড ওয়াল চায়না না হলেও আইফেল টাওয়ার হয়ে যাবে।
সে যাই হোক- সবমিলিয়ে একগাদা কাজের চাপে মাথার প্রেসার লেভেল অনেক আপ করে ফেলেছে। হাসান দেশে থাকাতে আমার বেশ সুবিধে ছিল। সে আমার অনেকগুলো কাজ করে দিয়েছে। হাসান চলে যাওয়াতে আমি পড়েছি আরো বিপাকে।
সব মিলিয়ে দুচোখে অন্ধকার না দেখলেও ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি। নুন আনতে পান্তা ফুরায় মানুষ আমি, অর্থের প্রাচুর্য না থাকলেও অভাবকে অভাব বলতে রাজি নই। সারাজীবন বিপরীত আবহাওয়ার সাথে লড়াই করে আরো বিপরীতমুখী মানুষের সাথে ঘর-সংসার (বধূ- নয়) করে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক লড়াই করা মানুষ আমি।
আমার ঘরনি জানে- একদিন তার নিজের বাড়ি হবে। সে বাড়ির সামনে ও ছাদে ফুল, ফল ও সবজি গাছ লাগাতে পারবে। বাড়ির সিঁড়িতে জুতো পায়ে হাঁটতে হবে না তার। আমার কন্যা জানে- সে আর একটু বড় হলে তার নিজের একটি আলাদা রুম হবে। যে রুমে থাকবে, ছোট একটি ওয়ারড্রপ, একটি ছোট ড্রেসিং টেবিল, একটি পড়ার টেবিল আর খেলানা রাখার বড় একটি আলমারি।
আর আমি জানি- এসবের অনেক স্বপ্নই হয়তো কোনোদিন পূরণ হবে না। তা না হোক, স্বপ্ন দেখতে যেহেতু টাকা-পয়সা খরচ হয় না, তাহলে স্বপ্ন দেখতে দোষ কি ? টাকা ছাড়া হয়তো বাঁচা যায়, তবে স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচে কীভাবে। আর তাছাড়া আজ যা আমাদের কাছে নেই, তা যে ভবিষ্যৎ হবে না, এটা কে জানে। এখন যা যতটুকু আমাদের আছে, তাই তো আগে ছিল না।
এইতো সেদিনের কথা- প্রথমবার যেদিন স্থায়ীভাবে থাকার নিয়ত করে শহরে এলাম, সেদিন একেবারে খালি হাতে এসেছিলাম। বন্ধুর ম্যাচে উঠেছিলাম। ভ্যানের ভাড়া দিয়েছিলাম আরেক বন্ধুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে। মালামাল বলতে ছিল একটি বালিশ, দুইটি কাঁথা, একটি খাবার প্লেট, আরেকটি পানি খাবার গ্লাস আর কয়েক গাদা বই। আমার গ্রাম থেকে এই শহর ৩০ মিনিটি দূরত্বের পথ। বাড়িতে তখন আমার বাবার পেনশনের টাকায় বানানো পাকা বাড়িতে আমার থাকার জন্য আলাদা রুম ছিল। গ্রামের বেশ কিছু বাচ্চাকে আমি প্রাইভেটও পড়তাম। কিন্তু আমি রাগ করে চলে আসলাম এক অদ্ভুত শহরে।
দ্বিতীয়বার আবার যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসলাম তখনো পকেট খালি। কিন্তু জীবন তো খালি থাকেনি, থেমে থাকেনি। জীবন শুরু হয়েছে আগের চেয়ে আরো বেশি উদ্যম নিয়ে। যে উদ্যম অনেকের তীর্যক দৃষ্টি, মুখর সমালোচনা আর ষড়যন্ত্র উপড়ে ফেলে সকলের ভালোবাসার কাঠগড়া আমাকে দাঁড় করিয়েছে।
সমস্যা, সমালোচনা বা ষড়যন্ত্র এখনো থেমে নেই। মাঝে মাঝে ভাবি হয়ত হেরে যাবো, নয়তো থেমে যাবো অথবা দূরে কোথাও হারিয়ে যাবো। তারপরে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতোই দোয়া, আশীর্বাদ, সহযোগিতা আমাকে আবারো আশাবাদী করে তোলে।
আপনাদের দোয়া প্রার্থী
আত্মকথন-
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
০৭ অক্টোবর ২০২৩
টেংকেরপাড়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
0 মন্তব্যসমূহ