ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের জীবন ও কর্ম
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
১৮৮৫ সালের ১৬ এপ্রিল। সমগ্র ভারতবর্ষ তখন ব্রিটিশদের কব্জায়। ১২৮ বছর আগে ব্যবসা করতে আসা বেনিয়ার দল ছলে, বলে, কৌশলে ভারত জুড়ে বসিয়েছে তাদের দখলদার পতাকার খুঁটি। আর সে খুঁটি যেন গেঁথে গিয়েছে এ দেশের লাখো লাখো দেশপ্রেমিক মানুষের বুকে। ইংরেজদের শাসন, শোষণ আর অবর্ণনীয় অত্যাচারে অতিষ্ঠ ভারতবর্ষের মানুষ যখন নিজেদের মুক্তির পথ খুঁজে নিচ্ছে। দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতি, এমনকি ধর্মীয় মূল্যবোধের দৃষ্টিকোণ থেকেও যখন এই অঞ্চলের মানুষরা ইংরেজ শাসন শোষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছে। ঠিক তখনই তদানীন্তন পূর্ববঙ্গের ছোট্ট এক পরগনা সরাইল এর কালীকচ্ছ গ্রামে জন্ম নিলেন এক শিশু। সেদিন এই শিশুর জন্মে শুধু মাত্র তার নিকট আত্মীয়-স্বজন আনন্দিত হলেও তারা জানতেন না একদিন এই শিশুর জন্ম নিয়ে গর্ব করবে পুরো ভারতের মানুষ। নানা আয়োজনে তাঁর জন্ম-মৃত্যু দিবস উদ্যাপন করা হবে। তাঁর জীবন, কর্ম ও আদর্শ নিয়ে মানুষ আলোচনা করবে, বই লিখবে। নতুন প্রজন্ম তাঁর দেশাত্মবোধের চেতনায় উজ্জীবিত হবে। আর কেনই বা হবে না। অত্যন্ত ধুরন্ধর ও যোদ্ধা জাতী হিসেবে পরিচিত ইংরেজ সাম্রাজ্যের বুকের ভিতর স্বাধীনতার পেরেক ঢুকিয়ে দিয়েছে যে ব্যক্তি তাকে নিয়ে দেশবাসী গৌরব করাই কথা।
সেই ব্যক্তির নাম ছিল উল্লাসকর দত্ত। যে কয়েকজন বাঙালি ভারতীয় ইংরেজ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছেন উল্লাস কর দত্ত তাদেরই একজন। আর এই বীরের জন্ম বতর্মান ঐতিহ্যবাহী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার কালীকচ্ছ গ্রামে। অজো পাড়াগাঁয়ে জন্ম নিয়ে ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে নিজের নাম খোদাই নেওয়া নিতান্তই সহজসাধ্য ছিল না। নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে বোমা হামলা চালিয়েছেন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ও বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে বিপ্লবী হেমচন্দ্র দাস ও উল্লাসকর দত্ত তৈরি করেছিলেন সে বোমা। সে এই হামলা পুরোপুরি সফল না হলেও এই ঘটনা থেকে লাখো তরুণ যুবক অনুপ্রেরণা পেয়েছিল ইংরেজদের তাড়িয়ে দেয়ার আন্দোলন সংগ্রামী ঝাঁপিয়ে পড়তে। তারপর তাদের দেখানো পথে ভারত বর্ষের লাখ লাখ মানুষের আন্দোলন সংগ্রাম করে।
তাঁদের এই মহৎ ও সাহসী কর্মের জন্য জীবনের চরম মূল্য দিতে হয়েছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের এই মহান পুরুষকে। সেই ঘটনায় দায়ের করা আলিপুর বোমা মামলায় যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজাপ্রাপ্ত হন তিনি। জীবনে ১২ বছর জেলে থাকা এবং জেলে ইংরেজদের অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করার পরও তিনি মুক্তি পান। কিন্তু পরবর্তী জীবনে তিনি একরকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যার মধ্যে দিনপাত করেছেন। সারা জীবন অসংখ্য দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে জীবন পার করলেও ভারত যখন স্বাধীন হলো তখন এই বীর পেলেন জাতীয় বীরের মর্যাদা। ইতিহাসের পাতায় তিনি স্থান নিলেন কিংবদন্তি মহাপুরুষদের সাথে। ভারত ও পাকিস্তান এবং পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এ দেশের মানুষজন উল্লাসকর দত্তকে স্মরণ করে একজন মহান বীরের মর্যাদায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই কৃতী সন্তানকে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাসীও গর্বিত।
উল্লাসকর দত্তের সংক্ষিপ্ত জীবনী
ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত। ১৮৮৫ সালের ১৬ এপ্রিল তদানীন্তন অবিভক্ত বাংলার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার কালিকচ্ছ গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। তার পিতার নাম দ্বিজদাস দত্ত। উল্লাসকর দত্ত ১৯০৩ সালে এন্ট্রান্স পাস করে কলিকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। কলেজে পড়ার সময় ইংরেজ অধ্যাপক রাসেল বাঙালিদের সম্পর্কে কটূক্তি করার দরুন উল্লাসকর দত্ত তাকে জুতাপেটা করেন। এজন্য উল্লাসকর দত্তকে কলেজ হতে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এই সময় থেকে তার জীবনে পরিবর্তন আসে। তিনি প্রখ্যাত বাঙালি বাগ্মী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও লেখক বিপিন চন্দ্র পালের আগুনঝরা বক্তব্য শুনে অনুপ্রাণিত হন এবং দেশের পরাধীনতা, ইংরেজদের শোষণ, অত্যাচারে অসহ্য হয়ে বিপ্লবের পথে তিনি জীবনকে উৎসর্গ করেন।
বিপিন চন্দ্র পালের অনুপ্রেরণাতেই উল্লাসকর দত্ত প্রথমে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। পরে বিপ্লবী সংঘ ‘যুগান্তর’-এ যোগ দেন। তিনি বিস্ফোরক নির্মাণে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ৩০ এপ্রিল ১৯০৮ সালে প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসু বিহারের মজফ্ফরপুরে বিচারক কিংসফোর্ডকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনে তাদের গাড়িতে বোমা ছুড়ে মারেন। কিংসফোর্ড অন্য গাড়িতে থাকায় বেঁচে যায়, কিন্তু সেই গাড়িতে থাকা দুইজন ব্রিটিশ মহিলা ও গাড়ির ড্রাইভার নিহত হন। বিপ্লবী হেমচন্দ্র দাস ও উল্লাসকর দত্তের তৈরি বোমাই ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে আক্রমণে ব্যবহার করেছিলেন। বোমা হামলার পর সারা বাংলায় ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। এঘটনায় একটি মামলা হয়। যা আলিপুর বোমা হামলা মামলা নামে পরিচিত।
১৯০৮ সালের ২ মে গ্রেফতার হওয়ার পর উল্লাসকর দত্তসহ মোট ৩৭জন আলিপুর বোমা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হন। ৫ মে ১৯০৯ সালে ব্রিটিশ আদালতে বিপ্লবী বারীন ঘোষ ও উল্লাসকর দত্তকে ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে আপিলে ফাঁসির বদলে তিনি যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা পান। এসময় তিনি কালাপানি, আন্দামানের সেলুলার জেলে বন্দি ছিলেন। আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার জেলে উল্লাসকর দত্তকে শারীরিক নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়। এর ফলে তিনি সাময়িকভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
১২ বছর জেলে নির্মম অত্যাচারের শিকার হওয়ার পর ১৯২০ সালে তাকে মুক্তি দেয়া হলে তিনি কলকাতা শহরে ফেরত আসেন। এসময় মামলায় হাজিরা দিতে তিনি বারবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসেন। উল্লাসকর দত্তকে ১৯৩১ সালে আবারও গ্রেফতার করা হয় এবং ১৮ মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। মুক্তির পর তিনি গ্রামের টানে কালীকচ্ছে ফেরত আসেন এবং এখানে কয়েক বছর বসবাসের পর পুনরায় তিনি কলকাতা চলে যান। ১৯৪৭ এর ভারত বিভাগের পর তিনি গ্রামের বাড়ি কালীকচ্ছ চলে আসেন। এখানে ১০ বছর কাটানোর পর তিনি ১৯৫৭ সালে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। উল্লাসকর দত্ত তার শেষ জীবন আসামের শিলচরে কাটান এবং সেখানেই ১৯৬৫ সালের ১৭ই মে মৃত্যুবরণ করেন।
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ, পরিচালক-ঝিলমিল একাডেমি, সম্পাদক-কিচিরমিচির
তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা:
অশোক কুমার মুখোপাধ্যায় রচিত উল্লাসকর দত্তের ইতিহাস ও জীবনমূলক গ্রন্থ ‘অগ্নিপুরুষ’।
জয়দুল হোসেন, সভাপতি-সাহিত্য একাডেমি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
জহিরুল ইসলাম স্বপন, সভাপতি-উদীচী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা।
আমির হোসেন, সভাপতি-চেতনায় স্বদেশ গণগ্রন্থাগার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
ফেরদৌস রহমান, সাধারণ সম্পাদক-উদীচী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা।
উইকিপিডিয়া বাংলা, এবংলাইব্রেরিডটকম, স্যাটেলাইট চ্যানেল, জাতীয় ও স্থানীয় সংবাদমাধ্যম।
0 মন্তব্যসমূহ