Ticker

6/recent/ticker-posts

প্রত্যেকটি দুর্ঘটনাই এক একটি হত্যাকাণ্ড


 প্রত্যেকটি দুর্ঘটনাই এক একটি হত্যাকাণ্ড

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

এক্সিডেন্ট ইজ এক্সিডেন্ট বা দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলে, কপালের লিখন বলে আমরা মেনে নিই। ’ভাগ্যে ছিল তাই ঘটেছে’ ধরে নিয়ে আমরা অনেকেই ঘটনার অন্তরালে যাওয়ার চেষ্টা করি না। ফলশ্রুতিতে একেরপর এক ঘটে যায় নানা রকম দুর্ঘটনা। যার ফলে ঘটে ব্যাপক প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি। আড়ালে থেকে যায় এর হোতারা।

বড় বড় দুর্ঘটনা হলে আমরা ধরে নেই একটি তদন্ত কমিটি হবে। সাপ্তাহ খানেকের পর সেই কমিটি গতানুগতিক একটি রিপোর্ট দিবে। তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দেওয়ার আগেই ইলেকট্রনিক-প্রিন্ট মিডিয়া থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও চায়ের আড্ডায় নানান তথ্য-উপাত্ত, ছবি-ভিডিও শেয়ার, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে। তার সঙ্গে হুজুক-গুজব মিলেমিশে এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়, যা থেকে কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তা বের করে আনা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য হয়ে পরে। তারওপর এর সাথে রাজনীতি, ধর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য, গোষ্ঠীগত মতাদর্শ ও সাম্প্রদায়িকতা যুক্ত হয়ে বিষয়টি জটিল থেকে আরো জটিলতর হয়ে ওঠে।

ততদিনে তদন্ত রিপোর্টও চলে আসে। কিন্তু সেই রিপোর্ট আমরা মেনে নিতে চাই না। কারণ ততক্ষণে আমরা নিজেদের মতো একটি রিপোর্ট তৈরি করে তার উপর পূর্ণ আস্থা এনে ফেলেছি। সুতরাং তদন্ত রিপোর্ট নিজের মনমত হলে রির্পোটটি ঠিক আছে আর নিজের মতো না হলে তাকে ভুয়া বলে আখ্যায়িত করি। ফলে প্রকৃত তদন্ত রিপোর্ট বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আলোর মুখ দেখে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে তদন্তকারীরা দ্বিধায় পড়ে যান রিপোর্ট প্রকাশের ফলাফল পেয়ে মানুষ তার প্রতিক্রীয়া কী দেখাবে তাই ভেবে। তখন তারা সঠিক তদন্তে আরো সময় লাগবে বলে পাশ কেটে যেতে চান।

আবার বেশিরভাগ ঘটনার ক্ষেত্রে প্রথমদিকে আমরা যেভাবে আবেগ-উচ্ছ্বাস, ভালোবাসা, ক্ষোভ, নিন্দা, প্রতিবাদ প্রকাশ করি, পরবর্তীতে সেই ঘটনা কেন ঘটেছে, কিভাবে ঘটেছে আর কে কে তার জন্য দায়ী। সেই দায়ী ব্যক্তিদের পরবর্তীতে কি ধরনের শাস্তি হয়েছে বা যে ধরনের অসতর্কতা বা অসামঞ্জস্যতার কারণে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়েছে সেই প্রতিবন্ধকতাগুলোকে দূর করা হয়েছে কি’না তা আর খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করি না। ফলে ভিন্ন ভিন্ন সমস্যাতো আছেই একই সমস্যা স্থান-কাল-পাত্রভেদে চলতেই থাকে।

এবার মূল কথায় আসা যাক। ছোট-বড় প্রায় সকল দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অপমৃত্যুর মামলা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেগুলো হওয়া উচিৎ নিয়মতান্ত্রিক হত্যা মামলা। কেননা প্রত্যেকটি দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায় এক বা একাধিক ব্যক্তির দায়িত্বে অবহেলা, অনিয়ম, দুর্নীতি বা উদাসীনতার কারণে সেই দুর্ঘটনাটি সংগঠিত হয়েছে। কাজেই সেই দুর্ঘটনায় আহত-নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ  দেওয়ার পাশাপাশি ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরকে কঠোর শাস্তির আওতায় নিয়ে না আসলে এই সমস্ত দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না।

গত শনিবার রাতে চট্টগ্রামে সীতাকুণ্ডের কেমিক্যাল কন্টেইনারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা দেশে প্রথম হলেও বিস্ফোরক, কেমিক্যাল বা দাহ্য পদার্থের কারণে আগুন লাগার ঘটনা দেশে নতুন নয়। গত এক যুগে বাংলাদেশে বেশ কিছু বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গেছে। যেসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কয়েকশো মানুষ নিহত ও হাজারেরও বেশি আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। স্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করেছে আরো অসংখ্য মানুষ।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২০১০ সালে। সে বছর পুরান ঢাকার নিমতলীতে একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরিত হয়ে আশেপাশের ভবনগুলোতে আগুন লেগে যায়। ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডে মোট ১২৪ জন নিহত হন। একই বছর গাজীপুরের গরীব অ্যান্ড গরীব গার্মেন্টসে আগুন লেগে নিহত হন ২১জন ব্যক্তি। এর পরের বছর ২০১১ সালে সাভারের আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনে অরেকটি অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয় ১১২ জন মানুষ। যা আগুন লেগে মৃত্যুর ঘটনায় বাংলাদেশে দ্বিতীয়স্থান। ২০১৬ সালে আরেকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে টঙ্গীর টাম্পাকো ফয়েলস কারখানায়। সেখানে মোট ৪১ জন মারা যায়। 

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ৭০ জন, মার্চে বনানীর এফ আর টাওয়ারে লাগা আগুনে নিহত হয় ২৬ জন। ২০২০ সালে নারায়ণগঞ্জের একটি মসজিদে গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণে ১৭ জন নিহত হন। ২০২১ সালে কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৫ জন, নারায়ণগঞ্জের একটি জুস তৈরির কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৫২ অন্য জন, বছর শেষে সুগন্ধা নদীতে অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন লেগে নিহত হয় ৩৮ জন ব্যক্তি। যে গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ নারী ও শিশু। এসব অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক প্রাণহানি দেশে মানুষকে কাঁদিয়েছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন হাজার হাজার লোক। হয়েছে সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে নানান অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা মানুষের মনে এখনও ভয়ের দাগ সৃষ্টি করে আছে।

কিন্তু প্রত্যেকটি ঘটনার সময় ইলেকট্রনিক-প্রিন্টমিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় এমমকি রাজপথে দেশের জনগণ যেভাবে আলোচনা-সমালোচনা ও প্রতিবাদমুখর হয়েছে পরবর্তীতে সেই সেগুলো নিয়ে আর তেমন কোন কথা হয়নি। ফলে ওই ঘটনাগুলোতে দোষীদের বিরুদ্ধে ক্ষেত্রে কী শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্তদের কী ধরনের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে বা আদৌ দেওয়া হয়েছে কি’না, এই বিষয়ে আমাদের তেমন কোন মাথা ব্যাথা নেই। কোন দুর্ঘটনার পরপর আমাদের যে প্রতিক্রিয়া থাকে পরবর্তী সময়ে আমাদের যদি একই ধরনের প্রতিক্রিয়া অবশিষ্ট থাকতো তাহলে সরকার, প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট শিল্প-কারখানার মালিক-শ্রমিকসহ সবাই আরো বেশি সচেতন হতেন এবং দুর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেন।

২০২০ সালে লেবাননের বৈরুতে সংরক্ষিত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের ভয়াবহ বিস্ফোরণে  ১৫০ জন মানুষের মৃত্যু হয় এবং ৪,৫০০ জনেরও বেশি আহত হয়। সেই দুর্ঘটনায় সে দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। সেই ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নিলে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কন্টেইনার বিস্ফোরণের ঘটনা হয়তো আর ঘটতো না সীতাকুণ্ডের কন্টেইনার ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড     (H2O2 নামক একটি বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ করে রাখা হয়েছিল। আমদানি-রপ্তানি, মজুদ বা রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে যে ধরনের প্রক্রিয়া বা পরিবেশ দরকার হয় তা সেই স্থানে ছিল কি’না তা জানাতো দূরের কথা; শুনতে পেলাম একরকম গোপনে সেগুলো এখানে এনে রাখা হয়েছিল। কিছু দুষ্কৃতি মানুষের অন্যায়, অনিয়ম আর লোভের কবলে পড়ে চিরোতরে নিঃস্ব হয়ে গেলো অনেক পরিবার। এর দায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমি আমরা কেউ এড়াতে পারি না।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সকল দুর্ঘটনায় আহত-নিহতদের ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পাশাপাশি এ সমস্ত ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনার জোর দাবি জানাচ্ছি। এই দাবির পক্ষে আমাদের সবারই অবস্থান নেওয়া উচিত। কেননা এমন কোনো দুর্ঘটনার শিকার হতে পারি আপনি, আমি অথবা আমাদের কোন স্বজন।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কন্টেইনার বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত সকলের আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং যারা আহত হয়েছেন তাদের সুস্থতা কামনা করছি। ঐ অঞ্চলে যারা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ও আহত ব্যক্তিদের পাশে এসে নিজের সাধ্য অনুযায়ী দাড়িয়েছেন তাদের প্রতি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। মানুষের বিপদে মানুষই কাজে লাগে এই কথাটি যেন বাংলাদেশে বার বার প্রমাণিত হয় এই কামনা করছি। 


মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ 

সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। 

ই-মেইল mishrabon@gmail.com

তারিখঃ- ৫ জুন ২০২২খ্রি.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. সুন্দর সাবলিল গঠনমূলক লেখনী। এভাবেই চলুক কবির কলম...

    উত্তরমুছুন