বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও নানান সময়ে, নানান স্থানে ধর্ম অবমাননার মত অত্যন্ত ন্যক্কারজনক, ঘৃণিত কাজটি হয়ে থাকে বা করা হয়। নানান উদ্দেশ্য থেকে কখনো ইচ্ছাকৃত, কখনো অনিচ্ছাকৃত, কখনোবা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এই অপকর্মটি করা হয় ।
এর সঙ্গে যুক্ত হয় ধর্মীয় অনুভূতি, গুজব, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা, আধিপত্য বিস্তার বা জায়গা-জমি দখলের পায়তারা। আন্তরাষ্ট্রীয় ফায়দা হাসিলের জন্যও পরিকল্পিতভাবে ধর্ম অবমাননা করা হয় বলে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানারো হাতিয়ার হিসেবে ধর্ম অবমাননা কে বাছাই করে নেয় কিছু দুষ্ট প্রকৃতির মানুষ। যারা এসব কাজ করে তাদেরকে মানুষ না বলে অমানুষ বলাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত ।
ধর্মের উৎপত্তি বিশ্বাস থেকে। প্রত্যেক মানুষ যে যে ধর্মেই পালন করুক না কেন সে তার নিজ ধর্মকে সত্য জ্ঞান করে, পবিত্র মনে করে। মানুষের মনের মধ্যে বাস করা এই বিশ্বাস এবং পবিত্রতা যারা নষ্ট করতে চায় বা কষ্ট দিতে চায় তারা কখনো সত্যিকারের মানুষ হতে পারে না।
কারো কাছে যদি মনে হয় তার ধর্ম সত্য, অন্য ধর্মগুলি অসত্য। তবে সে সঠিক তথ্য প্রমাণ দিয়ে তার নিজের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করতে পারে । অপরপক্ষ হয়তো সেই যুক্তি মেনে নেবে, কিংবা মানবে না । সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার । কিন্তু কারো ধর্মীয় বিশ্বাস কে আঘাত করার অধিকার অন্য কারো থাকতে পারে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দেশে অনেক জায়গাতেই এই অনধিকার চর্চা হয়, ফলে প্রায়ই ধর্ম অবমাননার মত ঘটনাগুলো ঘটে।
দেশের কোথাও ধর্ম অবমাননার ঘটনা ঘটলে সে এলাকায় একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ, হামলা, ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, এমনকি মানুষ নিহত হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে।বরাবরই দেশের সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় উপাসনালয় ও বাড়িঘর ভাঙচুর একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে যে উদ্ভূত এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তার প্রভাব পড়ে পুরো বাংলাদেশে।
বাংলাদেশ, রাষ্ট্র, সরকার, সংবিধান, আইন ও বিচার, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধর্মীয় স্বাধীনতা, মত প্রকাশ ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার বিষয়গুলো বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়।
বিগত সময়ে কক্সবাজারের রামুতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে, রংপুরের গঙ্গাচড়ায়, ভোলার বোরহানউদ্দিনে, সুনামগঞ্জের শাল্লায় দেশের আলোচিত ধর্ম অবমানানা ও ধর্ম অবমাননাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঘটনাগুলো ঘটেছিলো।
ঘটনার পরপরই সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। পত্রিকাগুলো হেডলাইন হয় দিনের পর দিন। মামলা হয়, গ্রেপ্তার হয় আসামি। কিন্তু তারপরে কি হয় ? কিছুই না । একসময় আইনের ফাঁকফোকর বলিয়ে আসামিরা ছাড় পেয়ে যায়। কিছুদিন পর পর আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।
আমি মনে করি এর কারণ হচ্ছে অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি না হওয়া। ধর্ম অবমাননা এবং এর সাথে জড়িত ব্যক্তি এবং তার পরবর্তীতে যে বিশৃংখল পরিবেশ তৈরি হয় এসব ঘটনার সঙ্গে যারা দায়ী তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয় না বলেই ধর্ম অবমাননা ও সংঘর্ষের ঘটনাগুলির বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটে।
বিশ্বের প্রায় ৭১ দেশে ধর্ম অবমাননা আইন বা ব্লাসফেমি আইন রয়েছে। কিছুটা পরিবর্তন করে ব্রিটিশ শাসন থেকে বাংলাদেশেও এই আইনটি বলবৎ থাকলেও এর প্রয়োগ খুব বেশি দেখা যায় না। আবার অন্যান্য দেশের আইনের সঙ্গে বাংলাদেশের আইনের পার্থক্য হচ্ছে অনেক দেশে ধর্ম অবমাননানর জন্য যাবজ্জীবন এমনকি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। বিশেষত মুসলিম দেশগুলোতে।
আমাদের দেশের আইনে ধর্ম অবমাননার জন্য জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মাত্র দু'বছরের জেল, জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। শাস্তির এই নমনীয়তাই বারবার ধর্মীয় অবমাননা ও হামলা ভাংচুরের ঘটনা গুলোকে উৎসাহিত করে বলে আমি মনে করি।
তাই আমি দাবী জানাই বাংলাদেশের ধর্ম অবমাননা আইনটি আরো কার্যকর করা হোক। এর সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হোক। ইতিপূর্বে যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছে সেই সমস্ত ঘটনায় যারা দায়ী তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। তাহলে এই ধর্ম অবমাননামূলক ঘটনাগুলো ঘটবে না। দেশের কোথাও একটি ধর্ম অবমাননার ঘটনা ঘটলে সেকানে বিপুল সংখ্যক মানুষের জানমালের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। সে তুলনায় কোন একজন ব্যক্তির যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদণ্ড এটি খুব বৃহৎ শাস্তি নয়।
তবে এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো অনেকেই ভাববেন ধর্ম অবমাননার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হলে ব্যাক্তির বাক স্বাধীনতা বা মুক্তচিন্তা বাধাগ্রস্ত হবে কি’না । আমি মনে করি আইনে যদি এর যথাযথ ব্যাখ্যা রাখা হয় তাহলে আইনই বলে দেবে কোনটির ধর্ম অবমাননা আর কোনটি মুক্ত চিন্তা । আর কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলা নিশ্চয়ই ধর্ম নয়, মুক্তচিন্তাও নয়।
গতকাল কুমিল্লায় পবিত্র কুরআন শরীফ অবমাননার যে ঘটনা ঘটল তা নিঃসন্দেহে একটি ঘৃণিত কাজ। এটি ধর্ম অবমাননার চরমতম বহিঃপ্রকাশ। একটি ধর্মের সর্বোচ্চ সম্মানজনক ধর্মগ্রন্থ তথা মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল-কোরআন অন্য আরেকটি ধর্মের উপাস্যের পদতলে রাখার মত দুঃসাহস যে বা যারা করেছে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ছোটি একটি শাস্তি হবে মাত্র। একজন মুসলিম হিসাবে এই দাবিটি আমি করতেই পারি।
গতকালকের আগে বাংলাদেশের যে সমস্ত ধর্ম অবমাননার ঘটনা ঘটেছে তা ছিল সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্ম অবমাননা করা অর্থাৎ ফেসবুকে কোনো ছবি বা লেখা পোস্ট কারার মাধ্যমে ধর্ম অবমাননা করা।
এবারই প্রথম লক্ষ্য করলাম বাংলাদেশ সরাসরি পবিত্র কোরআন শরীফ অবমাননা করা হয়েছে। যা প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে নিঃসন্দেহেপীড়া দিবে। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটবে। বিষয়টি এত দৃষ্টিকটু যে ব্যক্তি সঠিকভাবে ধর্ম পালন করে না তার মনেও পবিত্র কোরআন শরীফের এই অবমাননায় ক্ষোভ সৃষ্টি হবে। এই ঘটনায় যে বা যারা জড়িত তাদেরকে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
আপনার পরিচিত কেউ এমনটি করলে সাথে সাথে তাকে নিবৃত করুন। প্রয়োজনে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সহায়তা নিন। একটি ক্ষুদ্র ঘটনা অনেক সময় বৃহৎ ঘটনার জন্ম দেয়। যার ভুক্তভোগী হতে হবে আপনি এবং অন্য সবাইকে। প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্মকে ভালোবাসুন, চর্চা করুন, অনুসরণ করুন পাশাপাশি অন্য ধর্মালম্বীদের কেউ শ্রদ্ধা করুন তাহলেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকবে। তাতে আপনিও নিজের ধর্ম সঠিক ভাবে পালন করতে পারবেন।
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ।
১৪ অক্টোবর ২০২১ খ্রি.
0 মন্তব্যসমূহ