ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর আবদুন নূর স্যারের চতুর্থ মৃত্যু বার্ষিকী আজ। ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর ভোর পাঁচটায় পৃথিবী লোক ত্যাগ করেন তিনি।
প্রফেসর আবদুন নূর স্যার সত্যিকার অর্থেই ছিলেন সূর্যের মত দীপ্তমান একজন মানুষ। আজীবন ছিলেন জ্ঞানতাপস। সারাজীবন শিক্ষকতা করা এই মানুষটি জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছেন লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে। আবদুন নূর স্যারের পরশ যারা পেয়েছেন তাদের বেশিরভাগই আজ সমাজের আলোকিত মানুষ হতে পেরেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলার নবীনগর উপজেলার বিটঘর গ্রামে ১৯৪৯ সালের ৩০ জুলাই (শিক্ষা সনদ অনুসারে) জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পিতা মোঃ মিলন মিয়া, মাতা আমেনা বেগম। ছোটবেলা থেকেই জ্ঞান অর্জনে ব্যাপক আগ্রহী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে অনার্স-মাস্টার্স করার পর শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। আজীবন তাই করছেন।
দেশের বিভিন্ন জেলায় শিক্ষকতা শেষে দায়িত্ব নিয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন এখান থেকেই। অধ্যাপনার পাশাপাশি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সংগঠক ছিলেন তিনি। এর মাধ্যমে তিনি তৈরি করেছেন অসংখ্য ছাত্র ও সংগঠককে। পরবর্তীতে এই কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে সফলতা সাথে নিজের কর্মজীবন সমাপ্ত করেন তিনি।
ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ও শিক্ষক হলেও বাংলা সাহিত্যে স্যারের ছিল অগাধ জ্ঞান, অবাধ বিচরণ। পাশাপাশি শিল্প ও সংস্কৃতিতে ছিল তাঁর ব্যাপক উপস্থিতি। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশে তাঁর অসামান্য অবদান রয়েছে। স্যারের লেখা নানান গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ এবং অনুবাদ সাহিত্য বিভিন্ন সময় জাতীয় ও স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে স্যারের বেশ কিছু বই। যার মধ্যে ‘দিনে দিনে আমি, লবণ সমুদ্র, ভ্যানেটি ব্যাগ, নাম দিবেন আপনি, ডিনার সেট” অন্যতম।
এ ছাড়াও মঞ্চ নাটকেও নূর স্যার ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তিনি নাটক রচনা করেছেন, নিদের্শনা দিয়েছেন, নিজেও করেছিলেন সুনিপুণ অভিনয়। একজন সুবক্তা হিসেবেও তার সুখ্যাতি ছিল সারা দেশ জুড়ে। বক্তৃতায় অসাধারণ পারদর্শী ছিলেন তিনি। স্যারের বক্তব্য কেউ একবার শুনতে শুরু করলে সে মন্ত্রমুগ্ধর মতো শুনেই যেতো।
মেধা-মননে, চিন্তা-চেতনায়, চলনে-বলনে, কর্মে ও ধর্মে, আচার-আচরণে তিনি সত্যিকার অর্থেই ছিলেন একজন আলোকিত মানুষ। কর্মগুণে নিজের নামকে তিনি যথার্থ প্রমাণ করেছেন। তিনি নামেও নূর, বিলিয়েছেনও নূর।
আজীবন সংগ্রামী আবদুন নূর স্যারকে অসুস্থতার সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে বারবার। ছোটবেলা থেকেই অসুস্থতার কারণে স্যারের পায়ে একটু সমস্যা ছিল। এই সমস্যা নিয়েই সারা জীবন চলেছেন এবং জয় করেছেন জীবনের সকল প্রতিকূলতাকে। জয় করেছেন মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। পায়ের সমস্যার কারণে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করতে পারাটা ছিল তাঁর আজীবন আক্ষেপ।
ক্যান্সার ধরা পড়ার কারণে মৃত্যুর ১০ বছর আগে মুখে দুই বার অপারেশন করতে হয়েছিল এবং চোয়ালের একটি অংশ ফেলে দিতে হয়েছিল। তারপর থেকে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারতেন না তিনি। স্যারের একমাত্র ছেলে কনক সাত-আট বছর আগে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। নিজের শারীরিক অসুস্থতা আর একমাত্র পুত্র হারানোর মানসিক বিষণ্নতা- সব মিলিয়ে ঘর বন্দী ছিলেন অনেক বছর। আর এসব কারণেই তাঁর জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল অনেক সোনালি সময়। তা না হলে আমরা স্যারের জ্ঞান ও প্রতিভার আলো আরো কিছুদিন পেতে পারতাম।
শ্রদ্ধেয় আবদুন নূর স্যার সম্পর্কে আমার খুব বেশি বলার সুযোগ নেই। কারণ আমি স্যারের সাহচর্য পেয়েছিলাম খুব অল্প সময়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হতে পেরেছিলাম স্যারের কারণে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র ভর্তি হয়েছিলাম স্যারের কারণেই। প্রায় এক যুগ পূর্বে তিনি আমার লেখা কিছু কবিতা প্রথম সংশোধনী করে দিয়েছিলেন। আমাদের আয়োজন করা প্রথম অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি। যে অনুষ্ঠান ছিল আমার জীবনের প্রথম উপস্থাপনা।
নূর স্যারের বাসায় অনেকবার গিয়েছি। নানা বিষয়ে স্যারের মূল্যবান কথা শুনে আসতাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় জীবনের ব্যস্ততায় আর নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নূর স্যারের সাথে আর যোগাযোগ রাখতে পারিনি। অথচ স্যার থাকতেন এই শহরেই।
স্যারের অসুস্থতার পর সাত-আট বছর আগে মাঝে মাঝে নূর স্যারের সাথে শহরের নানা জায়গায় দেখা দেখা হতো। স্যারকে সালাম দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বলতাম, স্যার আমাকে চিনতে পারছেন। অস্পষ্ট উচ্চারণের স্যার বলতো ‘কেন চিনবো না, তুমি আমার স্নেহের ছাত্র মনির’। আহ্ কত অকৃতজ্ঞ আমি। প্রিয় স্যারের স্নেহের মান ধরে রাখতে পারিনি। ঠিক থাকভাবে স্যারের খোঁজ নেইনি। আমার এই অপরাধের ক্ষমা আর কোনোদিন স্যারের কাছ নেয়া হবে না।
শহরের দক্ষিণ মৌড়াইল ৮১৮, ‘একটু ছায়া ভবনে’ ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর ভোরে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া এই কীর্তিমান পুরুষ।
নূর স্যারের মৃত্যু সংবাদ শুনে পুরো শহরে শোকের ছায়া নেমে আসে। একে একে আত্মীয় সহকর্মী, ছাত্র-শিক্ষক, ভক্ত-অনুরাগী ও এলাকাবাসীরা ভিড় জমাতে থাকে মরহুমের বাসায়। বাদ জোহর তার প্রিয় প্রতিষ্ঠান ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ মাঠে জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা নামাজের প্রাক্কালে স্মৃতিচারণ করে শোকানুভূতি ব্যক্ত করেন শহরের বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
এসময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ শিক্ষক পরিষদ, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইংলিশ এ্যালমনাই অ্যাসোসিয়েশন মরহুমের কফিনে ফুলেল শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন । পরে মোড়াইল কবরস্থানে মরহুমের একমাত্র ছেলে কনকের কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। প্রায় কয়েকশত লোক জানাজা নামাজে অংশগ্রহণ করেন।
মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, কন্যা-জামাতাসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। মহান আল্লাহতালার কাছে প্রার্থনা করি আল্লাহতায়ালা যেন আমাদের সকলের প্রিয় শিক্ষককে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন। আমিন।
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
২৯ ডিসেম্বর ২০
বিশেষ দ্রষ্টব্য: প্রফেসর আবদুন নূর স্যারকে নিয়ে যাদের বিভিন্ন স্মৃতিচারণ রয়েছে তারা এই পোস্টে কমেন্টস করতে পারেন। আগামী বছর আপনাদের থেকে নানা তথ্য নিয়ে এই লেখাটি আরো সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করব।
0 মন্তব্যসমূহ