Ticker

6/recent/ticker-posts

চাঁদ উঠেছে- ঈদ আসেনি


 

চাঁদ উঠেছে- ঈদ আসেনি

 

প্রতিবছর আনন্দ ও খুশির বার্তা নিয়ে আসে ঈদুল ফিতর। পশ্চিম আকাশে এক ফালি চাঁদ উঁকি দিয়ে মিষ্টি হেসে সেই খুশির বার্তা ছড়িয়ে দেয় সারা পৃথিবী জুড়ে। বিশ্ব মুসলিম সকল দুঃখ-কষ্ট ভুলে মেতে উঠে খুশি উৎসবে। ঘরে বাইরে মাঠে ময়দানে খুশির হাওয়ায় দুলতে থাকে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।

 

তবে সবার আকাশে ঈদের চাঁদ উঠলেও সবার ঘরে ঈদের আনন্দ আসে না। খবরে দেখলাম দেশের অনেক গার্মেন্টস কর্মীদের এবার ঈদের বেতন-বোনাস হয়নি। তাদের ঘরের চালে ঈদের খুশি উঁকি দিলেও ঘরের মাঝে সে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটেনি। ঈদের আগে এক শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারলাম দেশের নাকি অনেক মাধ্যমিক স্কুল এবং মাদ্রাসা শিক্ষকদের বেতন হয়নি। তাদের আম গাছ বাঁশ গাছের ফাঁকে ঈদের চাঁদ দেখা গেল তাদের পরিবারের জীবনে এবারের ঈদের আনন্দ আসেনি।

 

ঈদের আনন্দ আসেনি এরকম আরো অনেক সরকারি বেসরকারি অফিসে। যাদের মাসজুড়ে হার হাড় ভাঙ্গা খাটুনির পরেও মাস শেষে বেতন বোনাস তোলা সম্ভব হয়নি। আইন আর কাগজের মার প্যাচে ফেলে যে সমস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বোনাস আটকে দেওয়া হয়েছে- ঈদ আসেনি তাদের জীবনেও। এক ভাই জানালেন ঈদের দুই দিন আগে তাদের অফিস বন্ধ হবে। সেই দিনই তাদের বেতন বোনাস দেওয়া হবে। এই দুইদিন আগে বেতন বোনাস পেলে সেই ভাই তার পরিবারের জন্য কেনাকাটা করবে কখন। আহারে আমাদের সিস্টেম। অন্তত বেতন বা বোনাস যে কোনো একটা আগে দিতে পারত।

 

অনেকে বেতন-বোনাস দুটোই পেয়েছেন অথবা অনেকের ব্যাবসা ভালোই হয়েছে কিন্তু বেশির টাকা দিতে হয়েছে পাওয়াদারদের। তাদের কাছে ঈদ আনন্দ বড়শি উঠে ছুটে যাওয়া মাছের মতোই কষ্টের।

 

খতমে তারাবি পড়িয়ে হাফেজ সাহেব মোটা অংকের সম্মানী নিয়ে গেলেও পাঁচ ওয়াক্ত ইমামের ভাগ্যে জুটেছে খুব সামান্য অংকের টাকাই। অথচ ঈদের সম্মানী বেশি পাওয়ার দাবিদার ওয়াক্তিয়া ইমাম সাহেব। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জীবনে ঈদ আনন্দ খুব বড় রকম পার্থক্য নিয়ে আসে না। একবার শহরের এক মসজিদের খাদেম আমায় বলেছিলেন আমাদের মসজিদের সভাপতি বিভিন্ন জায়গায় মোটা অংকের দান খয়রাত করেন, শুধু ফান্ডে টাকা নেই অজুহাতে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন বা খাদেমদের বেতন যথা সময়ে দেন না। আচ্ছা- একটি মসজিদের খাদের বেতন কত ! অথচ দেশে এখন কত আলিসান মসজিদ।

 

মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত- তাদের ঘরেতো কখনোই ঈদ আসে না। নুন আনতে পান্তা ফুরায় যাদের- তাদের ঘরে কখনো ঈদ আসে না। কত দোকানপাট, শিল্পকারখানাসহ আরো নানা পেশার মানুষের বেতন থাকলেও ঈদ বোনাস হয় না। অথচ ঈদের মতো একটি উৎসবে অনেকগুলো টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়। যা নিয়মিত বেতন দ্বারা পূরণ করা সম্ভব হয় না। তাদের জীবনে কখনো ঈদ আসে না। ঈদ উপলক্ষে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রচুরবেচকেনা হয়। আবার এমনও অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ঈদের সিজনে তাদের ব্যবসা খারাপ হয়। ফলে সেই সমস্ত মালিক-কর্মচারীর ঘরেও ঈদের আনন্দ আসে না।

এই ঈদের দিনেও আমাদের কিছু জরুরি সেবাপ্রদানকারী ব্যক্তি, যেমন পানি বিদ্যুৎ গ্যাস, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও নিরাপত্তা কর্মীদেরও দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়। ঈদের আনন্দের দ্বারপ্রান্তেঅসুখ-বিসুখ, হত্যা, রোড এক্সিডেন্ট অথবা অন্যান্য দুর্ঘটনায় যারা মৃত্যু বরণ করেছেন তাদের পরিবারের সদস্যদের জীবনে এই ঈদ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে সারা জীবনের মত।

 

ঈদের আনন্দ নেই সুদূর ফিলিস্তিনে।গত ৭৭ বছর যাবৎই তারা এ আনন্দ থেকে বঞ্চিত। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন না হলে তাদের জীবনে কখনো ঈদের আনন্দ আসবে না।  সিরিয়া, লেবানন কিংবা ইউক্রনের আকাশেও ঈদের চাঁদ উঠেছে। শুধু ঈদটা আসেনি।

 

এসব এই ঈদের নতুন নয়। প্রতি বছর আমরা যখন নতুন জামা কাপড় পড়ে ঘুরে বেড়াই। আমরা যখন সেমাই পায়েশ আর আর নানা মুখরোচক খাবার খাওয়ায় ব্যস্ত থাকি। তখন একদল মানুষ ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। তখন একদল মানুষ জীবনের তাগিদে, জীবিকার তাগিদে লড়াই সংগ্রামে ব্যস্ত থাকে।

 

এই ঈদের দিনেও খোলা থাকে কত দোকানপাট, চায়ের দোকান, এই ঈদের দিনেও রিকশা সিএনজি অটো নিয়ে বের হয়ে যায় কত চালক। ঈদের দিনে কিছু টাকা বেশি ভাড়া চায় বলে আমরা তাদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করি। কিন্তু একবারও ভাবি আজকের এই খুশির দিনে তারা কেন পরিবারকে সময় না দিয়ে রাস্তায় বের হয়েছে?

 

তাদের মতো আরো অনেক খেটে খাওয়া, দিনমজুর, শ্রমিক মেহনতের মানুষের ঘরে ঈদ আসে না। বৃদ্ধ অসহায়, প্রতিবন্ধীদের ঘরে কখনো ঈদ আসে না। আমরা মাঝে মাঝে তাদের মাঝে সেবার হাত বাড়িয়ে দিন জামা কাপড়ে তাদের রাঙিয়ে তুলি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের মনে আমাদের মত ঈদের আনন্দ বাসা বাঁধে না। কোথাও না কোথাও  অতৃপ্তি, নিরানন্দ উঁকি দিয়ে তাদের মনকে বলে- তোমরাতো তাদের মত নও যারা আজ প্রাণ খুলে হাসে। তোমরাতো তাদের মত নও, যাদের ঘরে প্রকৃত পক্ষে ঈদের আনন্দ আসে । তাই প্রতিবছর আকাশে ঈদের চাঁদ উঠলেও সবার জীবনে ঈদের আনন্দ আসে না।

 

তবুও প্রতিবছর ঈদ আসে, আকাশে ভেসে ওঠে নতুন চাঁদ। হেসে ওঠে মানুষ। সেজে ওঠে স্থাপনা, দুলে উঠে প্রকৃতি। এভাবেই প্রতিবছর ঈদ আসে, ঈদ আসবে। অনেকে হাসবে, অনেকেই নীরবে চোখের পানি ফেলবে। আমরা যেন আমাদের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসকল দুঃখী অসহায় মানুষদের কথা ভুলে না যাই। আমরা যেন তাদের দুঃখের সারথী হই। আমরা যেন তাদের স্মরণ রাখি। আমরা যেন নিজের সাধ্য অনুযায়ী তাদের সাথে ঈদের আনন্দটা ভাগাভাগি করে নিই। ভোগে নয় ত্যাগেই শান্তি মর্মে উজ্জ্বিবিত হয়ে উঠি।

 

আমাদের এবং আমাদের আশেপাশের মানুষের জীবনে যতই থাকুক দুঃখ, যতই থাকুক কষ্ট, যতই থাকুক জ্বরা- তবুও ঈদ আসুক। আমাদের প্রাত্যহিক জীবন রাঙিয়ে উঠুক ঈদের আনন্দে। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।

 

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ 

১১ এপ্রিল ২৪

ব্রাহ্মণবাড়িয়া

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ