Ticker

6/recent/ticker-posts

বায়ান্ন থেকে একাত্তুর, সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতা


বায়ান্ন থেকে একাত্তুর, সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতা

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

“বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে চোখে ভেসে ওঠে/ কত চেনা ছবি; মা আমার দোলনা দুলিয়ে কাটছেন ঘুম পাড়ানিয়া ছড়া/ নানী বিষাদ সিন্ধু স্পন্দে দুলে দুলে রমজানি সাঁঝে ভাজেন ডালের বড়া/ আর একুশের প্রথম প্রভাত ফেরি, অলৌকিক ভোর”-(শামসুর রাহমান)। 

একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহিদ দিবস ও আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস। এ বছর ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্তি উদযাপন করছি আমরা। ১৯৫২ সালের এই দিনে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্টীয় ভাষার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আন্দোলন করেছে এদেশের আপামর জনতা। সেই আন্দোলনে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠির লেলিয়ে দেয়া পুলিশের গুলিতে শহিদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউরসহ নাম না জানা আরো অনেকে। কবির ভাষায় “মায়ের ভাষার মায়া মমতায়, জীবনের মায়া ভুলে/ ভরে দিল মার সবুজ আচল, রক্তে রাঙ্গানো ফুলে” - মিজানুর রহমান শেলী)

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবোধের উম্মেষ ও বাঙালির দীর্ঘদিনের পরাধীনতা থেকে মুক্তি ও একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রগঠনের সূতিকাগার। এই আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির লক্ষ্যে জাতীয় জাগরণের এক দীর্ঘ পথপরিক্রমার সূচনা। ভাষা আন্দোলন আমাদের পৃথক জাতিসত্তা, সমতা, সমন্বয়, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও আদর্শকে আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির চেতনার মর্মমূলে স্থান করে দিয়েছে। এই চেতনা বাংলা ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে এবং এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। 

ভাষা আন্দোলন ও একুশের চেতনাকে কেন্দ্র করে তৎকালিন সময় থেকেই দেশের কবি-সাহিত্যক-শিল্পীগণ নিজ নিজ দক্ষতা ও মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনা করেছেন অসংখ্য গল্প, কবিতা, গান, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক ও চলচিত্রসহ বিভিন্ন সাহিত্য ও শিল্পকর্ম। আর সৃষ্টিশীল এসব কর্মকা- এই জনপদের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে নিজেস্ব জাতীয়তাবোধের চেতনায়। তারই ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠে ছিলো পাকিস্তানি অত্যাচারী শাষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এক রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। আর সে আন্দোলন দীর্ঘ কন্টকময় পথ পেরিয়ে বাঙালি জাতিকে ধাবিত করেছে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের দিকে। 

অবশেষে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পেয়েছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র; বাংলাদেশ। কবি বলেছেন “ভাষার জন্যে লড়াই হলো/ লড়াই করে আস্থা পেলাম/ ভাষার জন্যে লড়াই করে/ স্বাধীনতার রাস্তা পেলাম” -(মসউদ উশ শহীদ)। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্য আরো সম্মৃদ্ধ ও শক্তিশালী হয়েছে। পেয়েছে আন্তর্জাতিক পরিচিত ও মর্যাদা। আর এ সব কিছুর পেছনে রয়েছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও একুশের চেতনা। 

মাতৃভাষার মুক্তির জন্য রক্ত দেওয়ার ইতিহাস পৃথিবীতে আর একটিও নেই। বাঙালিরাই একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য অকাতরে প্রাণ দিয়ে বিশ্বের বুকে এক কালজয়ী ইতিহাস গড়েছে। এই ইতিহাস আমাদের একান্ত নিজস্ব। তাই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আমাদের গৌরবের ইতিহাস, ঐতিহ্যের ইতিহাস, আমাদের অহংকার আর মর্যাদার ইতিহাস। ইউনেস্কো (জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা) এই দিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। ১৯৯৯ সাল থেকে পৃথিবীর প্রত্যেক দেশে আমাদের এই দিবসটি শ্রদ্ধার সাথে উদযাপন করা হয়। এটি বাঙালিদের জন্য বিরাট এক গৌরবের বিষয়। 

ভাষা আন্দোলনের সুত্রধরে আমাদের মাঝে বাঙালি জাতীয়তাবোধ চেতনার উম্মেষ ঘটেছে। আর এই চেতনা থেকে বাঙালি জাতি পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠির রাজনৈতিক, আ লিক, অর্থনৈতিক বৈষম্য বিরুদ্ধে স্বোচ্চার হয়েছে। ১৯৫৪ সালে যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচন, ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন, ৬৮ সালে ১১ দফার ছাত্র আন্দোলন, ১৯৭৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ সালে ঐতিহাসিক নির্বাচনে বিজয় লাভের মাধ্যমে বাঙালি জাতি তাদের স্বাধীকার অর্জনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। 

অপরদিকে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি জন্মের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানিরা নানান ভাবে বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার থেকে বি ত করেছে। তাদের স্বাধীকার আন্দোলনকে দমন করার জন্য হত্যা, জেলসহ নান ধরনের অত্যাচার চালিয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি ও ২৫ মার্চ সেই কাল অধ্যায়ের নিকৃষ্ট উদাহরণ। আর তাই মাতৃভাষার দাবি প্রতিষ্ঠাসহ বাঙালির যাবতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমাদের পৃথক ভূখ- প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না। 

পরিশেষে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতিরজনক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই স্বাধীন বাংলাদেশকে অর্জন করেছি। এবং সেই যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন ৩০ লক্ষ মানুষ, সম্ভ্রম হারিয়েছেন ২ লক্ষ্য মা-বোন। কাজেই ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ একই সুতই গাঁথা। কবির ভাষায় “ভাষা নিয়ে আন্দোলনে/ দুঃখসুখের কান্নাকাটি যতো/ সব কিছুকে পায় মাড়িয়ে/ স্বাধীনতা এলো বীরের মতো”-(রুহুল আমিন বাবুল)

বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের একুশে ফেব্রুয়ারি অমর ও অবিনশ্বর। ভাষা-আন্দোলন আমাদের জাতীয় জীবনে যেমন এনে দিয়েছে গৌরবময় তাৎপর্য, তেমনি আমাদের শিল্প-সাহিত্যকে নতুন প্রাণের স্পন্দনে প্রভাবিত করেছে। এছাড়াও ভাষা-আন্দোলন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে। বাংলা সাহিত্যে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক সাহিত্যকর্ম। 

প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে আমরা শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে শুধু ফুল দেয়ার মাধ্যমে ভাষা শহিদদের প্রতি আমাদের শ্রাদ্ধাবোধ ও দায়িত্ব-কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। ভাষা আন্দোলনের চেতনা আমাদের বুকে রাখতে হবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই চেতনাকে ব্যবহার করতে হবে মর্যাদার সাথে। 

মনে রাখতে হবে বিশ্ব সভ্যতার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আমাদের ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষা অবশ্যই শিখতে হবে, ব্যবহার করতে হবে, তবে সেটা মাতৃভাষাকে মোটও অবহেলা করে নয়। মাতৃভাষাকে ছড়িয়ে দিতে হবে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের কাছে। এই চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে হবে আমাদের আগামী প্রজন্মেও মাঝে। তবেই ভাষা শহিদদের আত্মত্যাগ সফল হবে। 


কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের ভাষায় বলি “হে নতুন প্রজন্ম/ ভুলে যেয়ো না সেইসব কিশোরের কথা/ যারা একদিন কচি গলায়/ বাংলাদেশের সব শহরের রাস্তায় রাস্তায়/ অজ কৃষ্ণচূড়া আর পলাশ ফুলের গন্ধে/ ফুটিয়ে তুলেছিলো আরেক রকম রক্ত-লাল-ফুল; রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”।

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ 

প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক 

ঝিলমিল একাডেমি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ