(বঙ্গ-রঙ্গ) লাল টিপ
ডিম ভাঙতে হবে ডিমের চিকন অংশ দিয়ে না’কি মোটা অংশ
দিয়ে এই নিয়ে দুই রাজার মধ্যে কথোপকথন হচ্ছে। তাদের কথোপকথন একসময় তর্কে রূপ নেয়, সেই
তর্ক শেষমেশ গড়ায় যুদ্ধে। সেই যুদ্ধে অংশ নেয় দুই দেশের হাজার হাজার সৈন্যসামন্ত। যুদ্ধ
স্থায়ী হয়েছিল অনেক বছর। মারা গিয়েছে প্রচুর মানুষ।
বলছিলাম অ্যাংলো-আইরিশ লেখক জোনাথন সুইফট রচিত বিখ্যাত
ধ্রুপদী সাহিত্য 'গালিভার ট্রাভেলস' এর ক্ষুদে মানব সম্প্রদায় লিলিপুটদের যুদ্ধের কথা।
সাহিত্যের সেই কাল্পনিক লিলিপুটদের দেশ যেন এখন আমাদের বাংলাদেশ। অবশ্য বাংলাদেশের
মানুষ এখন আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে আছে। আদার ব্যাপারির নাকি জাহাজের খবর নিতে নেই, তাই
এদেশের মানুষ ডিমের মতো এত বড়সরো বিষয়ের দিকে আর যেতে চায় না। ডিমের ভিতর থাকা কুসুমের
অন্তত ২০ ভাগের এক ভাগের সমান ক্ষুদ্র টিপ নিয়েও তারা তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে। এই
নিয়ে গৃহযুদ্ধ বেঁধে গেলেও অবাক হবো না। গত কয়েকদিন টিপের পক্ষে-বিপক্ষে এত যুক্তি-তর্ক,
বর্ণনা দেখে শুধু আমি কেন; যে কারো একথাই মনে হবে। তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে দেশীয়
অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষের খবর তো এদেশে নতুন কিছু নয়।
সামান্য একটি কালো বিন্দুর মধ্যে বাঙালির রাজনীতি,
সংস্কৃতি ও ধর্ম আটকে গেছে। টিপ পড়লে বাঙালির ধর্ম চলে যায়। টিপ না পড়লে বাঙালির সংস্কৃতিও
থাকেনা। রাজনীতির অন্যতম ইস্যু এখন টিপ। সংসদ থেকে চায়ের দোকান সব জায়গায় আলোচনার বিষয়বস্তু
এখন টিপ।এই নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। রাজনীতিবিদরা টিপ নিয়ে
রাজনীতি করছেন, ধর্মপ্রাণ-ধর্মজীবীরা টিপ নিয়ে ধর্মীয় বানী শোনাচ্ছেন।
সংস্কৃতিকর্মীরা টিপ নিয়ে আরো বেশি সরব, কয়েকজন কবি
টিপ নিয়ে কবিতাও লিখে ফেলেছেন। লিখেছেন গানও। বড় বড় সংবাদপত্রের ধারাবাহিক শিরোনাম
এখন টিপ। বাঙালি নারীদের সৌন্দর্য প্রকাশের চিরায়িত অনুসঙ্গ এই টিপের অপমানে কয়েকজন
পুরুষ টিপ পরে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। করেছেন মানববন্ধন। ৫৬ হাজার বর্গকিলোমিটারের বিশাল
এলাকার মানুষ সব কিছু ফেলে এখন ব্যস্ত সামান্য ১০/১৫ মিলিমিটার ব্যাসার্ধের টিপ নিয়ে।
বঙ্গদেশে ‘তিলকে তাল করার’ প্রবাদ বচনটি টিপ কাহিনীর সত্যিকার উদাহরণ।
বাঙালির ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটকে টিপ আলোচনায়
এসেছে বহুবার। কিন্তু টিপ এইবার তার নিজের পূর্বেকার সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। হাজার বছর অবহেলায় থাকা টিপ যেন এবার আমাদের বলছে
‘ক্ষুদ্র বলে কাউকে অবহেলা করতে নেই’। টিপ কাহিনীর সাথে সাথে আমার মনে অনেক বছর ধরে
উঁকি দেওয়া একটি প্রশ্ন উত্তর পেয়ে যাই। কি কারণে বাঙালিদের হাজার বছর বিদেশি শাসনের
করাল গত হতে হয়েছে ? পাকিস্তান, ব্রিটিশ, মোগল, পর্তুগিজ, ওলোন্দাজরা কেন হাজার বছর
ধরে বাঙ্গালীদের শাসন-শোষণ করেছে? উত্তর হচ্ছে যে, বাঙালিকে সামান্য টিপ নিয়ে দুই ভাগে
বিভক্ত করা যায় তাদেরকে শাষন-শোষণ করা খুব কঠিন কিছু নয়!
কথা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কবিতার কথা
মনে পড়ে যায়
সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছ বাঙালী ক’রে, মানুষ কর নি।
মাঝে মাঝে
ভাইরাল হওয়া আমাদের ছোট ছোট মানুষিকতাগুলো দেখে মনে হয় সত্যিই তো আমরা এখনো
মানুষ হতে পারিনি। মানুষ হলে আমাদের মধ্যে এতো বিভাজন কেন ? মনে হয় আকারে আমরা লিলিপুট
না হলেও মানুষিকতার দিক দিয়ে আমরা টিকই লিলিপুট।
একজনকে দেখলাম লিখেছে সৃষ্টিকর্তাও টিপের পক্ষে,
তিনি সূর্য ও চাঁদ দিয়ে আকাশের বুকে টিপ একে দিয়েছেন। (রসিক বাঙালি; পারেও বটে।)
চাঁদ, সূর্য
আকাশের বুকে একটি টিপ হয়ে শতশত গ্রহ নক্ষত্র সমৃদ্ধ বিশ্ব জগৎকে সুশৃঙ্খলিত
করে রাখলেও কারো কারো কপালের একটি সামান্য টিপ লাল-সবুজের বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষকে বিভক্ত করে ফেলতে পারে তা ভাবতেই অবাক লাগে।
লাল-সবুজের কথা মনে হতেই মনে পরলো আমাদের পতাকাতেও সবুজ এর মাঝখানে একটি লাল টিপের
কথা, ১৯৭১ সালে দেশেকে ভালোবেসে নিজেদের রক্ত দিয়ে যে টিপে এঁকে দিয়েছিলো জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান
বীরমুক্তিযোদ্ধাগণ। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে আমাদের এতো বিভাজন দেখলে মনে প্রশ্ন
জাগে, মুক্তিযুদ্ধ যদি এই সময় হতো তাহলে আমরা কি বিজয়ী হতে পারতাম ! নাকি পৃথিবীর অনেক
দেশেরমত গৃহযুদ্ধ চলতেই থাকতো।
প্রিয় পাঠক, আপনি ছেলে-মেয়ে যাই হোন, যে কোন ধর্মের,
দলের, মতের হোন, টিপের পক্ষে-বিপক্ষে হোন, কপালে টিপ পরেন আর নাই পরেন, বুকের মাঝে
আমাদের পতাকার লাল টিপ-কে স্থান দিলে শুধু টিপ কেন কোন কিছুই বাঙালি হিসেবে আমাদের
বিভাজন করতে পারার কথা না। তাই দেশকে ভালোবাসুন, দেশের মানুষেকে ভালোবাসুন।
তাছাড়া একজন মানুষ হিসেবে অন্য মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস,
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, তার কৃষ্টি, পোষাক-পরিচ্ছেদ, খাদ্যাভ্যাসের প্রতি আমাদের ন্যূনতম
শ্রদ্ধাবোধ থাকার কথা। যে শ্রদ্ধাবোধ অন্যদের কাছ থেকে আমরা নিজেরা আশা করি। তাই দাড়ি,
টুপি, তসবি, পাঞ্জবি, বোরখা, হিজাব, টিকি, পৈতা, ধ্যুতি, টিপ, তিলক, শঙ্খ, শাখা, ক্রুশ
ইত্যাদি কোন ধর্মী প্রতিক বা চিহ্ন সহ অন্য
যেকোন র্স্পকাতর বিষয় নিয়ে কারো সাথে তর্কে-বিতর্কে জড়ানোর পূর্বে আসুন আমরা
“সবার আগে মানুষ হই”।
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ।
৬ এপ্রিল ২০২২খ্রি.
x
0 মন্তব্যসমূহ