Ticker

6/recent/ticker-posts

সাহিত্য একাডেমির ৩৭তম বৈশাখী উৎসব

ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বর্ণাঢ্য আয়োজন

সফলভাবে অনুষ্ঠিত হলো সাহিত্য একাডেমির ৩৭তম বৈশাখী উৎসব

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ



হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত আবহমান বাংলা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ পহেলা বৈশাখ। বিশ্বায়নের এই যুগে আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অপসংস্কৃতির করাল গ্রাসে বাংলা সংস্কৃতি যখন নিমজ্জিত হয়, তখন প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ এসে আমাদেরকে নিজস্ব সংস্কৃতিতে উজ্জীবিত হতে প্রেরণা দেয়। আমাদের বাঙালিয়ানায় উদ্বুদ্ধ করে। তাই বৈশাখী উৎসব বাঙালির প্রাণের উৎসব, জাতীয় উৎসব। বাঙালি প্রাণের এই উৎসবকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের প্রতিটি জেলা উপজেলা এমনকি গ্রাম পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয় মেলা, বান্নীসহ নানান রকম অনুষ্ঠান। বেশ কয়েক বছর যাবত সরকারি আয়োজনেও অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপিত হচ্ছে।

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির রাজধানী বলে সুপরিচিত, বহু জ্ঞানী-গুণির জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এই জেলার প্রধানতম শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠন ‘সাহিত্য একাডেমি’ প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে বাঙালির সার্বজনীন এ উৎসবটি নিয়মিতভাবে আয়োজন করে যাচ্ছে। ১৩৯৪ বঙ্গাব্দ, ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম উদ্যাপিত উৎসবটি তিন দিনব্যাপী হলেও পরের বছর থেকে উৎসবটি সাত দিনব্যাপী পালিত হচ্ছে। জেলার শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর (ইন্ড্রাস্ট্রিয়েল স্কুল চত্বর) অনুষ্ঠিত এই মেলাকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও সর্বস্তরের জনগণের এক মহামিলন কেন্দ্রে পরিণত হয়।

মেলা চত্বরের ভিতরে এবং বাহিরে নানান ধরনের পণ্যের দোকানে ব্যাপক বেচাকেনাও হয়। উৎসবের মূল আয়োজনে থাকে প্রতিদিনের আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রতিদিন এসব অনুষ্ঠানে দেশবিদেশের নানা শ্রেণি-পেশার বরেণ্য ও গুণি ব্যক্তিবর্গ এসব আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করে থাকেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্থানীয় ও দেশের গুণি শিল্পীদের অংশগ্রহণে নাচ-গান, কবিতা আবৃত্তি, নাটক, পুতুল নাচ, বাউল সংগীতসহ নানা লোকজ পরিবেশনায় মুগ্ধ হয় হাজার হাজার দর্শক।

সাহিত্য একাডেমি আয়োজিত এবারের সাঁইত্রিশতম বৈশাখী উৎসবে পবিত্র রমজান ও ঈদুল ফিতর শুরু হওয়ার কারণে তা পিছিয়ে নিয়ে ছোট পরিসরে তিন দিনের জন্য আয়োজন করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলার ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব গত ১৭, ১৮ ও ১৯ বৈশাখ ১৪৩০ (৩০ এপ্রিল, ০১ ও ০২ মে ২০২৩ রবি, সোম এবং মঙ্গলবার) শহরের ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর (ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুল মাঠে) তিন দিনব্যাপী এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

গত ৩০ এপ্রিল বৈশাখী উৎসব উদ্বোধন করেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিশিষ্ট কবি ও গীতিকার মো. আ. কুদ্দূস, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মো. বাহারুল ইসলাম মোল্লা, সাহিত্য একাডেমির সভাপতি কবি ও গবেষক জয়দুল হোসেন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি দীপক চৌধুরী বাপ্পী। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বৈশাখী উৎসব উদ্যাপন পরিষদের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মানিক রতন শর্মা। সভাপতিত্ব করেন- বৈশাখী উৎসব উদ্যাপন পরিষদের আহ্বায়ক উপাধ্যক্ষ একেএম শিবলী।

উদ্বোধন অনুষ্ঠান মালার শুরুতেই মঙ্গল শোভাযাত্রা, লাঠিখেলা ও মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে তিন দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। উদ্বোধনী দিনে সাহিত্য একাডেমির পরিবেশনায় ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’ নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। এছাড়াও এদিন আনন্দলোক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর পরিবেশনায় সংগীত ও নৃত্যানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।

১৮ বৈশাখ, ১ মে বৈশাখী উৎসবের দ্বিতীয় দিনে ‘বিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক চর্চার গুরুত্ব’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড কুমিল্লা এর উপসচিব মোহাম্মদ সাফায়েত মিয়া। সাহিত্য একাডেমির উপদেষ্টা ও অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফরিদার নাজমীন-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন দি ব্লুমিং ফ্লাওয়ার কিন্ডারগার্টেন-এর পরিচালক অ্যাডভোকেট তারিকুল ইসলাম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন তাজুল ইসলাম বাবু। এদিন ‘৪০ বছরে সাহিত্য একাডেমি ও বাঙালির সাংস্কৃতিক চর্চা’ শীর্ষক একক বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলা একাডেমির গবেষক মামুন সিদ্দিকী। বক্তব্যে তিনি বলেন- বাঙালির জীবন ও জীবিকা, বিশ্বাস, রীতিনীতি, কৃষ্টি ও কালচারের যতগুলো উপাদান রয়েছে, সাহিত্য একাডেমি বিগত ৪০ বছর যাবত এ সকল কিছুকে নিয়েই ধারাবাহিকভাবে ছোট-বড় বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে।

মেলার দ্বিতীয় দিনের সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় ছিল ‘মে দিবসের কবিতা আবৃত্তি’। আবৃত্তি করেন বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ-এর প্রকাশনা সম্পাদক জিএম মোর্শেদ। এদিন স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনের মধ্যে তিতাস আবৃত্তি সংগঠন, আবরনি আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র, ভাষা ও সাহিত্য অনুশীলন কেন্দ্র এবং বজলুর রহমান পাঠাগারের সদস্যরা দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করে। এছাড়াও সাহিত্য একাডেমির পরিবেশনায় নাটক ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’ মঞ্চায়ন করা হয়। এ দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর সাতমোড়া আনন্দ আশ্রমের শিল্পীদের পরিবেশনায় ঐতিহ্যবাহী ‘মলয়া সংগীত’ পরিবেশন করা হয়। এই সংগীত পরিবেশন করেন সরূপ রতন দত্ত, রিমা দাস। এদিন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।

১৯ বৈশাখ, ০২ মে ছিল মেলার সমাপনী দিন। মেলার সমাপনী দিনে সাহিত্য একাডেমির সভাপতি জয়দুল হোসেন-এর সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সাহিত্য একাডেমির জীবন সদস্য রিফাত আমিন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন। সমাপনী দিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কর্মসূচির মধ্যে ছিল স্বরচিত কবিতা পাঠ, মঞ্চ নাটক, সংগীত, নৃত্যানুষ্ঠান ও বাউল সংগীত। স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন বরেণ্য কবি শাহেদ কায়েস, কবি খোকন মাহমুদ, স্নিগ্ধা বাউল, কবি মনিরুজ্জামান মিন্টু। এদিন মৈত্রী থিয়েটার, টিএসসি-ঢাকা কর্তৃক পরিবেশিত হয় নাটক ‘চা অথবা কফি’। এছাড়াও ‘সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন’ ব্রাহ্মণবাড়িয়া কর্তৃক পরিবেশিত হয় সংগীত ও নৃত্যানুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয় গ্রাম বাংলার ঐহিত্য বাউল সংগীত পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে। সৈয়দ সালাউদ্দিন মকুল-এর পরিকল্পনা ও উপস্থাপনায় নাসিরনগরের ‘বাউল জারু মিয়া ও অমিয় ঠাকুর সঙ্গীতাঙ্গন’-এর শিল্পী রাতুল চক্রবর্তী, পতিত পবন মজমুদার,  মামুনুর  রশিদ, অজয় মিহির দাস, সুশান্ত কুমার দাস ও নান্নু মিয়া এই বাউল সংগীত পরিবেশন করেন। প্রায় সহস্রাধিক দর্শক এই অনুষ্ঠান সমূহ উপভোগ করেন।

তিনদিন ব্যাপী এই মেলায় বিভিন্ন স্টল অংশগ্রহণ করে। প্রতিটি স্টলেই মাটির তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন লোকজ পণ্য ও ঘর সাজানোর সামগ্রী কেনাকাটায় ছিল উপচে পড়া ভিড়। শিশুদের জন্য নাগর দোলনা ও চরকি বাড়তি আনন্দ এনে দেয়। মেলায় ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ স্মৃতি গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্রের’ একটি বইয়ের স্টলও অংশগ্রহণ করে। এখান থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বই বিক্রি হয়।

এবারের মেলায় আবহাওয়া ছিল চমৎকার। পড়ন্ত বিকেলে গ্রীস্মের দাবদাহ থাকলেও সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে তাপমাত্রা কমতে থাকে। মেলার দ্বিতীয় দিনে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি দেখা মিললেও ছিল না কালবৈশাখীর তাণ্ডব। ফলে দর্শকবৃন্দ প্রতিদিনের অনুষ্ঠান খুব ভালোভাবেই উপভোগ করতে পেরেছেন। মেলায় শিশু-কিশোরদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এই শিশুরাই আগামী দিনে বাঙালিয়ানার চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে নিজেদেরকে তৈরি করতে পারবে বলে বিশ্বাস করেন মেলার আয়োজকবৃন্দ। আগত দর্শকবৃন্দ মেলার প্রতিদিনের কার্যক্রমের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তারা এই বৈশাখী উৎসবের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ