Ticker

6/recent/ticker-posts

ধার্মিকতা বনাম দায়িত্ববোধ

 ধার্মিকতা বনাম দায়িত্ববোধ

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ


বেশ কয়েকদিনের পেপার ওয়ার্ক শেষে একটি যৌথ অ্যাকাউন্টের চেক বই আনতে ব্যাংকে গেলাম। যে অ্যাকাউন্টটি আমরা করছি তাতে তিন জনের নাম ও স্বাক্ষর আছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একজন বয়স্ক লোক। ৫০-এর উপরে বয়স, আধাপাকা দাঁড়ি, পড়নে আরবীয় জোব্বা। চেকের স্লিপটি হাতে নিয়ে তিনি একনজর সেগুলো দেখলেন। পরে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- বাবা আপনার নাম কি ? আমি নিজের নাম বললাম। বলার পর পরই তিনি বলছেন- মাশাল্লাহ্ কী চমৎকার নাম। আপনার বাবা-মা আপনাকে ভালোবেসে খুব সুন্দর একটা নাম দিয়েছে। এই নামের মর্যাদা রক্ষা করা আপনার দায়িত্ব। তিনি বলেই চলছেন- আমরা সবাই আল্লাহর বান্দা। একদিন আমাদের সবাইকে মরতে হবে। মরার আগে আমরা যদি ভালো ভালো কিছু কাজ পরকালের জন্য না করে যেতে পারি, তাহলেতো হবে না। তাহলেতো বাজান বেহেশতে যেতে পারবো না। তিনি আমাকে নামাজ পড়ার ও দাঁড়ি রাখার পরামর্শ দিলেন। ভদ্রলোক আমার চেক বইটি নিয়ে টুকটাক কাজ করছেন আমার আমাকে ওয়াজ নসিহত করছেন। 

আমি মুখে বললাম- জি আঙ্কেল, ঠিক বলেছেন। আর মনে মনে ভাবলাম ব্যাংকের স্লিপে থাকা তিনটি নামের একটি হিন্দু। আসলে ভদ্রলোক কনফার্ম হতে চাইছিলেন আমি হিন্দু না মুসলমান। আমি মুসলমান জেনেই তিনি আমাকে দ্বিনের দাওয়াত দিয়ে দিলেন। মনে মনে বললাম- বেশতো, চাকরির পাশাপাশি দ্বিনের কাজও করছেন। দুনিয়া আখিরাত একসঙ্গেই পেয়ে যাচ্ছেন। আর আমরা সারাদিন কত নাফরমানি কাজ করি। মনে মনে লজ্জিতই হলাম। ভদ্রলোককে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম। পরে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন অ্যাকাউন্টটি কারেন্ট না সেভিং। আমি বললাম যৌথ অ্যাকাউন্ট কী হিসেবে চালু করে, কারেন্ট না সেভিং তা আমি শিউর বলতে পারছি না। যে যেকোনো সময় টাকা তোলা যায়। এটা তো কারেন্ট অ্যাকাউন্টে হবে- তাই না, আপনি চেক করে নিন। তিনি বললেন- আচ্ছা ঠিক আছে। বলেই তিনি ড্রয়ারের থেকে একটি নতুন চেক বই বের করে প্রয়োজনীয় সিল স্বাক্ষর দিয়ে এবং আমার স্বাক্ষর রেখে আমাকে নতুন চেক বই দিয়ে দিলেন। আমি উনাকে আবারো ধন্যবাদ দিয়ে ব্যাংক ত্যাগ করলাম।

প্রায় তিন ঘণ্টা পর দুপুরে বাসায় ফিরছিলাম। ফোনে অপরিচিত একটি নাম্বার থেকে কল আসলো। রিসিভ করতে অপরপ্রান্ত থেকে বলল, আজকে তো আপনি এই..... ব্যাংকে এসেছিলেন তাই না, চেক বই নেওয়ার জন্য। আমি বললাম- জি। তিনি বললেন, আপনিতো আমাকে ভুল ইনফরমেশন দিয়েছেন। আপনার অ্যাকাউন্ট কারেন্ট অ্যাকাউন্ট হবে না সেভিং অ্যাকাউন্ট হবে। আপনি যেই চেক বইটি নিয়েছেন তা দিয়ে তো টাকা তুলতে পারবেন না। আমি বললাম- আসলে আমিতো প্রথমেই বলেছি যে আমি শিওর না। যাই হোক এখন কি করতে হবে বলেন। তিনি আমাকে বললেন- আপনি আবার ব্যাংকে এসে ওইটা পাল্টিয়ে নিয়ে যাবেন। আচ্ছা ঠিক আছে পাল্টিয়ে নিয়ে যাবো বলে ফোন রেখে দিলাম।

মনে মনে ভাবলাম যে ২-৩ মিনিট তিনি আমাকে দিনের দাওয়াত দিয়েছেন, সেই সময় ওয়াজ না করে যদি উনার সামনে থাকা কম্পিউটারটি দিয়ে আমার অ্যাকাউন্টের ডিটেইলস চেক করতেন তাতে ৩০ সেকেন্ডের মত সময় লাগতো। কিন্তু অ্যাকাউন্টের চেক করার জন্য ৩০ সেকেন্ড সময় উনার হাতে না থাকলেও আমাকে দ্বিনের দাওয়াত দিতে দুই মিনিট ঠিকই খরচ করে ফেলেছেন। সরকারি দায়িত্ব অবহেলা করে ধর্মের প্রচার নিশ্চয় ধার্মিকতা নয়।

আসলে আমরা সবাই ধার্মিক হওয়ার, ভালো হওয়ার ভান ধরি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমরা ভালো নই। ধার্মিক নই। যদি ধার্মিক হতাম তাহলে ধর্ম আমাকে অপরের ক্ষতি করতে শেখায় না। নিজ দায়িত্ব অবহেলা করে অবহেলা করতে শেখায় না। কিন্তু আমরা বেশিরভাগ মানুষ সেটা উপলব্ধি করতে পারি না। ধর্মীয় পোশাক, চিহ্ন এবং কিছু বাহ্যিক আচরণ প্রকাশ করেই আমরা নিজেদেরকে ধার্মিক রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হই এবং অন্যকেও ধার্মিক ভেবে ভুল করে থাকি। কিন্তু ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য যে মন থেকে শুদ্ধ হওয়া। পবিত্র হওয়া, সৎ হওয়া এই বিষয়টি অনুধাবন করতে পারি না। নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা এর চেয়ে বড় ধার্মিকতা আর কি হতে পারে।


সকাল ৭ টা ৩৭

তিতাসপাড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ