Ticker

6/recent/ticker-posts

রক্তে লিখেছি একটি নাম: বাংলাদেশ


 রক্তে লিখেছি একটি নাম: বাংলাদেশ

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ


মায়ের কোলে জন্ম নিয়ে, যেদিন আমার চোখ খুললো

তখন আমি প্রথম দেখলাম সূর্যকে, রক্ত বর্ণময় সূর্য।

বর্ণের বর্ণালির বৈচিত্র্যতার পার্থক্য তখন আমি বুঝতে শিখিনি, 

কিন্তু লাল রংটা কেন জানি, আমার মনে স্থান করে নিয়েছিল। 


আর তাই আস্তে আস্তে আমি যখন বড় হলাম

তখন আমার ব্যবহারের সব কিছুই লাল হতে লাগলো।

আমার জুতো, জামা, প্যান্ট, মাথার ক্যাপ 

সবকিছুই ছিল লাল রঙের।


বাবার হাত ধরে কাঁধে যে ব্যাগ ঝুলিয়ে 

আমি স্কুলে যেতাম, সেটিও ছিল লাল রঙের।

বড় হবার পর আবার এই লাল রঙের প্রতি 

আমার ঠিক এতটা আগ্রহ না থাকলেও 

আমার অনেক কিছুই ছিল লাল রঙের। 


কিন্তু বিশ্বাস করুন 

এই লাল রংটা আমার 

ভীষণ কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল একদিন।

আমি ভীষণ ঘৃণা করতে শুরু করেছিলাম লাল রং কে। 

চোখের সামনে থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলাম। 

কিন্তু পারেনি, বারবার লাল রং 

আমার আহত হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছে।


১৯৭১, মার্চ ২৫, গভীর রাত ।

ঘরে ঘুমিয়ে ছিল আমার শিক্ষক বাবা-মা, 

দুগ্ধপোষ্য ছোটভাই আর এক কিশোরী বোন।

ছাদের উপর ছোট্ট একটা রুমে আমি থাকতাম একা।


গোলাগুলির শব্দ শুনে আমি যখন নিচে নামলাম 

ততক্ষণে সব শেষ,

মেঝের উপর পড়ে আছে বাবা-মার রক্তাক্ত লাশ

আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম, 

তারপর অনেকক্ষণ কাঁদলাম। 

একটা সময় আমার কান্না থেমে এলো।


কিন্তু হঠাৎ কি মনে হতেই 

আমি ছুটে গেলাম আমার ছোট বোনের রুমে 

ছিমছাম গোছানো রুমখানি 

আজ এলোমেলো,আসবাবপত্র সব ভাঙ্গা।


বোনটিকে খুঁজে পেলাম না ঘরের ভিতরে। 

বুজতে পারছিলাম ঘরের ভিতর 

কি কেয়ামত বয়ে গেছে। 

ছুটে বেরিয়ে এলাম বাহিরে 

বোনটিকে খুঁজে পেলাম বাগানে, 

মাটির কোলে শুয়ে আছে, বিবস্ত্র শরীর।


বিশ্বাস করুন, সেই দিনের পর 

আমি আর কখনো একটু কাঁদিনি। 

আদরের বোনটিকে যখন কোলে নিলাম 

তখন আমার জানা ছিল না ও বেঁচে আছে, 

কোলে নিতেই একটি কথা বলেছিল ‘ভাইয়া-যুদ্ধ’। 

এটাই ছিল ওর শেষ কথা, এতটুকু কথা বলার জন্যই 

এত কষ্টের মাঝেও এতক্ষণ বেঁচে ছিল ।


তারপর এই হতভাগা ভাই 

প্রিয় বোনের লাশ নিয়ে এলাম বাবা-মার কাছে। 

মেঝেতে বাবার হাতের কাছে 

রক্তে লেখা একটি শব্দ দেখতে পেলাম ‘যুদ্ধ’।

বিশ্বাস করুন, সেই দিনের পর 

আমি আর কখনো একটুও কাঁদিনি।


দুই বছরের ছোট ভাইটির থেতলানো দেহ আর

ওর মাথার মগজ ঘরের ভিতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখে 

আমার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল সে রাতে, 

বিশ্বাস করুন, সেই দিনের পর 

আমি আর কখনো একটুও কাঁদিনি।


ভোরে বাগানের মাটিতে এক কবরে 

শুয়ে দিয়েছিলাম বাবা-মা আর ভাই-বোনকে 

পরদিন বেরিয়ে পড়েছিলাম যুদ্ধে।

তারপর আরো অনেক কথা, অনেক ইতিহাস।



সবকিছুতেই ছিল রক্ত

কত ভাই-বোন আর সহযোদ্ধার রক্ত আমি দেখেছি,

সব রক্তই লাল রঙের

আর এতসব রক্তের মাঝে আমি কেবল খুঁজেছি

আমার বাবা-মা আর ভাই-বোনের রক্ত।


তারপর একদিন সে রক্ত যেন খুঁজে পেয়েছি 

সবুজ খচিত একটি পতাকার মাঝখানে

বাংলাদেশের পতাকার মাঝখানে 

বাংলাদেশ, রক্তে লিখেছি একটি নাম-বাংলাদেশ।


১২ মার্চ ২০০৯, ফুলকলি কিন্ডারগার্টেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ