তাসফিয়ার জীবনের প্রথম পরীক্ষার রেজাল্ট ও কিছু কথা।
গত বছর ওকে স্কুলে ভর্তি করার কথা ছিলো। কিন্তু খেলার বয়সের লেখাপড়া চাপ ছোটো মেয়েটার জীবনে না পড়ুক তাই তাকে স্কুলে ভর্তি না করে বাসায় পড়ার সিদ্ধান্ত নিই। বাসায় আলাদা শিক্ষক রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তাসফিয়া রাজী হয়নি। তাই তার মাকেই বলি বাসায় অল্প অল্প পড়াতে।
সেইভাবেই প্রতিদিন একটু করে বাংলা, ইংরেজি, অংক ও আরবি শিখেছে নিজের মায়ের কাছে। প্লে শ্রেণির পড়াশোনা সে ঘরেই শিখেছে। তাছাড়া মোবাইলে কার্টুন দেখে ও আমাদের কাছ থেকে শুনে শুনে বাংলা ইংরেজি অনেকগুলো ছড়া-কবিতাসহ নানান বিষয় তাসফিয়া স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে শিখেছিলো।
এই বছর ওকে সূর্যমুখীতে ভর্তি করার অগ্রিম প্রস্তুতি নিয়ে নিয়ে রাখি। কিন্তু লটারিতে তাসফিয়া নাম না উঠায় কী করা যায় তা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলাম। কয়েকজন অবশ্য বলেছিল চেষ্টা তদবির করে হলেও সূর্যমুখীতে ভর্তি করে দিতে। পরে আমি এই ভেবে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম যে সূর্যমুখীতে ভর্তি হতে হলে প্লে শ্রেণিতে ভর্তি হতে হবে। তাই আমি বাসার পাশের স্ট্যান্ডার্ড স্কুলে নার্সারিতে ভর্তি করিয়ে দিই। ফলে সমবয়সী সকল বাচ্চা থেকে সে এক বছর এগিয়ে থাকবে।
স্ট্যান্ডার্ড স্কুলের পরিচালক ও শিক্ষকদের কয়েকজন ফেসবুকে তাসফিয়ার বিভিন্ন ভিডিও দেখে তার সম্পর্কে আগেই জানা ছিল। তাই তারা সহজেই নার্সারিতে ভর্তি করাতে রাজি হলো। কিন্তু আমাদের মনে একটি ভয়ও ছিল। হাজার হোক, বাসার পড়া আর ক্লাসের পড়ার মধ্যে পার্থক্য থাকবেই। এই পার্থক্যের কারণে নতুন ক্লাসের বাচ্চাদের সাথে যারা আগেই প্লে পড়ে এসেছে তাদের সাথে তাসফিয়া একজাস্ট হতে পারবে কি'না। আলহামদুলিল্লাহ, অল্প সময়ে তাসফিয়া ক্লাসের বাচ্চা এবং শিক্ষকদের কাছে আদরী হয়ে উঠেছে।
আমি স্কুলে যাইনি। কিন্তু তাসফিয়ার মার কাছে শুনেছি, শিক্ষকরাও যত্ন সহকারে বাচ্চাদেরকে পড়িয়ে থাকে। বাচ্চার মাকে বলে রেখেছি পড়াশোনা নিয়ে তাসফিয়াকে কোনরকম চাপে না রাখতে। বছরখানেক এমনিতেই স্কুলে আসা যাওয়া করলেই চলবে। ভালো রেজাল্ট করতে হবে না, হাসিখুশি থেকে আমার মেয়ে যদি ক্লাসের শেষ রোল অধিকারী ও হয় তবুও আমার আপত্তি নেই। রেজাল্টের জন্য কখনো তাসফিয়াকে বা তার মাকে কিছু বলবো না।
কিন্তু তারপরেও রোজ সন্ধ্যায় মা তার মেয়েকে নিয়ে পড়াতে বসে। ওদিকে তাসফিয়ার ফুপি তাকে একটি ছোট পড়ার টেবিল গিফট করেছে। রোজ সন্ধ্যায় সেই টেবিলে বসেই চলে তাদের পড়ালেখা। অনেক সময় তাসফিয়া স্বেচ্ছায় পড়তে বসে। অনেক সময় মা জোর করে বসায়। যেদিন জোর করে বসাবে বা বেশি লেখাপড়া করাবে সেদিন মেয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে আমার কাছে বিচার দেবে। আর আমি তখন মেয়ের পক্ষ নিয়ে লেখাপড়ার ইতিঘটাই। বই-খাতা কেড়ে নিয়ে দূরে কোথাও লুকিয়ে রাখি। এই নিয়ে অবশ্য ওর মা আমার সঙ্গে বেশ কয়েকবার ঝগড়া করেছে। মেয়ে খারাপ রেজাল্ট করলে লোকেরা আমাদেরকে মন্দ বলবে। আমি বলেছি- লোকের কথায় কি আসে যায়। মানুষের কথায় নিজের মেয়ের সুন্দর শৈশব নষ্ট করতে চাই না। কেননা শৈশব একবার চলে গেলে আর ফিরে আসে না।
মাঝে মাঝে আমি নিজেই তাকে রেডি করে স্কুলে দিয়ে আসি। একটু একটু পড়াতে সহযোগিতা করি। যদিও পড়াতে আমার ধৈর্য কুলায় না। কারণ আমার মনোযোগ থাকে ব্যক্তিগত লেখালেখি নিয়ে। ইদানিং সংসারে থেকেও আমি সংসার বৈরাগী মানুষ হয়ে গিয়েছি। বাজার করে দেওয়া পর্যন্তই আমার দায়িত্ব। সংসারের অনেক কিছুতেই নাক গলাই না। ঘরের মধ্যে অন্য কাউকে চেয়ারম্যান বানিয়ে নিজে সাধারণ মেম্বার হয়ে থাকি। চেয়ারম্যান সাহেবও আমাকে যথেষ্ট ছাড় দিয়ে রেখেছেন। বাসায় যতক্ষণ থাকি বেশিরভাগ সময় মোবাইল আর কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকি। মাঝে মাঝে মেয়েকে একটু সময় দেওয়া, ঘর সংসারের টুকটাক কাজ করেই নিজের সংসারের মহান দায়িত্ব শেষ করি।
কম্পিউটারে যখন আমি লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকি মাঝে মাঝে পিছন ফিরে দেখি মেয়ে আমার এক মনে পড়ছে, বা হোম ওয়ার্ক করছে। মা তখন রান্নাঘরে। দৃষ্টি আমার জুড়িয়ে যায়। অবাক করা কথা হলো আমি বাংলার ছাত্র হলেও মেয়ে আমার বাংলাতে খুব আগ্রহ নাই। অংক, ইংরেজি ধর্ম, সাধারণ জ্ঞান এবং ছবি আঁকায় খুব আগ্রহ তার। আমরা দু চোখে যা দেখি তার বেশিরভাগ জিনিসের নাম সে ইংরেজিতে জানে। নিজে যেসব জিনিস কোনো দিন ব্যবহার করেনি সেসব জিনিসের ব্যবহাররে নিয়ম জানে। সব মোবাইল দেখে শিখেছে সব।আমার কথা বিশ্বাস না হলে রাস্তা-ঘাটে দেখা হলে ওকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন।
লেখা শেষ করে প্রতিদিন আমাকে দেখাবে কি কি লিখেছে। আমি বাসায় না থাকলে পরে আসলে দেখাবে। তারপর আমাদের আদর দেয়া নেয়া চলবে।কিন্তু ঘুরেফিরে আমার এক কথা, ভালো রেজাল্ট লাগবে না, সুন্দর শৈশব চাই।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার তিন মাসের মাথায় রোজার মধ্যে পরীক্ষা অংশগ্রহণ করেছিল। ওর মা টেনশন করছিল পরীক্ষা খারাপ হবে। কারণ স্কুলের ক্লাসে মা না থাকলে এসে ক্লাসে বসতে চায় না। আর পরীক্ষার হলে তার মাকে ঢুকতে দেয়নি। কাজেই মনে হয় না খাতাতে সে ভালো করে কোনো কিছু লিখেছে। এসব টেনশনের মধ্যেই আজকে ওর রেজাল্ট কার্ড হাতে পেলাম। সত্যি অবাক করে দিয়েছে আমাদের। ওর ভর্তির রোল ছিল ২২। প্রগ্রেসিভ কার্ডে উন্নীত হয়েছে ৫ এ। ৫ বা ২২ রোল যাই হোক আমার আগ্রহ নেই তাতে। মেয়ে আমার হাসবে, খেলবে, পড়বে এতোটুকুই আমাদের চাওয়া।
তাসফিয়ার মা আর তার স্কুলের শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। মেয়ের জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ৩ মে ২০২৩
0 মন্তব্যসমূহ