Ticker

6/recent/ticker-posts

মহানায়কের মহৎ জীবন-মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-মহানায়কের মহৎ জীবন

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ



যতদিন রবে পদ্মা-যমুনা

গৌরী-মেঘনা বহমান

ততদিন রবে কীর্তি তোমার 

শেখ মুজিবুর রহমান।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধুমাত্র একটি নাম নয়, তিনি একটি ইতিহাস। একটি জাতি, একটি দেশের ইতিহাস। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, জাতির জনক। তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, তিনি বঙ্গবন্ধু। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের একটি স্বর্ণালি অধ্যায় তিনি। তিনি চেতনা ও আদর্শের বাতিঘর। বাঙালির সকল আন্দোলন-সংগ্রামে বজ্রকঠিন বাধা পেরোনোর শক্তি-সাহসের এক অবিস্মরণীয় নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। 

জাতি হিসেবে বাঙালির নিজেস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, বীরত্ব আর গৌরবগাঁথা বহু পুরনো। বিশ্ব ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় পাতায়, প্রতিটি পরিবর্তনে বিশেষত উপমহাদেশের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনে বাঙালি জাতি একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। সে ইতিহাসের সাথে সংযুক্ত আছে ২৪ বছরের পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস, প্রায় ২০০ বছরের বিট্রিশ বেনিয়াদের দাসত্বের ইতিহাস। আর তারও আগে মোগল সাম্রাজ্য ও অনান্য শাষনতো আছেই। বাঙালি জাতির হাজার বছরের পরাধীনতার ইতিহাসে অনেক নায়করাই আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, যুদ্ধ করেছেন, আত্মহুতি দিয়েছেন। কিন্তু চূড়ান্ত সফলতা আসেনি। সফলতা এসেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এঁর হাতে। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে সেই দীর্ঘদিনের পরাধীনতার গ্লানি থেকে শুধু মুক্তির স্বপ্নই দেখাননি; তিনি শতধাবিভক্ত বঙালি জাতিক ঐক্যবদ্ধ করে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠির শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্ত করে ছিলেন একটি মহান একটি গৌরবগাঁথা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে।

জন্ম:

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাকনাম ছিল খোঁকা। তাঁর বাবা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার ছিলেন। তাঁর মাতার নাম মোসাম্মৎ সায়েরা খাতুন। এই দম্পতির চার

কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে শেখ মুজিব ছিলেন তৃতীয় সন্তান। তাঁর বড় বোন ফাতেমা বেগম, মেজ বোন আছিয়া বেগম, সেজ বোন হেলেন ও ছোট বোন লাইলী; তাঁর ছোট ভাইয়ের নাম শেখ আবু নাসের।

শিক্ষা জীবন:

১৯২৭ সালে ৭ বছর বয়সে শেখ মুজিবুর রহমান গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। ৯ বছর বয়সে ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন তিনি। চোখে জটিল রোগের কারণে সার্জারি করেছিলেন তিনি। এ কারণে ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত চার বছর তিনি বিদ্যালয়ের পাঠ চালিয়ে যেতে পারেননি।

১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪৪ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে এইচ.এস.সি এবং ১৯৪৭ সালে বি.এ পাশ করেন। ১৯৪৭ সালে কলকাতা ত্যাগ করে ঢাকা আগমন করেন। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ল’ ক্লাশে ভর্তি হন। 

বৈবাহিক জীবন ও সন্তান:

১৯৩৮ সালে ১৮ বছর বয়সে বেগম ফজিলাতুন্নেসার সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁদের ২ মেয়ে- শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং তিন ছেলে- শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল।

রাজনৈতিক ও কর্মজীবন

অল্পবয়স থেকেই তাঁর রাজনৈতিক প্রতিভার প্রকাশ ঘটতে থাকে। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি গোপালগঞ্জ মহকুমা মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ১৯৪০ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। ১৯৪৩ সালে যোগ দেন বেঙ্গল মুসলিম লীগে। তিনি এর কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এখানেই হুসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন। ১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারি ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ গঠন করেন। তিনিই ছিলেন এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। পঞ্চাশের দশক তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের কাল। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠেন দূরদর্শী এক রাজনৈতিক নেতা। এসময় শেখ মুজিবুর রহমান ‘মুসলিম লীগ’ ছেড়ে দেন এবং হোসেন সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা ভাসানীর সাথে মিলে গঠন করেন “আওয়ামী মুসলিম লীগ”। তিনি দলের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষি ও বন মন্ত্রী হন শেখ মুজিব। ১৯৫৬ সালে কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রিসভায় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। ১৯৬৩ সালে হোসেন সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন:

ভাষা আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলনের শুরুতে ‘তমদ্দুন মজলিস’এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত কার্যক্রমে তিনি অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বাংলা ভাষার দাবির স্বপক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে অংশগ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন মিটিং মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। এই ধর্মঘট শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেপ্তার হন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণ পর্বে বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক ময়দানে অনুপস্থিত থাকলেও জেলে বসেও নিয়মিত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করতেন।

৬ দফা আন্দোলন:

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনেই শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ছয় ৬ দাবী পেশ করেন। যাতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসনের পরিপূর্ণ রূপরেখা উল্লেখিত হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান এই দাবিকে “আমাদের বাঁচার দাবি” শিরোনামে প্রচার করেছিলেন। এ দাবি আদায়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আন্দোলন হয়েছিল।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা:

১৯৬৮ সালের প্রথমদিকে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানসহ মোট ৩৫ জন বাঙালি সামরিক ও সিএসপি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে যা ইতিহাসে “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা” নামে সুপরিচিত। মামলায় উল্লেখ করা হয়েছিল শেখ মুজিবসহ এই কর্মকর্তারা ভারতের ত্রিপুরা অঙ্গরাজ্যের অন্তর্গত আগরতলা শহরে ভারত সরকারের সাথে এক বৈঠকে পাকিস্তানকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা তৈরি করেছে। এতে শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বর আসামী করা হয়। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেবে।

৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান:

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সূচনা পর্বে বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামি হয়ে জেল বন্দী ছিলেন। সে সময় বিভিন্ন দাবিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। আওয়ামী লীগের ৬ দফাসহ ছাত্রদের ১১ দফা দাবি নিয়ে পাকিস্তান বিরোধী গণ আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। ফলশ্রুতিতে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য রাজবন্দীগণ মুক্তি পান। স্বৈরাচারী আইয়ুব খান সরকারের পতন হয় এবং ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে গণপরিষদ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়।

বঙ্গবন্ধু উপাধি লাভ:

১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়। লাখো মানুষের এই জমায়েতে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

বাংলাদেশ নামকরণ:

১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর আয়োজিত এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। তিনি বলেন, “একসময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোন কিছুর নামের সঙ্গে

‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি- আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ”।

৭০এর নির্বাচন:

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ৩০৫টি আসন লাভ করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবুর রহমানের স্বায়ত্বশাসনের নীতির পুরোপুরি বিপক্ষে ছিলো। আওয়ামী লীগের সরকার গঠন ঠেকাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সংসদের অধিবেশন ডাকা নিয়ে টালবাহানা শুরু করেন। শেখ মুজিব তখনই বুঝে যান যে, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের দুঃশাসনের অবসান ঘটাতে লড়াইয়ের কোনো বিকল্প নেই।

৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ:

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন। রেসকোর্সের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। ঐতিহাসিক এ ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে শৃঙ্খল মুক্তির আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা করেন, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বোÑ ইনশাল্লাহ্। প্রত্যেকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। যার যা কিছু আছে তাই নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে”।

গ্রেফতার ও মুক্তিযুদ্ধ:

বঙ্গবন্ধুর ডাকে উত্তাল হয়ে ওঠে সারা বাংলা। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি জাতির এই জাগরণে ভীত হয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সরকার গঠন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেন। কিন্তু তাঁদের সেই বৈঠক সফল হয়নি। এরপর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চরাতের অন্ধকারে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা; শুরু করে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড। অশীতিপর বৃদ্ধ থেকে কোলের শিশু-কেউ রক্ষা পায় না পাক হায়েনাদের নারকীয়তা থেকে। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পাক বাহিনী কর্তৃক ধানমন্ডিস্থ স্বীয় বাসভবন থেকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন বঙ্গবুদ্ধ শেখ মুজিবুর রহমান। গ্রেফতারের পূর্বে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে তিনি লিখিতভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। অতঃপর দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর, ৩০ লক্ষ বাঙালির প্রাণের বিনিময়ে অবশেষে আসে বিজয়। ১৬ ডিসেম্বর সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যেখান থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, সেখানেই বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামের নতুন একটি রাষ্ট্র। বাংলাদেশ।

সরকার গঠন ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত:

১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করা হয়। তাঁর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এ সরকারের অধীনেই গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী এবং শুরু হয় পাক সেনাদের প্রতিহত করার পালা। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, সরকার গঠন ও বাকশাল প্রতিষ্ঠা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি বাংলায়। দেশে ফিরেই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সাহায্যের আবেদন জানান তিনি। ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বগ্রহণ করেন। তাঁর শাসনামলে বিশ্বের ১০৪টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। তিনি বিশ্ব শান্তি পরিষদ প্রদত্ত ‘জুলিও কুরি পদক’ লাভ করেন। এরই মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে স্বাধীনতা বিরোধী একটি চক্র। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে রাজনৈতিক অস্থিতশীলতা সৃষ্টি করতে উঠেপড়ে লাগে এই চক্রটি। এসময় বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। ১৯৭৪ সালে তিনি সকল রাজনৈতিক দলকে এক ছাতার নিচে আনতে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা ‘বাকশাল’।

শাহাদাত বরণ:

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবকে। সেই কালো রাতে সেনা সদস্যদের হাতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য এবং নিকট আত্মীয় সহ মোট ২৬ জন সেদিন শহিদ হন। বঙ্গবন্ধু  কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সে সময় পশ্চিম জার্মানীতে অবস্থান করার কারণে তাঁরা প্রাণে বেঁচে যান। সদ্য স্বাধীন হওয়া বাঙালি জাতির জীবনে এক অপূরণীয় ক্ষতি নিয়ে আসে ইতিহাসের এই জঘণ্য হত্যাকাণ্ড। দেশে তৈরি হয় রাজনৈতিক শূন্যতা, ব্যাহত হয় গণতান্ত্রিক উন্নয়নের ধারা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাঙালি জাতির যে ক্ষতি হয়েছে তা কখনো পূরণীয় নয়।

উপসংহার

১৯৭১ সালে পরাধীনতার জিঞ্জির ছিঁড়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতাকামী বাঙালি অর্জন করেছিল বাঙালি জাতির মহামূল্যবান স্বাধীনতা। ত্রিশ লাখ শহিদের আত্মদান এবং অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাঙালি জাতি অর্জন করে তাদের হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন প্রিয় এই স্বাধীনতা। বিশ্বের মানচিত্রে স্থাপন করেন সার্বভৌম বাংলাদেশ, নিজস্ব লাল-সবুজ পতাকায় আচ্ছাদিত হয় বাঙালির হৃদয়। কিন্তু দুঃখজনক, বেদনাবিধুর, হৃদয়বিদারক ঘটনা হলো ইতিহাসের এই শ্রেষ্ঠ মহানায়ককে স্বাধীনতার মাত্র সারে চার বছরের পরে ১৫ আগস্টের কালোরাত্রে স্বপরিবারে নির্মম হত্যা করা হয়। আসলে সেইদিন ঘাতকরা চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে একটি ইতিহাস, একটি চেতনা, একটি আদর্শকে হত্যা করতে। কিন্তু তারা জানে না বন্ধুকের গুলিতে বঙ্গবন্ধুর ইতিহাসকে দমিয়ে রাখা যায় না। বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে মুছে দেয়া যায় না। বঙ্গন্ধুর আদর্শকে বিলীন করে দেয়া যায় না। কারণ বঙ্গবন্ধু সে আদর্শকে রেখে গিয়েছিলেন কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গৌরবোজ্জ্বল বিশাল কর্মযজ্ঞ, তাঁর আত্মত্যাগ, দেশের মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, মমত্ববোধ, বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে এগিয়ে নিয়ে যেতে তাঁর যে পরিকল্পনা এবং যে মহান আদর্শ তিনি আমাদের মাঝে রেখে গিয়েছেন সেই সব কিছু অল্প কিছুদিনে বা কিছু বই পড়ে জানা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুকে ভালোভাবে জানতে হলে, বুঝতে হলে নিয়মিত বঙ্গবন্ধুকে পড়তে হবে, গবেষণা করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে জানার জন্য, বোঝার জন্য, গবেষণার জন্য সারা বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানান ধরনের বই-পুস্তক, ম্যাগাজিন, চলচ্চিত্রসহ অনেক সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখেনি এমন কবি, সাহিত্যিক লেখক, সাংবাদিকের সংখ্যা নিতান্তই কম। তাঁকে লিখছেন অনেক তরুণ লেখকরাও। সেই ইতিহাসের অংশ হতেই আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। এই লেখায় কোনো ভুল-ভ্রান্তি পরিলক্ষিত হলে পরবর্তী প্রকাশনায় তা সংশোধন করা হবে।

তথ্যসুত্র:- উইকিপিডিয়া, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইট এবং বিভিন্ন অনলাইন গণমাধ্যম থেকে সংগৃহীত তথ্য অবলম্বনে। 

লেখক: মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ, প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক, ঝিলমিল একাডেমি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ