Ticker

6/recent/ticker-posts

৫০জন বীর শহিদদের সমাধিস্থল কসবার কোল্লাপাথর

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিভূমি- ৫০জন বীর শহিদদের সমাধিস্থল কসবার কোল্লাপাথর
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যক্তিবর্গের পরিদর্শন 
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ


যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তি সেনা, দে-না তোরা দে-না সে মাটি আমার অঙ্গে মাখিয়ে দে-না।----বাঙালির জাতীয় জীবনের প্রধানতম অর্জন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে এই মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছেন ৩০ লক্ষ বাঙালি। সম্ভ্রম হারিয়েছেন দু-লক্ষ মা-বোন। তাদের সমাধি হয়েছে সেই মাটির বুকে, যে মাটির মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য তারা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর মৃত্যুবরণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবরও এই মাটির বুকেই হয়েছে। তাইতো এ-মাটি ধন্য। এ-মাটি আমাদের পরম আরাধ্য, পূন্যময় ও পবিত্র ভূমি। লাখো মুক্তিযোদ্ধাদের কবর, অসংখ্য গণকবর ও বধ্যভূমি এদেশের নানান স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তেমনি একটি সমাধিস্থল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার বায়েক ইউনিয়নে অবস্থিত। ভারত সীমান্তবর্তী সালদা নদী ঘেষা কোল্লাপাথর গ্রামে রয়েছে এই সমাধিসৌধ। যেখানে শুয়ে আছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫০জন বীর শহিদ। 


সম্প্রতি এই সমাধিস্থল পরিদর্শন করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একদল বিশিষ্ট লেখক, কবি ও সাহিত্যিকবৃন্দ। “বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থান পরিদর্শন” শিরোনামে অদ্বৈত মল্লবমর্ণ গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্রের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় এই ভ্রমণ। উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় ছিলেন অদ্বৈত মল্লবমর্ণ গ্রন্থাগার এর প্রতিষ্ঠাতা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিশিষ্ট কবি ও গীতিকার মো. আ. কুদদূস।


কোল্লাপাথর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি উল্লেখযোগ্য সমাধিস্থল। একটি ছোট টিলার উপরে এই সমাধিস্থল অবস্থিত। কসবা বাংলাদেশের একটি সীমান্তবর্তী উপজেলা যা মুক্তিযুদ্ধের সময় ২ নম্বর সেক্টরের আওতায় ছিল এবং এর পাশের ভারতের আগরতলা, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থাকার কারণে এ অঞ্চলটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল। ফলে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এ এলাকায় বেশি যুদ্ধ সংগঠিত হয় এবং বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাতবরণ করেন। এখানে দুজন বীরবিক্রম, একজন বীরউত্তম, দুজন বীরপ্রতীকসহ মোট ৫০ জন শহিদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধি রয়েছে। এখানকার প্রতিটি কবরের উপরেই লেখা রয়েছে মুক্তিযোদ্ধার নাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিম এবং তার বাবা মরহুম আ. মান্নান মিলে তাঁর পৈতৃক ভিটায় মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ দাফন করেন। ১৯৭২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা প্রশাসক ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতায় এ স্থানটি সংরক্ষণ করা হয়। এছাড়াও পরবর্তীতে একটি রেস্ট হাউস, তোরণ এবং পুকুরের পাঁকা ঘাট নির্মাণ করা হয়।


ভ্রমণকালে এক সংক্ষিপ্ত সভায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও সাহিত্য একাডেমির সভাপতি, বিশিষ্ট কবি জায়দুল হোসেন বলেন “১৯৭১ সালে কসবা এলাকার বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৯ মাস ধরেই এই যুদ্ধে অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হয়েছেন। এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে সিলেটের তৈয়ব আলী নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা এক সম্মুখ যুদ্ধে শহিদ হন। মৃত্যুর পূর্বে আহত অবস্থায় তিনি আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছিলেন যে, “আমিতো আর বাঁচবো না। মৃত্যুর পরে আমার লাশটি যেন অন্তত বাংলাদেশের মাটিতে কবরস্থ করা হয়।” তখন প্রায় সমগ্র বাংলাদেশই পাকিস্তানি হানাদারদের দখলে ছিল। কোল্লাপাথর সীমান্ত সংলগ্ন হওয়ায় এলাকাটি একটি মুক্ত এলাকা ছিল। তৈয়ব আলীর শেষ আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার জন্য এখানকার সেক্টর কমান্ডার খোঁজ নেওয়ার জন্য লোক পাঠান যে, সীমান্তের আশে পাশে কোন জায়গায় তাঁকে সমাহিত করা যায়। তখন তারা জায়গা সন্ধান করতে এসে এখানে আব্দুল করিম নামে এক ব্যক্তির সন্ধান পেলেন। আব্দুল করিমসহ আব্দুল করিমের বাবার কাছে এসে মুক্তিযোদ্ধারা বলল যে, আপনার এই জায়গাটায় কি আমরা একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মানিত করতে পারি ? তখন করিমসহ আব্দুল করিমের বাবা মরহুম আ. মান্নান স্বাচ্ছন্দে রাজি হয়ে গেলেন। এখানে প্রথম যে কবরটি তার নাম তৈয়ব আলী এবং যুদ্ধের সময় এই এলাকাটি যেহেতু মুক্ত এলাকা ছিল, সীমান্তের দুইপার থেকে এসে তখন বহু মানুষ তৈয়ব আলীর জানাযাতে অংশগ্রহণ করে। তারপর তাকে এখানেই সমাহিত করা হয়। পরবর্তীতে কসবা পার্শ্ববর্তী এলাকা, শালদা নদী এলাকা, সীমান্ত এলাকায় যখনই কোন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হয়েছে, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের এখানে এনে কাফন-দাফন করে সমাহিত করা হয়। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে এই জায়গাটিকে সংরক্ষণ করেছেন। একসঙ্গে এতগুলো মুক্তিযোদ্ধার কবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আর কোথাও নেই। মরহুম আব্দুল করিমও এই জায়গাটি স্বাচ্ছন্দের সঙ্গেই কবরস্থানের স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যে দান করেছেন। স্বাধীনতার অনেক পরে দর্শনার্থীদের জন্য এখানে একটি আধুনিক বাংলো তৈরি করা হয়েছে। একটি রেস্ট হাউজ ও একটি মসজিদ তৈরি করা হয়েছে। দর্শনার্থীদের আনাগোনায় এলাকাটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ও তীর্থভূমিতে পরিণত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানের মুক্তিযোদ্ধারা এখানে যারা শহিদ হয়েছেন তাদের আত্মীয়স্বজনরা প্রতিবছর এইস্থানে তাদের কবর জেয়ারত করতে আসেন। অনেক সাধারণ মানুষরাও বিভিন্ন সময় এখানে এসে থাকেন। বিশেষ করে ১৬ ডিসেম্বর এবং ২৬শে মার্চে ব্যাপক জনসমাগম হয়। জয়দুল হোসেন আরো বলেন, কোল্লাপাথর জায়গাটি সংরক্ষণ করার জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে  অভিনন্দন এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এবং এই স্থানটির আরো সমৃদ্ধ ও উন্নয়ন কামনা করছি।


কোল্লাপাথরে সমাহিত শহিদদের নাম: দেশের অন্যান্য জেলার ৯ জন: তাঁরা হলেন সিলেটের হাবিলদার তৈয়ব আলী, ঠাকুরগাঁওয়ের সৈনিক দর্শন আলী, আর কে মিশন রোড ঢাকার মো. জাকির হোসেন (বীর প্রতীক), বগুড়ার ল্যান্স নায়েক আবদুস সাত্তার (বীর বিক্রম), ময়মনসিংহের নায়েক মোজাম্মেল হক, নোয়াখালীর নায়েক সুবেদার মো. আবদুল সালাম (বীর বিক্রম), ফরিদপুরের সিপাহী মুসলীম মৃধা, শরিয়তপুরের প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম, চট্টগ্রামের নায়েক সুবেদার বেলায়েত হোসেন (বীর উত্তম)। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২১ জন। তাঁরা হলেন মো. আবদুল জব্বার, মোজাহিদ নুরু মিয়া, মো. ফারুক আহম্মদ, মো. ফকরুল আলম, মো. নোয়াব আলী, মো. আবদুল অদুদ, ল্যান্স নায়েক মো. আ. খালেক, মো. আবদুল কাইয়ুম, মো. শওকত, মো. আবদুস সালাম সরকার, মো. আমির হোসেন, সিপাহী শহিদুল হক, সিপাহী আনোয়ার হোসেন, মো. আবদুল আউয়াল, মো. জাবেদ আহাম্মদ, শ্রী পরেশ চন্দ্র মল্লিক, মো. মতিউর রহমান, মো. আবদুর রশিদ, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. মোরসেদ মিয়া, মো. তাজুল ইসলাম। কুমিল্লার মোট ১৩ জন। তাঁরা হলেন সিপাহী আক্কাছ আলী, সিপাহী জসিম উদ্দীন, মো. আবদুল কাসেম (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী), মো. মোশারফ হোসেন, নায়েক সুবেদার মইনুল হোসেন (বীর উত্তম) (তার নামে ঢাকা সেনানিবাস এলাকার শহিদ মইনুল সড়কের নামকরণ করা হয়), সিপাহী হুমায়ুন কবির, ল্যান্স নায়েক আজিজুর রহমান, মো. তারু মিয়া, মো. জামাল উদ্দিন, মো. সিরাজুল ইসলাম, মো. ফরিদ মিয়া, মো. সাকিল মিয়া, সিপাহী মো. আবদুল বারী খন্দকার। চাঁদপুরের ৪ জন। তাঁরা হলেন আনসার ইলাহী বক্স পাটোয়ারী (বীর প্রতীক), সিপাহী মো. নুরুল হক,  মো. জাহাঙ্গীর আলম, কিশোরগঞ্জের শ্রী আশু রঞ্জন দে এবং অজ্ঞাতনামা আরো ৩জন বীর মুক্তিযোদ্ধা এখানে শায়িত আছেন।


গত ৩ ডিসেম্বর ২০২২খ্রি. অনুষ্ঠিত এই ভ্রমণে অংশগ্রহণ করেন: সাহিত্য একাডেমির সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক কবি জয়দুল হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া আইডিয়াল রেসিডেন্সিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ সোপানুল ইসলাম সোপান, চেতনায় স্বদেশ গণগ্রন্থাগার এর প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি, কথাসাহিত্যিক আমির হোসেন, জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলাম লিমন, সাহিত্য একাডেমির সহ-সভাপতি কবি ও কথাসাহিত্যিক অ্যাড. মানিক রতন শর্মা, উলচাপাড়া মালেকা সাহেব আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কবি সেলিম হোসাইন হাওলাদার, আশুগঞ্জ ফিরোজ মিয়া সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক, কবি এম.এ হানিফ, সাবেরা সোবহান সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক, তিতাস সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদ এর উপদেষ্টা, কবি ও গীতিকার মোঃ আব্দুর রহিম, পৌরসভার বাজার পরির্দশক, অ্যাড. হুমায়ূন কবীর ভূঁঞা, রোকেয়া সাহিত্য পরিষদের সভাপতি কবি রোকেয়া রহমান কেয়া, উদীচী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌসুর রহমান, এএমটিভি নিউজ বাংলার বার্তা সম্পাদক কবি রুদ্র মোঃ ইদ্রিস, নদী নিরাপত্তার সামাজিক সংগঠন নোঙরের জেলা কমিটির সভাপতি শামীম আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক খালেদা মুন্নি, অংকুর শিশু-কিশোর সংগঠনের সভাপতি আনিসুল হক রিপন, কবি শাহ মাহমুদা আক্তার, প্রর্বতক আবৃত্তি সংসদের সাধারণ সম্পাদক আবৃত্তি শিল্পী সোহেল আহাদ, আইপি চ্যানেল পথিক টিভির চেয়ারম্যান, কবি রাবেয়া জাহান তিন্নি, ঝিলমিল একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ, মুক্তধারা সাহিত্যাঙ্গন এর সাধারণ সম্পাদক, সমাজকর্মী কহিনুর আক্তার প্রিয়া, সংস্কৃতিসেবী মোঃ মোসাররফ হোসেন, এম এ সাহেদ ও মোঃ জাহাঙ্গীর আলম।


পরে পরিদর্শকবৃন্দ আখাউড়া উপজেলার সীমান্তবর্তী খারকোট গ্রামে পৌরসভার বাজার পরির্দশক কবি অ্যাড. হুমায়ূন কবীর ভূঁঞা এর গ্রামের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজ ও আলোচনা সভায় মিলিত হন। উপস্থিত গুণিজন ভ্রমণ নিয়ে নিজের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন।


মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক
ঝিলমিল একাডেমি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

তথ্যসূত্র: 
* মোঃ জয়দুল হোসেন
* ইউকিপিডিয়া বাংলা
* ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ