পৃথিবীর সব নদী কবিতার ছন্দে বয়ে যায়। পৃথিবীর সব পাখি কবিতার সুরে ডেকে ওঠে। পৃথিবীর সব ফুল কবিতার মতই সৌরভ ছড়ায়। ঝরনার জল কবেই থেমে যেতো- যদি তা কবিতা হয়ে না ঝরতো। বাতাসের শনশন গতিময় কবিতা। গ্রহ-তারা-নক্ষত্র নিস্তব্ধ আকাশের কবিতা। সৈকতে আছড়ে পড়া সাগরের উত্তাল ঢেউ যেন বিদ্রোহী কিছু কবিতা। কবির বর্ণনা না থাকলে প্রকৃতি আমাদের কাছে এত সুন্দর লাগতো না।
মায়ের হাসি, বাবার শাসন, শিশুর কান্না কবিতা। আজান সুর, মন্দিরের ঘণ্টা, পাঠশালার ডিং ঢং- কবিতা। কবিতা ভালোবাসার কথা বলে, বলে বিরহ-বিচ্ছেদের কথা। ফুল হাতে প্রিয়তমার দিকে এগিয়ে যায় যে তরুণ- সেও এক কবি, আর তরুণীটি তার কবিতা। রক্তের কালিতে ইতিহাস লেখে যারা- তারও কবি।
প্রথম প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কবিতা থেকেই আসে। পিচঢালা পথে বুলেটের সামনে বুকে পেতে এগিয়ে চলে যে মিছিল- সে মিছিলের প্রত্যেকটি সৈনিক একজন কবি আর তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত প্রত্যেকটি স্লোগান এক একটি কবিতা। অত্যাচারীর দিকে নিপীড়িতের নিক্ষিপ্ত ঘৃণা বচন- সেও এক কবিতা নয় কি ?
পৃথিবীর সকল সংবিধান এক একটি কবিতার বই। যে বইয়ের কবিতাগুলো গণমানুষের রক্ত ও ঘামের কালিতে লেখা হয়। লেখ্য এবং উপস্থাপন রীতিতে পৃথিবীর প্রত্যেক ধর্মগ্রন্থ এক একটি কবিতার বই। যে কবিতা মানুষকে ইহজাগতিক ও পরলৌকিক জগতের সুখের সন্ধান দেয়। ধর্মভীরু মানুষদের পৃথিবীর জঞ্জাল থেকে মুক্ত রাখে।
কবিতার সাথে আমাদের নিত্য ঘরগেরস্তি। যে কৃষক সারাদিন রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ফসল ফেলায়, সে ফসল তার কাছে কবিতা। যে চালক দিনরাত পরিশ্রম করে রিকশা, ভ্যান, বাস, ট্রাক মাইক্রোবাস, রেল বা বিমান চালায়- সেই বাহনটি তার কবিতা। যে শ্রমিক পাথর পেটায়, ইট ভাঙ্গে, লোহা কাটে- সেই ইট, পাথর, লোহা তার কাছে কবিতা। দেশের জন্য শত্রুর দিকে ছুঁড়ে দেওয়া প্রতিটি বুলেট একজন সৈনিকের কবিতা।
শব্দের কবি তার নিজের দেখা, শেখা, যাপন ও উপলব্ধি করা জীবনকে শব্দ-বাক্যর যুগলবন্দির নান্দনিক উপস্থাপনায় পাঠকের মনের আয়নার সামনে প্রতিস্থাপন করে। কিছুটা কল্পনা, কিছুটা বাস্তবতার মিশেলে কবিতা অনবদ্য পাচন তৈরি হয়ে মানুষের হৃদয়ের হিংসা-বিদ্বেষ, কালিমা ও হতাশাকে দূর করে দেয়।
যে কবিতার এত বৈচিত্র্য, যে কবিতা এত পরশ পাথরীয় গুণ- সেই কবিতা যখন শিল্পীর কণ্ঠে সুর, তাল, ছন্দের উঠানামায় দুলতে থাকে- তখন সেই কবিতা যাদু মন্ত্রের শ্রোতার শরীর ও মনে মায়াবী প্রভাব বিস্তার করে। সে কবিতা আরো বেশি জীবনমুখী ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
বস্তুতো কবিতা কামরূপ-কামাখ্যার যাদু মন্ত্র কিংবা আলফ্রেড নোবেলের ডায়নামাইটের চেয়েও কম শক্তিশালী নয়। কোনো কোনো কবিতা পারমাণবিক বোমার চাইতেও শক্তিশালী। সমাজ, রাষ্ট্র আর মানুষের মন পরিবর্তনের যে শক্তি কবিতায় আছে- সে শক্তি পৃথিবীর আর কোনো অস্ত্রের নেই।
মায়ের বুকে দোল খেতে খেতে কবিতা শিখে আমরা বড় হই। কবিতার দোলনায় দুলতে দুলতে আমরা বেড়ে উঠি। জীবনের ভাঁজে ভাঁজে কবিতার সৌরভ নিয়ে আমরা এগিয়ে যাই। এগিয়ে যাই মৃত্যুর দিকে। একদিন আমাদের অন্তিম যাত্রায় শোকাহত মানুষের কণ্ঠে যে স্লোক, মন্ত্র বা আয়াত বেজে ওঠে- সেও একটি কবিতা।
যে কবিতা ভালোবাসে না, সে মানুষকে ভালোবাসে না। যে কবিতা ভালোবাসে না- সে জীবনকেও ভালোবাসে না। আর যে কবিতা ভালোবাসে, সে হয় সবচেয়ে নান্দনিক মানুষ, মানবিক মানুষ।
আজ ২১ র্মাচ, বিশ্ব কবিতা দিবস। সকল কবিতার কবিদেরকে জানাই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
--------
কবিতার সাথে ঘরগেরস্তি
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
(কবিতা কর্মী)
0 মন্তব্যসমূহ