Ticker

6/recent/ticker-posts

সুগন্ধার তীরে শুধুই পোড়া লাশের গন্ধ।


এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন নিয়ে বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকায় গতকাল প্রকাশিত ১৫টি হৃদয়বিদারক ঘটনা  ও সংবাদের উল্লেখযোগ্য অংশ

০১) ক্যান্সার আক্রান্ত শ্বশুরকে ডাক্তার দেখাতে মেয়ে তাইফা আফরিনকে (১০) সঙ্গে নিয়ে ঢাকা গিয়েছিলেন বরগুনা সদর উপজেলার কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের রোডপাড়া গ্রামের বশির উদ্দিন কিন্তু ঢাকা থেকে ফেরার পথে এমভি অভিযান-১০ যাত্রীবাহী লঞ্চে আগুন লাগে ঘটনার সময় জীবন বাঁচাতে লঞ্চ থেকে ঝাঁপ দেন তাইফার নানা তাকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি তাইফার বাবা তাইফা লঞ্চের ডেকে আটকে পড়েন তাইফা অগ্নিদগ্ধ হয়ে লঞ্চেই মারা যায়, তার বাবা বশির গুরুতর দগ্ধ হন বর্তমানে তাইফার বাবা বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তাইফার মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে

০২) অসুস্থ নানিকে দেখার জন্য এমাসের শুরুর দিকে বরগুনা থেকে স্বামী আব্দুল খলিল দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যায় আসেন ২৮ বছর বয়সী জেসমিনরাতে ওই লঞ্চে আগুন লেগে গেলে কোনোরকম সন্তানদের নিয়ে থেকে বের হন, কিন্তু ততোক্ষণে তাদের শরীরে অনেকাংশই পুড়ে যায় জেসমিনের মেয়ে মাহিনুরের পুরো শরীর ঝলসে যায় মাওয়া লঞ্চ ঘাটে মাহিনুর মারা যায়চিকিৎসকরা জানান, জেসমিনের মুখ-হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে গেছে; তামিমের হাত-পা-মুখ পুড়ে গেছে তার মামা মামুন বলেন, “সন্তানের জন্য আহাজারি করছে জেসমিন, কোনো কিছু বলেই তাকে থামানো যাচ্ছে না তারও শরীরের অনেকখানি পুড়ে গেছে তার আরেকটা বাচ্চাও পোড়া ক্ষত নিয়ে কাতরাচ্ছে


০৩) যখন লঞ্চে আগুন লাগলো তখন কিছু বুঝে উঠতে পারেনি কেউ অল্প সময়ের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পরলে কেউ লঞ্চ দিয়ে লাফ দিচ্ছে মাঝ নদীতে আবার কেউ লাফ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় আমার ১৩ বছরের ছেলে ইমরান হোসেন রানাকে নিয়ে মৃত্যুর জন্য দোয়া কালাম পরে রেডি হয়ে যাই ছেলেকে বলেছি, বাবা পড়াশুনা আর রেজাল্টের জন্য তোমাকে মেরেছি, বকাঝকা করেছি, মাফ করে দিও দেখা হবে কেয়ামতে- এই বলে ছেলেকে যখন চুমু দেই তখন সেও আমার গালে চুমু দেয় এমন হৃদয় বিদারক দৃশ্যের কথা বাংলানিউজকে বলছিলেন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়া এমভি অভিযান-১০ লঞ্চের ডেকের যাত্রী রিনা বেগম তিনি বলেন, ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় আমাদের বসবাস, বাবার বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় আর শ্বশুর বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটায় তিন দিনের ছুটিতে ছেলেকে নিয়ে বাবার বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছিলাম লঞ্চে ওঠার সময়েই দেখি পুরো লঞ্চে যাত্রী পরিপূর্ণ, কেবিনও পাইনি তাই নীচতলার ডেকের মাঝামাঝি একটু জায়গা পেয়ে সেখানে বসে পরি এরপর রাতে ছেলে ঘুমালেও আমি ঘুমাতে পারিনি হঠাৎ করে যখন ডেকের ভেতরে ধোঁয়া আর আগুন আসতে থাকে তখন ছেলেকে টেনে অপরদিকে নিয়ে যাই ততক্ষণে দেখি অনেকেই নদীতে ঝাপ দিচ্ছে কিন্তু আমার ছেলে তো সাঁতার জানে না, তাই নদীতে ঝাপ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা আর তখন লঞ্চটি মাঝ নদীতে তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত উপায়ন্ত না দেখে ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দেই এরপর দেখি ছেলের মাথা ভাসছে তখন আমিও বোরকা ছিড়ে ফেলে ঝাপ দেই নদীতে ছেলেকে ধরে কোনভাবে খুব কষ্টে সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হই এরপর নদী তীরের লোকজন সহায়তায় এগিয়ে আসেন তাদের দেওয়া কাপড় পরে লঞ্চে নিজেদের মালামাল খুজতে এসেছি


০৪) এ লঞ্চে ঢাকা থেকে পাথরঘাটার ফুলঝুড়ি যাবার উদ্দেশে বছরের নাতী ফাহিমকে নিয়ে উঠেছিল নানী জরিনা বেগম কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস লঞ্চে আগুন লাগায় নাতিকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন জরিনা বেগম এই ঘটনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, হঠাৎ লঞ্চে আগুন লাগায় দিশেহারা হয়ে যাই এক সময় আগুনের তাপ সহ্য করতে না পেরে নাতিকে কাঁধের ওপর নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিই কিছু দূর সাঁতরে যাবার পরে আমি ডুবে যাচ্ছিলাম তখন আমি নাতিকে হাত থেকে ছেড়ে দিয়ে পাড়ে উঠে আসি নাতিকে পাব কিনা জানি না তবে তার লাশটা পেলেও শান্তি পেতাম কারণ ওর বাবা মায়ের কাছে কীভাবে তাদের সন্তান আমি ফিরিয়ে দেব

০৫) ঢাকায় চিকিৎসা শেষে অভিযান-১০ লঞ্চে নিজ বাড়ি বরগুনার বামনা উপজেলায় স্বামী গোলাম রহমানকে নিয়ে ৩৬০ নম্বর কেবিনে ফিরছিলেন ষাটোর্ধ্ব মমতাজ বেগম লঞ্চটি বরিশাল লঞ্চঘাটে শেষ নোঙর করার পর রাত ৩টার দিকে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদী পার হয়ে বিষখালীর মোহনায় পৌঁছার পর আগুনের বিষয়টি টের পান তারা ততক্ষণে আগুন লঞ্চটির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ স্থানে পৌঁছে গেছে তারা দুজনে দৌড়ে কেবিন থেকে বেড় হয়ে সিঁড়ির কাছে গিয়ে দেখেন গেট বন্ধ অনেক ধাক্কাধাক্কি করেও তারা গেট খুলতে না পেরে তিনতলার রেলিংয়ে মমতাজের শাড়ি বেঁধে স্বামী গোলাম রহমান তাকে কোনোমতে দ্বিতীয় তলায় নামান পরে তিনি নিজেও ওই শাড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় নামেন বৃদ্ধ অসুস্থ স্ত্রীকে দ্বিতীয় তলা থেকে নিচে জলে ফেলে দিয়ে নিজেও লাফ দিয়ে স্ত্রীকে ধরে কোনোমতে তীরে ওঠেন এতে স্ত্রী মমতাজ বেগমের কোমরে এবং মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান স্থানীয়রা তাকে গরম কাপড় দিলে তারা দুজনেই গ্রামের বাড়ি বামনায় ফিরে আসেন তারা বর্তমানে বামনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছেন


০৬) ওই লঞ্চের যাত্রী পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসাইন মোহাম্মদ আল মুজাহিদ ঢাকা থেকে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন স্ত্রীকে নিয়ে ছিলে লঞ্চের ভিআইপি কেবিনে হঠাৎ চিৎকার শুনতে পেয়ে বের হয়ে দেখেন আগুন লেগেছে উপায় না পেয়ে স্ত্রীকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন তিনি তবে ঝাঁপ দেওয়ার সময় তার স্ত্রীর একটি পা ভেঙে গেছে বলে জানা গেছে ইউএনও জানান, ‘রিভার ভিউয়ের দিকে কেবিনে যেসব যাত্রী ছিল, তারা অনেকেই বের হতে পেরেছে যাদের কেবিন লঞ্চের মাঝখানে ছিল, তাদের অনেকেই ধোঁয়ার কারণে বাইরে বের হতে পারেনি

০৭) আগুনে ভাগ্নে রাশেদ সর্দারেরে দগ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে তার মামী বরগুনার বাসিন্দা তাহেরা আক্তার ছুটে এসেছেন তিনি বলেন, রাশেদ বাবুর্চির কাজ করে সংসার চালায় কিছুদিন আগে তার বাবা মারা যায় বাবার চেহলামে বাড়ি এসেছিল তার বড় ভাই, ভাবি দুই ভাতিজি, ভাতিজা তার মা লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে রাশেদের ভাই মা বেঁচে গেলেও ভাবি দুই ভাতিজি, ভাতিজা নেই

০৮) অগ্নিকাণ্ডে ভাইয়ের ছেলে দগ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান চাচা জালাল আহমেদ বরগুনা সদর উপজেলার বালিয়াতলী এলাকার এই বাসিন্দাকে সার্জারি ইউনিটের সামনে বসে থাকতে দেখা যায় জালাল বলেন, নারায়ণগঞ্জে একটি মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আমার ভাইয়ের ছেলে লোকমান হোসেন আগুনে পুড়ে সে এখন মেডিকেলে ভর্তি কথা বলতে পারছে না


০৯) সাইদুর রহমান বলেন, পোড়া গন্ধ পেয়ে কেবিন থেকে আমি বেরিয়ে দেখি লঞ্চে আগুন লেগেছে সময় স্ত্রী শ্যালককে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিই প্রচণ্ড ঠান্ডায় নদী সাঁতরে তীরে উঠতে পেরেছি আমরা

১০) নারায়ণগঞ্জ থেকে বরগুনায় বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল ১৩ বছরের রাকিবুল তবে বাড়িতে আর যাওয়া হয়নি তার লঞ্চে আগুনের খবর পেয়ে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে একমাত্র ছেলেকে হন্যে হয়ে খুঁজছেন বাবা শাহজালাল আগুনে পুড়ে যাওয়া লঞ্চ অভিযান-১০ বা হাসপাতাল, কোথাও মিলছে না তার ছেলের খোঁজ বরগুনার পাথরঘাটার বাসিন্দা শাহজালাল বলেন, ‘সন্ধ্যার দিকে সদরঘাট থেকে অভিযান-১০ লঞ্চে ওঠে রাকিবুল এরপর আর কথা হয়নি আমার ছেলে নারায়ণগঞ্জে মাদরাসায় পড়ত ওর কপালের ডান পাশে তিল রয়েছে

১১) এ লঞ্চ দুর্ঘটনায় হারিয়ে গেছে বরগুনার ৯ম শ্রেণির ছাত্র কৃষ্ণ হালদার তার চাচা সমির হালদার এই দুর্ঘটনার খবর পেয়ে বরগুনা থেকে ঝালকাঠি ছুটে আসেন সঙ্গে ছিলেন হারিয়ে যাওয়া কিশোর কৃষ্ণ হালদারের বাবা সঞ্জিব হালদার লঞ্চ দুর্ঘটনার পর নদীর তীরে বসে তাকিয়ে ছিলেন লাশ উঠানো ট্রলারে দিকে সময় অশ্রুশিক্ত চোখে কৃষ্ণর চাচা সমির হালদার জানান, ঢাকা থেকে বরগুনার বামনায় যাওয়ার জন্য এই লঞ্চে উঠেছিল কৃষ্ণ, তার ভাই মা মা ভাইকে পাওয়া গেলেও কৃষ্ণের সন্ধান মেলেনি সন্তান হারিয়ে বাকরুদ্ধ বাবা সঞ্জিব হালদার কোনো কথাই বলতে পারেননি শুধু এতটুকুই বলেছে আমি আর কৃষ্ণকে পাব কিনা জানি না তবে ওর শেষ ইচ্ছা ছিল বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে ঘুরতে যাবে ওকে নিয়ে হয়তো আর ঘোরা হবে না


১২) মোর মাইয়াডারে পাই নাই, মোর মাইয়াডারে আমনেরা (আপনারা) আইন্যা দেনআড়াই বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে তাবাসসুমের শোকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালের বেডে চিকিৎসাধীন বাবা নাসরুল্লাহ তুহিন এই আকুতি করছিলেন পাশের বেডে সন্তানের শোকে অজ্ঞান তার স্ত্রী তানিয়া বেগম তুহিনের বাড়ি পাথরঘাটা উপজেলার কালমেঘা ইউনিয়নের ঘুটাবাছা গ্রামে তিনি ঘুটাবাছা বাজার জামে মসজিদের ইমাম

১৩) ফোনে বাংলানিউজকে তিনি জানান, ঢাকা থেকে পাথরঘাটার উদ্দেশে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে উঠেন তুহিন রাত প্রায় তিনটার দিকে লঞ্চে আগুন লাগে সময় প্রাণে বাঁচতে অনেকে নদীতে লাফ দিচ্ছিলেন তাদের দেখে স্ত্রী-সন্তানসহ নদীতে লাফ দেন তুহিন কিন্তু নদীতে কিছুক্ষণ সাঁতার কাটার পর হাত থেকে ছুটে যায় তাবাসসুম এরপর আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি এরপর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জ্ঞান ফেরে তুহিনের তার স্ত্রী তানিয়ার এখনও জ্ঞান ফেরেনি

১৪)শুক্রবার বেলা ১টার দিকে বাবুল বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বসে সমকালকে জানান, তার ভাইঝি সোনিয়া (২৫), সোনিয়ার দুই ছেলে জুবায়ের জুনায়েদ এবং তার মা রেখা বেগম দুর্ঘটনা কবলিত অভিযান-১০ লঞ্চে করে বরগুনা যাচ্ছিলেন আগুন লাগার পরপর সোনিয়া তার বছরের শিশু জুবায়েরকে নিয়ে সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হলেও তার দুই বছরের ছেলে জুনায়েদ রেখা বেগমকে এখনও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না  বাবুল বলেন, ‘মোর মা আর নাতিডারে পাই না ওগো কোমমে তা মুই জানি না আল্লা মোর মায়েরে আর নাতিডারে ফিরিয়ে দাও

১৫)পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার দেউলী গ্রামের বাসিন্দা মো. রণি (১৫) খুঁজছিলেন মা রীনা বেগম বোন লিমাকে বার বার আহতদের শয্যার কাছে গিয়ে মা আর বোনকে না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন রণি রণি নিজেও আহত হয়েছে


এমভি অভিযান ১০ নামে একটি লঞ্চ ঢাকা থেকে বরগুনার উদ্দেশ্যে গতরাতে ছেড়ে যায় ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে পৌঁছলে রাত ৩টার দিকে এতে আগুন ধরে যায় লঞ্চটি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে ছেড়ে যাবার সময় দোতলার ডেক বেশ গরম ছিল এনিয়ে যাত্রীরা অভিযোগ করলে লঞ্চের স্টাফরা তখন কার্পেট বিছিয়ে দেন কিন্তু এই গরম ক্রমাগত বাড়তেই থাকে একপর্যায়ে ইঞ্জিন রুমে আগুন ধরে যায় বলে যাত্রীদের অভিযোগ এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর যদি দ্রুত লঞ্চটিকে নদী তীরে নোঙর করা যেতো তবে এতো হতাহতের ঘটনা ঘটতো না বলে দাবি করেছেন যাত্রীরা

লঞ্চ থেকে লাফিয়ে প্রাণে বাঁচা কয়েকজন যাত্রী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যাত্রী এবং তাদের স্বজনরা জানান, হঠাৎ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে লঞ্চে আগুন লাগে ইঞ্জিনরুম থেকে আগুন দ্রুত পুরো লঞ্চে ছড়িয়ে পড়তে থাকে আগুনের লেলিহান শিখা ধোঁয়ায় পুরো লঞ্চ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সময় লঞ্চের ডেকে হুড়োহুড়ি শুরু হয় প্রাণ বাঁচাতে অনেকে নদীতে ঝাঁপ দেয় যারা কেবিনে ঘুমিয়ে ছিলেন, তারা চিৎকার শুনে বের হয়ে চারদিকে ছোটাছুটি করতে থাকে ধাক্কাধাক্কি পদদলিত হয়ে অনেকে আহত হয় পুরো লঞ্চের যাত্রীরা ডাক-চিৎকার আর আর্তনাদ করতে থাকে যে যেভাবে পেরেছে নিজের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেছে অনেকে স্বজনদের রেখেই ঝাঁপ দিয়েছে নদীতেঅনেকেই বেঁচে ফেরার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন একপর্যায়ে সন্তান সাঁতার জানে না নাড়িছেঁড়া ধন রেখে নদীতে ঝাঁপ দেবেন কীভাবে মা-বাবা আবার অনেক স্বামী-স্ত্রীরাও এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিলেন শেষমেশ বিধাতার ওপর ভরসা রেখে অনেকেই ঝাঁপ দেন নদীতে কেউ কেউ বেঁচে ফিরলে, পারেননি অনেকে

মুনুসুর নামে ৭০ বছরের এক বৃদ্ধ বাংলানিউজকে জানান, ‘নলছিটির পরপরই লঞ্চটিতে আগুন লাগেতখনও এর মাত্রা প্রকট ছিল না যাত্রীরা লঞ্চটিকে তীরে নিতে স্টাফদের গালমন্দও করেছে তবে চালক কিছুটা তীরে নিয়ে আবার লঞ্চটিকে নদীর মধ্যে নিয়ে আসেন সময় আগুনের তীব্রতা বেড়ে গেলে, বেশিরভাগ নদীতে ঝাঁপ দেয়লঞ্চের যাত্রী আব্দুল্লাহ বলেন, যারা ঝাঁপ দিতে পারেনি বা যারা সাঁতার জানেন না তারা পুড়েই অঙ্গার হয়ে গেছেন যদি লঞ্চটিকে কোনোভাবে সঙ্গে সঙ্গে তীরে নেওয়া যেতো তাহলে এতো লোক মারা যেতো না রিনা নামে অপর এক যাত্রী জানান, পুরো লঞ্চে আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে কাউকে দেখা যায়নি হয়তো তাদের আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত সরঞ্জামই ছিল নালঞ্চটির যাত্রী রিমন হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, লঞ্চটি ঝালকাঠি ঘাটে ভেড়ার ১০ থেকে ১৫ মিনিট আগে আগুন লাগে মাস্টার প্রথমে লঞ্চটি পাশের একটি চরে ভেড়ান এর পর দ্রুত লঞ্চটি আবার নদীর মাঝে নিয়ে যান

এদিকে ভোর থেকে নদীতে তল্লাশি করে লঞ্চের যাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করেছে কোস্টগার্ড আগুনে দগ্ধ ৩০ জনের বেশিরভাগেরই পরিচয় জানা কঠিন হয়ে যাবে বলে জানিয়েছে উদ্ধারকারীরা এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪১ নিহতের খবর পাওয়া গেছে ঘটনায় দগ্ধ হয়েছেন প্রায় দুই শতাধিক যাত্রী নিখোঁজ রয়েছেন আরও অনেকে

ভয়াবহ এক লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো বছরের শেষ সময়টা যার সাক্ষী লঞ্চের বেঁচে যাওয়া যাত্রীসহ সুগন্ধা তীরের মানুষ বরগুনার বিভিন্ন এলাকার নিখোঁজ যাত্রীদের খুঁজতে ঘটনাস্থলে গেছেন স্বজনরা নিখোঁজ স্বজনদের খুঁজতে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের শয্যার কাছে ছুটে বেড়াচ্ছেন স্বজনরা  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবিসহ পোস্ট দিয়ে খোঁজার চেষ্টা করছেন তারা

এদিকে প্রত্যক্ষদর্শী লঞ্চের কেবিন বয় ইয়াসিন (১৯) গণমাধ্যমকে বলেছেন, লঞ্চের নিচতলার পেছনে ইঞ্জিনরুমের পাশেই ক্যান্টিন সেখানে বিকট শব্দে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে লঞ্চে আগুন ধরে যায় এবং তা দ্রুত ইঞ্জিনরুমে ছড়িয়ে পড়েসেখানে রাখা ১৩ ব্যারেল ডিজেল আগুন বাড়িয়ে দেয় ইঞ্জিনরুম থেকে আগুন চলে যায় ডেকের দিকে

রাতের লঞ্চ ভ্রমণ, তার ওপর আবার শীত যারা কেবিনে ছিলেন তাদের বেশিরভাগই ঘুমিয়েছিলেন ছাড়া শীতের কারণে অন্য যাত্রীরাও গরম কাপড়ে শরীর মুড়ে ঘুমিয়ে ছিলেন রাত ৩টার দিকে হঠাৎ বিস্ফোরণের পর আগুন ছড়িয়ে পড়ে এতে সবাই আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়েন

ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা পুরো লঞ্চে তল্লাশি শেষ করেছে শুক্রবার (২৪ ডিসেম্বর) দুপুরে যদিও এখনো চুড়ান্তভাবে অভিযান সমাপ্তির ঘোষণা করেননি তারা তবে তাদের তল্লাশি অভিযানের পর পুরে লঞ্চটি ঘুরে লোহার পাত আর যন্ত্রাংশ ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়নি এমনকি লঞ্চের কেবিনের দরজা, কেবিনে থাকা খাটের কাঠের চালা, টেলিভিশন, ম্যাট্রেক্স, ফ্যানের পাখা সবকিছুই আগুনে পুড়ে গেছে লোহার ডেকের ওপর শুধু কয়লা-ছাই আর ভাঙা কাচের স্তুপ এমনকি দরজা-জানালার কাচ, বাথরুম সিরিতে থাকা টাইলসগুলোও ফেটে চুড়মার হয়ে গেছে

রাত ৩টার কিছু সময় পর প্রতিবেশীদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে যায় বাইরে বের হয়ে দেখি সুগন্ধা নদী আলোকিত আশ্চর্য হলাম জানতে পারলাম, লঞ্চে আগুন লেগেছে আমার বাসা লঞ্চঘাট এর আগেও লঞ্চে আগুন দেখেছি কিন্তু কখনো সম্পূর্ণ লঞ্চ একসঙ্গে জ্বলতে দেখিনি দাউ দাউ করে জ্বলন্ত লঞ্চটি স্রোতে পশ্চিমে নিয়ে যাচ্ছিল কথাগুলো বলছিলেন ঝালকাঠি লঞ্চঘাটের জ্বালানি তেলের ব্যবসায়ী মো. এরশাদ শুক্রবার (২৪ ডিসেম্বর) দুপুরে কথা হয় তার সঙ্গে এরশাদ বলেন, তাৎক্ষণিক কী করবো মাথায় আসছিল না মানুষের কান্না, চিৎকার নদীর এপাড় থেকেই শুনছিলাম বাতাসে ভেসে আসছিল পোড়া গন্ধ

তিনি বলেন, আমার নিজের একটি ট্রলার আছে ট্রলারের মাঝিকে ডেকে তুলে ট্রলার স্টার্ট দিতে বলি ঘাটের আরও ১০/১২টি ট্রলার মাঝিকে এক করে লঞ্চের দিকে রওয়ানা হই এদিকে লঞ্চঘাটের মসজিদের ইমাম এবং পাশের আরও একটি মসজিদের ইমামকে মোবাইলে জানাই যেন তারা মাইকিং করে এলাকাবাসীকে নদীর তীরে আসতে বলেন কোনো যাত্রী যদি ভেসে যান বা তীরে সাঁতরে ওঠেন তাকে সাহায্য করে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন দুই মসজিদ থেকে মাইকিং করে জানানো হয় এরপর শত শত মানুষ নদীর তীরে এসে দাঁড়ান এরশাদ বলেন, একযোগে ১০/১২টি ট্রলার নিয়ে লঞ্চের কাছাকাছি পৌঁছেও লঞ্চের সঙ্গে ট্রলার ভিড়াতে (নোঙর) পারছিলাম না কারণ লঞ্চের বডি আগুনে লাল হয়ে গিয়েছে আগুনের এতো উত্তাপ কমপক্ষে পঞ্চাশ গজ দূরে ট্রলার থামিয়ে ঘুরতে হয়েছে

এই ব্যবসায়ী বলেন, যখন আমরা ট্রলার নিয়ে যাই তখনো লঞ্চের মধ্য থেকে মানুষের আর্তনাদ ভেসে আসছিল মানুষ পোড়া গন্ধ, বাতাসে শ্বাস নেওয়া যাচ্ছিল না এর মধ্যে লঞ্চঘাট এলাকার সবাই কাজ চালিয়ে যাই আমরা প্রথম অবস্থায় ১৪ জনকে উদ্ধার করে ঝালকাঠির এপাড়ে এনে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠাই এরশাদ বলেন, আমরা যে ১৪ জনকে উদ্ধার করেছি তারা সবাই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন লঞ্চের মধ্যে আটকে পড়া কাউকে উদ্ধার করতে পারিনি আমরা কারণ লঞ্চের কাছেই যাওয়া যাচ্ছিল না

এরশাদের ট্রলারে উদ্ধার হওয়া যাত্রী ইকরামুল ইসলাম বলেন, আগুন লাগার পর নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ি সেখানে কিছুক্ষণ সাঁতারের পর কয়েকটি ট্রলার আমাদের উদ্ধারে যায় তখন উদ্ধারকারী ট্রলারে উঠে প্রাণে রক্ষা পেয়েছিরনি নামে আরেক যাত্রী বলেন, ২০ জনের মতো লোক যখন লঞ্চের সামনে ছিল তখনো আমি আগুনের মধ্যে লঞ্চে ছিলাম এরপর আর পারছিলাম না আমার চোখের সামনে একটা বাচ্চা আর একজনকে পুড়ে মারা যেতে দেখেছি যখন আর পারছিলাম না তখন নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ি কিছুক্ষণ পরে ১০/১২টি ট্রলার দেখি আমাদের দিকে আসছে তারা এসে আমাকে উদ্ধার করেন তিনি আরও বলেন, যখন স্থানীয়রা উদ্ধার করছিল তখন কোনো ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আসেনি আমাদের উদ্ধার করে ঝালকাঠি লঞ্চঘাটে নিয়ে আসলে দেখি পুলিশের দুটি পেট্রল টিম আর কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স ঘাটে এসেছে

নৌপুলিশের সিনিয়র এই কর্মকর্তা আরও বলেন, 'লঞ্চের ভেতর ঘুমন্ত যাত্রী যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে প্রায় ৩০ জনের মরদেহ উদ্ধার করে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে নিয়ে যায় জেলা প্রশাসন জেলা পুলিশ ১৫০ থেকে ২০০ জন বরিশাল শের--বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছি'

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে দেড় লাখ টাকা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী শুক্রবার বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দগ্ধ ব্যক্তিদের দেখার পর সাংবাদিকদের কথা জানান প্রতিমন্ত্রী

সংগ্রহেঃ-মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

২৫ ডিসেম্বর ২০২১ খ্রি.


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ