Ticker

6/recent/ticker-posts

ঝড়-বৃষ্টি মানেই সবার জীবনে সুখের অনুভূতি নয়।


এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেও কয়েকবার বাসা থেকে বের হতে হলো রোদ-বৃষ্টিতে ছাতা ব্যবহার করি কিন্তু ঝড়তো ছাতা মানে না ফলে আজ এক রকম ভিজে ভিজে আসা-যাওয়া করতে করতে মনে মনে নিজের ভাগ্যকেই তিরস্কার করছিলাম। রাতে কিছু ব্যক্তিগত কাজে আবারো বাসা থেকে বের হলাম। গিন্নী বললো- এমন দিনে আবার বাহিরে যাবেন ? আমি বললাম যেতেই হবে 'প্রতিদিনের কাজ প্রতিদিন না করলে কাজ জমে যায়’।

বাহিরে প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া আর থেমে থেমে বৃষ্টি। রাস্তায় পিছলে পড়া, গাছের ডাল বা অন্য কিছু উড়ে এসে মাথায় পড়ার ভয়তো আছেই। এসবের মধ্যেই একরকম ক্লান্তি আর হতাশা নিয়ে রাত প্রায় দশটায় বাসায় ফিরলাম।বাচ্চা, বাচ্চার মা এটা সেটা বলছিলো। এর মধ্যে বাচ্চার মা' একটি বাক্যে নিজের সারাদিনের সব ক্লান্তি যেন উবে গেল। বাচ্চার মা বলছিল- এতো ঝড় হচ্ছে, আর কারেন্টটাও বারবার আসা যাওয়া করতেছে, কিছুই ঠিকমত করতে পারছি না। আমি বললাম নিরাপত্তার কারণে কারেন্ট বারবার আসা যাওয়ার করাটাই স্বাভাবিক। আর ঝড়ের গতি-তাণ্ডব বাসার ভিতর থেকেতো পুরোপুরি বুজতে পারবে না। গিন্নী বলল, আমাদের এখানেই এরকম অবস্থা। তাহলে যে এলাকাই আসল ঝড় হচ্ছে ওখানকার মানুষদের যেনো কি অবস্থা!

গামছা দিয়ে হাত-মুখ মুছছিলাম। গিন্নীর কথায় আঁতকে উঠলাম, কথাটি মনের ভিতর গেঁথে গেল। আসলেইতো আমাদের এখান থেকে কয়েকশ কি.মি. দূরত্বে ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। আমাদের দূর্ভোগের যদি এইরকম মাত্রা হয়। তাহলে উপকূলবাসী কী সাংঘাতিক অবস্থায় আছে তা কী আমরা অনুমান করতে পারিনিজের সারাদিনের পরিশ্রম, কষ্ট, হতাশা যেন নিমেষেই ভুলে গেলাম। গিন্নিকে বললাম তোমার এই কথা নিয়ে কিছু এখন একটা লিখব। বলেই মোবাইল হাতে নিলাম।

আসলে উপকূলবাসীর দুঃখ, কষ্ট অনউপকূলীয়বাসী আমরা কখনোই বুঝতে পারিনি বা বোঝার চেষ্টা করিনি। প্রতিবছর সীডর, আইলা, মহাসেন, ফণী, নার্গিস, রোয়ানু, আম্ফান প্রভৃতি প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় এসে তাদের স্বাভাবিক জীবনকে নষ্ট করে দেয়। ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ফসলি ক্ষেত, মাছের ঘের সবকিছু ভাসিয়ে, উড়িয়ে নিয়ে যায়।

ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস কেন্দ্রের বিপদ সংকেত শুনতে পেয়েই চাকরি, ব্যাবসা, কৃষিকাজ, লেখা-পড়া, বিয়ে বা অন্য কোন সামাজিক কাজ কর্ম, এমনকি ধর্ম-কর্ম ফেলে সবাইকে ছুটতে হয় আশ্রয় কেন্দ্রে। সেখানে আধপেট শুকনো খাবার খেয়ে কাটাতে হয় কয়েকদিন। থাকা, খাওয়া, শোয়া, ঘুমানো, চিকিৎসা সবকিছুতেই এক অবর্ণনীয় কষ্টে তাদের দিনপাত করতে হয়।

তারপর প্রকৃতি যখন শান্ত হয়, সবাই যখন নিজ নিজ বাড়িতে ফেরে সেখানো শুরু হয় আবার যুদ্ধ। ভাঙ্গা ঘর, দোকানপাট, রাস্তা, মেরামত করে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পালা। কিন্তু সবাই কি আবার স্বাভাবিক হতে পারে? কারো কারো জীবনে নেমে আসে সারা জীবনের দুঃখের বোঝা। আর যারা স্বাভাবিক হতে পারে তারাও বা টেকে কত দিন। আবারো অন্য কোন দূর্যোগ এসে কেড়ে নেয় তাদের স্বাভাবিকতা।

উপকূলের মানুষের জীবনটা আসলে সংগ্রামী। প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে তাদের টিকে থাকতে হয়। ভাগ্য কখনো তাদের সহায় হয়, কখনো হয় না। তাই দুর্যোগ মানেই তাদের জীবনে দুঃখ আর দুর্দশা।

এদিকে আমরা যারা অনউপকূলীয়; আমাদের কাছে ঝড়-বৃষ্টি, দুর্যোগ মানেই হচ্ছে আজকে স্কুল-কলেজে যেতে হবে না। অফিসে যেতে হবে না। দোকানপাট বন্ধ। আজকে বাসায় আমরা মজা করবো, মাস্তি করব। বৃষ্টির দিন মানে আমাদের কাছে বিরিয়ানি-পোলাও, খিচুড়ি, ডিম আর মাংস ভুনা। বৃষ্টির দিন মানে আমাদের কাছে লুডুখেলা, শুয়ে-বসে গল্প করা আর মুভি দেখা।

কিন্তু ঝড়-বৃষ্টি সবার জীবনে সুখের বার্তা নিয়ে আসে না। দিনমজুর, শ্রমিক বা যে প্রতিবেশী ছোটখাটো ব্যাবস্যা করেন, একদিনের আয় বন্ধ থাকলে যাদের চুলায় আগুন জলে না। যে ভিক্ষুক আজ বের হতে পারেনি বলে উপোস করবে অথবা বাসী খাবার খাবে। আজকের আয় দিয়ে বৌ, ছেলে-মেয়ের প্রয়োজনীয় খরচ বা আবদার মিটাবে ঠিক করেছিলো যে পিতা, তাদের কাছে ঝড়-বৃষ্টি মানেই সুখের অনুভূত নয়। তাদের কাছে ঝড়-বৃষ্টি মানে বুক ফাটা কান্না, নীবর চোখের জল। আকাশ থেকে বয়ে আসা বাদলধারারমত বৃষ্টির ফোঁটা তাদের মনের গভীরেও বয়ে যায়। সেখানে বয়ে চলা তীব্র ঝড়ো হাওয়া তাদের সব সাধ, শখ, আহ্লাদও উড়িয়ে নিয়ে যায়।

প্রাকৃতিক দুর্যোগে, ঝড়-বৃষ্টির দিনে আমরা উপকূলবাসীর দুঃখের দুঃখিত হব দূরের কথা, নিজের আসেপাশের মানুষের খোঁজ-খবর নেই না পশু-পাখীর দুঃখের কথাতো বলাই বাহুল্য।

ঝড়-বৃষ্টির দিনে আসুন উপকূলবাসীর জন্য দোয়া করি, তাদের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়াই। সহযোগিতার হাত বাড়াই নিজের আশেপাশের অসহায় মানুষগুলোর প্রতি।

বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা আমাদের ঘুমন্ত মানবীয় অনুভূতিগুলোকে জাগিয়ে তুলুক।


মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

টেংকেরপাড়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

২৪ অক্টোবর ২০২২খ্রি.

রাত ১১.১৯

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ