গতকাল রাতে বৈশাখী ঝড়ে আটকা পড়েছিলাম বৈশাখী মেলায়। তুমুল বৃষ্টিতে আটকা পড়েছে আরো শ-দুশো দর্শক। রাত ১০ বেজে গেলেও মঞ্চে তখনো চলছিল গানের আসর। সুরের মূর্ছনায় মুগ্ধ হয়ে বসেছিল সবাই। কেউ স্বেচ্ছায়, কেউবা নিতান্ত অনিচ্ছায়। বৃষ্টির ছন্দের সাথে দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের সুর-তাল কারো কারো হৃদয়ে একটু বেশিই ঝড় তুলেছিল। তাই বুঝি বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে নেচে গেয়ে বৃষ্টি বিলাশ করছিল বেশ কিছু কিশোর-কিশোরী।
কেনো যেন মনে হল বয়সটা যদি আরেকটু কম হতো, হয়ত আমিও নেমে যেতাম তাদের সাথে। কতদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় না। খেলা হয় না কত দিন। কত দিন নদী-পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি করা হয় না। গাছে চড়াতো ভুলতেই বসেছি। আবারো তরুণ হয়ে কারো না কারো প্রেমে হাবুডুবু খেতে ইচ্ছে করে। আবারও রোমান্টিক উপন্যাস পড়ে নিজেকে উপন্যাসের নায়ক ভাবতে ইচ্ছে করে। গল্প, উপন্যাস কিংবা মুভির মতো অ্যাডভেঞ্চারে বেড়িয়ে পড়তে অথবা কিশোর গোয়েন্দা হওয়ার পুরোনো ইচ্ছেটা জেগে ওঠে। বন্ধুদের নিয়ে পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা- কীইবা বয়স আমার, এখনোতো চল্লিশ পেরোয়নি। তার আগেই- শরীর বুড়ো হওয়ার আগেই- মনটা বুড়ো হয়ে গেলো !
দিন রাতের বেশিরভাগ সময়ই কেটে যায় চাকরি, সংসার আর লেখালেখি নিয়ে। নানা অনুষ্ঠান, আড্ডা, মিটিংতো আছেই। জীবনের অনেক কিছুই হারিয়ে গেল এসবের ভিড়ে। দেয়ালের ঝোলানো ঘড়ির কাঁটা অদৃশ্য মায়া বলে তৈরি করে দিলো প্রাত্যহিক রুটিন। টিকটিক শব্দে প্রতিমুহূর্তে জানিয়ে দেয় এখন তোমাকে গোসল করতে হবে, এখন খেতে হবে, এখন ঘুমাতে হবে, কখন বাসায় থাকতে হবে, কখন বের হতে হবে। সপ্তাহ আসার আগেই পুরো সপ্তাহের কাজের রুটিন দিয়ে ঘড়ির পেছনে লুকিয়ে থাকা কারিগর।
মন যা বলে, মন যা চায়- ঘড়িটা তার উল্টোটাই করতে বলে। কতদিন ভাবি আজ রাত জাগবো, সারারাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিবো, ঘড়ি বলে ঘুমাও এখন; ভোরে ডিউটিতে যেতে হবে। কতদিন ভাবি আজ আর ঘরে ফিরবো না, সংসার বলে- আমার কাছে না আসলে অন্য কোথাও সুখ পাবে না। সংসারের সুখের নেশায় পৃথিবীর অন্য সুখ দেখা হয় না আর। কতদিন ভাবি- কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে অনির্দিষ্ট কালের জন্য দূরে কোথাও হারিয়ে যাব। দু-চোখ যেথায় যায় সেদিকে চলে যাবো। যাযাবরের মত গ্রামে-শহরে, পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবো। রাস্তায়, গাছের ছায়ায়, পার্কে রাত দিন কাটিয়ে দেব ভবঘুরের মতো। চাকরি বলে ছুটি নাই; ছুটি নাই; ছুটি নাই। আর পকেট- ওতো সারা বছর খালিই থাকে।
রাত বাড়ছে, আজে বাজে চিন্তার ছেদ ঘটিয়ে মাথায় ডিজিটাল ব্যানারকে ছাতা বানিয়ে, রাস্তায় জমে থাকা সাত আট ইঞ্চি নোংরা পানির ঢেউ মাড়িয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সারে এগারোটায় বাসায় ফিরেছি। কোথায় বাসায় এসে একটু বিশ্রাম করবো, তার উপায় নেই। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে সেই সন্ধ্যায়, যখন বৃষ্টি টিপটপ করে পরতে শুরু করেছিল। এই ইলেকট্রিসিটি আরেক আজব জিনিস। যেন ডিজিটাল অক্সিজেন। এক মুহূর্ত আর ওকে ছাড়া বাঁচা যায় না। লাইট বন্ধ, ফ্যান বন্ধ, টিভি বন্ধ, কম্পিউটার বন্ধ। হাতের স্মার্টফোনটিও ওয়াইফাই ছাড়া একটি অপদার্থের নির্জীব হয়ে পরে থাকে।
কোথায় বইয়ের বন্ধু হব, গাছের বন্ধু হব, সাথী হবো ফুল পাখির। একা বিড়বিড় করবো বাতাসের সনে। নির্জন ছাদে বসে বসে আকাশের তারা গুনতে চেষ্টা করব। জোছনার জলে গা ধুয়ে দূর করবো মন ও শরীরের ক্লান্তি। পুকুরের পাড়ে বসে এর ওর সাথে আড্ডা জমাবো, তা না সবকিছু কেড়ে নিলো এই ইলেক্ট্রিসিটি। আমাদেরকে তার ওপর শতভাগ নির্ভর করিয়ে সে নিজেই এখন মাঝে মাঝে ঘণ্টা ঘণ্টা হওয়া হয়ে যায়।
এসব ভাবতে ভাবতেই আবছা আলোয় বাসায় টুকটা কাজ করে নিলাম, ফ্রেশ হওয়া, বৃষ্টিতে ভেজা কাপড়গুলোকে ধোয়া আর রাতের খাবার। এর মধ্যেই তিনিও উঁকি দিলেন। মানে ইলেকট্রিসিটির কথা বলছি। রাত প্রায় একটার দিকে তার দেখা পেলাম। সারাদিন নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন থাকায় এই গভীর রাতেও বিছানায় শোয়ার কথা ভুলে কম্পিউটারটাকে চালু করলাম টুকটাক কিছু কাজ করার জন্য।
মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ চেক করার পরে ঢুকলাম ডিজিটাল চিঠির ঘরে (ই-মেইল)। বেশ কয়েকটি ই-মেইল এসেছে দেখা যাচ্ছে। নব ভাবনা থেকে এসেছে দুটি ই-মেইল। এই মেইল খুলে চেক করতেই দেখি নিচের এই পত্রটি। প্রিয় সাময়িকীর লেখক অ্যাম্বাসেডর নির্বাচিত হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পত্র। ১১ জনের সঙ্গে সিলেট বিভাগ থেকেও মনোনীত আমিও একজন।
নব ভাবনার দুটো উড়ো চিঠি পড়ে সারাদিনের ক্লান্তি, অবসাদ, বার্ধক্যকে পৌঁছানোর ভয় যেন নিমিষেই উবে গেলো। আমি যেন নতুন জীবনের গন্ধ পাচ্ছি। পাচ্ছি তারুণ্যের হাতছানি। নব ভাবনা যেন ক্রমেই আমার আরেক অক্সিজেনে পরিণত হচ্ছে।
নব ভাবনার সকল সম্মানিত লেখক, সম্পাদনা-প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং সকল অ্যাম্বাসেডর লেখকগণকে জানাই আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
আমাদের ওপর এখন অনেক দায়িত্ব, অনেক কাজ। যে চিন্তা থেকে, সাংস্কৃতিক জোয়ার ও লেখায় তারুণ্য, নব চিন্তা, বৈপরীত্য ও গণজাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্যে নব ভাবনা কাজ করে যাচ্ছে, সেই স্রোতের সাথে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে হবে। প্রস্তুত হচ্ছি আমরা। শুভকামনা নব ভাবনা।
বৈশাখের নব পাঁচালি
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
১৯ এপ্রিল ২৪
ব্রাহ্মণবাড়িয়া
0 মন্তব্যসমূহ