Ticker

6/recent/ticker-posts

প্রতিভার বিড়ম্বনা


 বাইম মাছের গল্প

প্রতিভার বিড়ম্বনা

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

আজকের গল্পটা একটি বাইম মাছের। গল্পের এই বাইম মাছ থাকতো গ্রামের এক পুকুরে। সেই পুকুরে আরও অনেক রকম মাছ ছিল। সব মাছ বেশ সুখে শান্তিতেই ছিল। মাঝে মাঝে ছেলেপেলেরা বড়শি নিয়ে মাছ শিকার করতে আসে। পুকুরের মালিকও জাল ফেলে মাছ ধরে। এটা অবশ্য মাছেদের জীবনে নিত্য দুর্যোগ। প্রকৃতির এই বিধানের সাথে যুদ্ধ করেই বেঁচে থাকাই তাদের জীবন। যারা ধরা পড়ে তারা মানুষের পেটে যায়। আর যারা ধরা পড়ে না তারা ধরা পড়ার ভয়ে ভয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়। কিন্তু তারপরেও তাদের এই ক্ষুদ্র জীবনে ছিল আনন্দ ও সুখের ছোঁয়া। কারণ তারা সকল মাছ পুকুরে মিলেমিশে বাস করত। নিজেদের মধ্যে কোন ঝগড়াঝাঁটি ছিল না। দুঃখ তাদেরকে কেবল একটাই, বড়শি আর জালে ধরা পড়ার ভয়।

এই পুকুরে সেই বাইম মাছ থাকতো জলের একেবারে নিচে; কাদার তলায়। অন্য মাছেরা এই নিয়ে তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করত। কাদার তলার মৎস্য প্রজাতি বলে তাকে নিয়ে উপহাস করত। এবং নিজেদের সঙ্গে তাকে মিশতে দিতে চাইতো না। এ নিয়ে বাইম মাছের খুব মন খারাপ হতো। সে তো আর ইচ্ছে করে কাদার তলায় থাকে না। তার জন্মই হয়েছে কাঁদার তলায় থাকার জন্য। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। নিজের প্রজাতির সঙ্গে তারা খুব মিলেমিশে থাকে। তাহলে তাকে কেনো এত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হবে। এই নিয়ে বাইম মাছের প্রায় সময় খুব মন খারাপ থাকে।

বাইম মাছের বাবা-মা এবং অন্যান্য বন্ধুরা বোঝায়Ñ দেখো কাদার তলায় থাকলেও আমাদের শরীর কত পরিষ্কার। সারাদিন কাদের তলায় থাকলেও আমাদের গায়ে একদম কাঁদা লাগে না। আর অন্যান্য মাছদের দেখো, এখানে একটু আসলেই তাদের শরীরে কাদা লেগে যায়। তাহলে বলÑ আমরা তাদের থেকে ভালো আছি না? কিন্তু এসব কথায় বাচ্চা বাইম মাছের মন গলে না। সে অন্য মাছদের সঙ্গে ঘুরতে চায়। খেলতে চায়। তাদের সাথে মিশতে চায়।

এমনিভাবে দিন যায়। সপ্তাহ যায়, মাস যায়। বাইম মাছ বুদ্ধি করতে থাকে কীভাবে অন্য মাছদের সঙ্গে মেশা যায়। তখন একদিন হঠাৎ সে একটি বুদ্ধি পেয়েও যায়। সে গান শিখবে। সংগীত চর্চা করে সে সবার প্রশংসা কুড়াবে। তারপর আর তাকে কাঁদার তলায় থাকতে হবে না। সব মাছদের সাথে মিশতে পারবে। তার প্রতিভা দেখে কেউ আর তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে পারবে না। যা ভাবা সেই কাজ। সে গান শিখতে শুরু করে। এবং বেশ কিছুদিনের চেষ্টায় কিছু গান শিখেও ফেলে। তারপর একদিন সে গান শোনাতে হাজির হয় মাছেদের কাছে। প্রথমে সে যায় পুটি মাছের দলে। পুটি মাছটা তখন ‘পুটূপুট, পুটংূপুটং, পুটূপুট’ শব্দে গান গাচ্ছিল।

বাইম মাছ তাদের ডেকে বললÑ ও ভাই পুটি মাছ, তোমরা তো চমৎকার সব গান গাইতে পারো। আমিও কিন্তু গান শিখেছি। কী মিষ্টি আমার গলা। শুনবে নাকি একটি গান। বাইম মাছের কথায় পুটি মাছেরা সব হাসতে শুরু করে। কিন্তু একটি পুটি তাছিল্যর স্বরে বলেÑ মাছ বলে, আচ্ছা গাও তো তোমার গান। তখন বাইম মাছ ‘বুইমূবুইমূবুইম, বুইূবুই, বুইমূবুইমূবুইম’ সুরে মজার একটি গান গাইলো। পুটি মাছদের গানটি ভালোই লাগলো। তারা বাইম মাছের বেশ প্রশংসা করল।

এই না শুনে বাইম মাছের মন আরো বড় হয়ে গেল। সে ভাবলো বাহ্ আমার গানতো পুটি মাছরা পছন্দ করেছে। তাহলে অন্য মাছেরাও পছন্দ করবে। তাই সবাইকেই আমি গান শোনাবো। তারপর থেকে বাইম মাছ প্রতিদিন নানা মাছের ঝাঁকে কাছে যায়। আর তাদেরকে তার গানটি শুনিয়ে দেয়।

রুই, কাতল, তেলাপিয়া, চিংড়ি, চাঁন্দা সব মাছদেরকে সে মিষ্টি গান শোনাতে লাগলো। গান শুনে মুগ্ধ সব মাছ। সবাই তাকে প্রশংসা করতে লাগলো। মাঝেমধ্যে তারা বলাবলি করতে লাগলো- ‘যাক কাঁদায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত বাইম মাছ জাতে উঠেছে’। এই বাইম মাছের সফলতায় অন্যান্য বাইম মাছও বেশ খুশি হল। নিজ জাতির একটি মাছ অন্য জাতিতে যে প্রশংসা কুড়াচ্ছেÑ ভাবতেই গর্বে তাদের শরীর ফুলে উঠলো। 

সবকিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু জাতে ওঠার নেশায় বাইম মাছ তার গান নিয়ে একটু বেশী মাতামাতি শুরু করে দিলো। যখন তখন তার গান এখন অন্য মাছেদের বিরক্ত হওয়ার কারণ বনে গেল। সেদিন তেলাপিয়া মাছের ঝাঁক মনের সুখে সাঁতার কাটছিলো আর গান গাইতে ছিল। তেলাপিয়ার দল তাদের বিখ্যাত দলীয় সংগীত ‘তিলূতিলূটেলাইয়া, তালেূতিলূতিলাইয়া’ গানটি গাইছিলো।

তেলাপিয়ার এই গানের মাঝে বাইম মাছ সেখানে এসে হাজির। সেও এসে শুরু করল তার ‘বুইমূবুইমূবুইম, বুইূবুই, বুইমূবুইমূবুইম’ সুরের গান। এই গান শুনে তেলাপিয়ার দল খুব রেগে গেলো। আমরা কত সুন্দর নিজেদের মধ্যে গান গাচ্ছিলাম। এর মধ্যে বাইম মাছ এসে নাক গলানো শুরু করেছে। কত আর ভালো লাগে এসব বেসুরো গান। তারা রাগ করে অন্যদিকে চলে গেল। 

বাইম মাছ তখন তার নিজের গান শোনাতে গেল চিংড়ি মাছের দলে। চিংড়ি মাছ তখন মাইকেল জ্যাকসনের মতো নাচতে নাচতে তাদের ঐতিহ্যবাহী সংগীত গাচ্ছিল। গানটা ছিল এরকম ‘চুূচাংচাংূচু, চাূচুূচাূচু, চিতাংূচিতাংূচুং, তাূচিতাংূচু’। এর মধ্যে বাইম মাছ এসে ‘বুইমূবুইমূবুইম, বুইূবুই, বুইমূবুইমূবুইম’ গান শুরু করে দিলো। চিংড়ি মাছের ঝাঁক তখন ক্ষেপে আগুন। তারাও তাকে পিঠ দেখিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। বাইম মাছ ভাবল কী ব্যাপার, আজকে আমাকে দেখে সবাই এরকম মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কেনো। সে ভাবলো মনে হয় ওরা আমার গান শুনে হিংসা করছে। যাই হোক আমি অন্য মাছের দলে চলে যাই।

দিনে দিনে বাইম মাছের ‘প্রতিভার অত্যাচার’ বেড়েই চলল। তার গান অন্য মাছদের প্রশংসার বদলে নিন্দা কুড়াতে লাগলো। মাছেদের মায়েরা বাইম মাছের গান শোনানোর ভয় দেখিয়ে বাচ্চাদেরকে ঘুম পাড়াতে লাগলো। কারো সঙ্গে কারো রাগারাগি হলে ‘বাইম মাছকে ডেকে তোকে গান শোনাবো’ এরকম বাক্য শুনিয়ে অপমান করতে লাগলো। অন্যান্য বাইম মাছেরাও গায়ক বাইম মাছকে অপছন্দ করতে শুরু করেছে। তাদের ভাষ্য হচ্ছে তুমি কাঁদার তলার জন্মেছো, এটা নিয়ে সুখে থাকো না, তুমি কেন যাও পানির উপরিভাগে সকলের সাথে তাল মিলাতে। যার যেখানে স্থান তাকে সেখানেই মানায়। এরকম অবস্থা দেখে বাইম মাছের মন আরো বেশি খারাপ হয়ে গেলো। সে ভাবতে লাগলো আমার কী দোষ। চেয়েছিলাম ভালো কিছু করে সকলের মন জয় করব। এখন তো সবাই আমাকে আগের চেয়ে আরো বেশি ঘৃণা করতে শুরু করেছে। জাতে ওঠার চেষ্টা আমাকে দিনে দিনে আরও বেশি নিঃসঙ্গ করে তুলছে। কেননা তার এই দুর্নামের কারণে পুরো বাইম প্রজাতির দুর্নাম হয়ে যাচ্ছে।

এদিকে বাইম মাছের গানের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি পেতে সকল মাছেরা নিজেরা শলাপরামর্শ শুরু করল। তারা একদিন পুকুরের এক কোণে একটি ‘মৎস্য মিটিং’ আহ্বান করল। নির্ধারিত দিনে সকল প্রজাতির মাছ সেইখানে এসে উপস্থিত হলো। কীভাবে চলমান সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবেÑ এই নিয়ে নানান জন নানা মত উপস্থাপন করতে লাগল। কেউ বললো তাকে কাছে আসতে দেব না। এই প্রস্তাবনা নাকচ হয়ে গেল। পিছলে প্রজাতির মাছ হওয়ার কারণ বাইম মাছ কারো কথা শোনে না। সে নিজে থেকেই সকলের কাছে গান শোনাবেই। কেউ বললোÑ ওকে পুকুর থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। এই প্রস্তাবও নাকচ হয়ে গেল। কেননা পুকুর একটি সীমাবদ্ধ জায়গা। এর বাইরে যাওয়ার কোন উপায় নেই। নদী বা সমুদ্র হলে তাড়িয়ে দেয়ার একটা উপায় ছিলো। 

কেউ বলল ওকে যারা বড়শি ফেলে তাদের জালে ধরিয়ে দিতে হবে। এই প্রস্তাব কারো মন পুত হলো না। কারণ বাইম মাছ খুব চালাক সে বড়শিতে আদার করে না। কেউ বলল তাকে জেলেদের জালে আটকে ফেলতে হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটাও না হয়ে গেল। কেননা বাইম মাছ জাল ফেলার শব্দ শুনলেই কাঁদার একেবারে গভীরে ঢুকে যায়। ফলে তারা সহজে জালে ধরা পড়ে না। শেষ পর্যন্ত সবাই একমত হলো যে সে যেহেতু গান শোনাতে এখানে এখানে ঘুরে বেড়ায়। তাকে কোনো মাছরাঙা অথবা চিলের শিকার বানাতে পারলে খুব সহজে তার থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। বুদ্ধিটা সবার মনঃপূত হল। কিন্তু সমস্যা হল ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে’, মানে চিল অথবা মাছরাঙা পাখিকে এই বাইম মাছের কথা বলবে কে। কারণ যে মাছ তাদের সাথে কথা বলতে যাবে সেই মাছি উলটো শিকার হয়ে যাবে। না কোনো বুদ্ধি বুদ্ধিতেই সমস্যার একটি উপায় বের হলো না।

 শেষে তখন সব মাছেরা মিলে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, আজকে থেকে এই পুকুরে সব মাছের সব ধরনের গান গাওয়ার নিষিদ্ধ। কেননা সবার গান গাওয়া বন্ধ হলে বাইম মাছেরও গান গাওয়া বন্ধ হবে। অবশেষে এই সিদ্ধান্ত নিয়েই মিটিং সমাপ্ত হলো। পুরো পুকুরে সকল প্রকার গান গাওয়া গান গাওয়া নিষিদ্ধ হয়ে গেল। বাইম মাছের মন খারাপ হয়ে গেল। সে আর গান গাইতে পারবে না। তাই সে আবার কাদার তলে ফিরে গেল। সেই থেকে মাছেদের গান গাওয়া চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। একসময় সব মাছেরা গান গাওয়া ভুলেই গেলো।

গল্প থেকে শিক্ষা:

যার যে পরিবেশে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা তাকে সেই পরিবেশেই মানায়। আর দু একটি দুষ্ট লোককে প্রতিরোধ করার না গেলে, তাদের কারণে সমাজের অনেক ভালো ভালো অর্জনও নষ্ট হয়ে যায়। 


২০ মে ২০২৩


মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক, ঝিলমিল একাডেমি।

সম্পাদক-প্রকাশক, কিচিরমিচির।

০১৭১৭-০৯৫৭৫১


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ