ব্যক্তির আচার-ব্যবহার ও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যই মানুষের ব্যক্তিত্ব, সত্যতা ও সততার পরিচয়
আমি একটা মাছ বিক্রেতা ছেলেকে চিনি সকালে বাজারে মাছ বিক্রি করে আর বিকালে সুন্দর শার্ট-প্যান্ট পড়ে ঘুরে বেড়ায়। এক সবজি বিক্রেতা ছেলেকেও বিভিন্ন জাতীয় দিবসে পরিপাটি হয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখি। এক মুচিকেও হঠাৎ হঠাৎ পরিচ্ছন্ন পোষাকে দেখি।
পেশা যাই হোক সুন্দর পোশাকে তাদের দেখতে ভালোই লাগে। কিন্তু এদের কাছে গিয়ে একটু কান খাড়া করে তাদের কথা শুনবেন। বুঝবেন পোশাক পরিবর্তন করলেও এদের ভাষার পরিবর্তন নেই। কিছুক্ষণ তাদের পর্যবেক্ষণ করে দেখবেন তাদের আচরণেও পার্থক্য আছে। অর্থাৎ কথা বলার ধরণ ও আচরণে সে তার পেশার বৈশিষ্ট্যই ধরে রেখেছে। কথায় বলে ‘স্বভাব যায় না মইলে, ইজ্জত যায় না ধুইলে’।
পোশাক মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করলেও ভেতরকার সৌন্দর্যে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়ত ব্যতিক্রম, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গোবরে পদ্মফুল ফোটে না। কেউ কেউ পোশাকের সাথে আচরণও পার্থক্য আনার প্রাণান্ত চেষ্টা করলেও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, স্বার্থের দ্বন্দ্বে নিজের ভেতরকার কুৎসিত রূপটা তার ঠিকই প্রকাশ করে ফেলে।
এক সময় হাতে ঘড়ি পড়া, চোখে কালো সানগ্লাস পরা, শার্ট ইন করে পড়া, মাথায় ক্যাপ পরা, কোট, ট্রাই পড়া শিক্ষিত ও ভদ্র সমাজের পোশাক হিসেবে পরিচিত হলেও বর্তমানে প্রায় সকল পেশার লোকজনকেই এই ধরনের পোশাক পড়তে দেখা যায়। ফলে এখন আর পোশাক দিয়ে মানুষের শিক্ষা, দীক্ষা, বংশ, ব্যক্তিত্ব, কর্ম পরিচয় নির্ধারণ করা যায় না।
বন্ধের দিনে মার্কেটে গেলে দোকানদার সরকারি অফিসের কর্মচারীকে সালাম দিয়ে বলে- আসেন স্যার, কি লাগবে বলেন। আর কর্মকর্তাকে বলে- কি লাগবে ভাই বলেন। পোশাকের গুণে অফিসার আর কর্মচারির সাথে দোকানদারের আচরণের এই পার্থক্য। মোদ্দা কথা, বাহ্যিক পোষাক আষাক নয়, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের ব্যবহার, আচরণ তার বংশ, শিক্ষা, দীক্ষা, কর্ম এবং বেড়ে ওঠার পরিবেশকে নির্দেশ করে।
কথাটি আবার অন্যভাবেও বলা যায় যে, সাধারণ পোশাক মানেই লোকটি সাধারণ তেমন ভাবারও সুযোগ নেই। শেখ সাদীর একটি গল্প আমরা জানি- সাধারণ পোশাক পরে এক খাবারের দাওয়াতে উপস্থিত হয়েছিলেন বলে তাঁকে খাবারের টেবিলে বসতে দেওয়া হয়নি। কিছুক্ষণ পরে তিনি আবার ভালো পোশাক পরে সেই দাওয়াতে উপস্থিত হন। এবং উপস্থিত লোকজন তাকে ভালোভাবে আপ্যায়ন করেন। শেখ সাদী তখন তার জন্য আনা খাবারগুলো নিজে না খেয়ে নিজের পোশাকের বিভিন্ন পকেটে ঢোকাতে থাকেন।
লোকজন এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন- এই খাবারগুলো আমাকে নয়, আমার পোশাককে দেওয়া হয়েছে। কারণ কিছুক্ষণ আগে আমি সাধারণ পোশাকে এখানে এসেছিলাম তখন আমাকে খাবার পরিবেশন করা হয়নি। তাই খাবার গুলো আমার পোশাককেই খাওয়াচ্ছি। কাজেই পোশাক সাধারণ হলেও ব্যক্তি সাধারণ হবেন- এমনটি ভাবারও অবকাশ নেই।
আমরা জানি দুষ্ট লোকের কথা মিষ্টি হয়। কাজেই চমৎকার পোশাক পরিচ্ছদ, চমৎকার কথাবার্তা, ভালো লেখালেখি, নান্দনিক কাজকর্ম, সমাজসেবা বা দেশপ্রেম দেখে তিনি ভালো মানুষ, ব্যক্তিত্ববান মানুষ, চরিত্রবান মানুষ বা ভালো বংশের ভাববার অবকাশ নেই। এগুলোও তাদের প্রকৃত পরিচয় নয়। বেশিরভাগ ভণ্ডরাই নিজেদের ভণ্ডামি আড়াল করতে সমাজে ভালো সাজার অভিনয় করে মাত্র।
বরং মানুষকে যাচাই করতে হয় অবস্থার কষ্টিপাথরে। অর্থাৎ স্থানকাল, পাত্র ভেদে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের নানা শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে তার আচরণই তার সত্যতার পরিচায়ক। কোন পরিবেশে কি পরেছে, কি বলেছে, কি লিখেছে, সমাজের নানা শ্রেণির মানুষের সঙ্গে তার আচরণ ও দৃষ্টি ভঙ্গির পার্থক্যই তার ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক।
সুতরাং বাহ্যিক পোশাক, বাহ্যিক আচরণ নয় বরং অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তির আচারব্যবহার ও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যই মানুষের ব্যক্তিত্ব, সত্যতা ও সততার পরিচয় নির্দেশ করে।
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
৯ মে ২৩
0 মন্তব্যসমূহ