Ticker

6/recent/ticker-posts

মোঃ রেজাউল করিম এর মৃত্যু | নিভৃতচারী একজন গুণী লেখক ও সাংবাদিকের চিরবিদায়। (স্মৃতিচারণ)

(স্মৃতিচারণ)
মোঃ রেজাউল করিম এর মৃত্যু
নিভৃতচারী একজন গুণী লেখক ও সাংবাদিকের চিরবিদায়।
                                        --------------------মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ


“যাদের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া ধন্য”, “ভাষা আন্দোলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া” “বিদ্রোহী কবির মর্মকাহন” সহ বেশ কয়েকটি গবেষণাধর্মী বইয়ের লেখক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া রিপোটার্স ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, সাপ্তাহিক তিতাস পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক, শ্রদ্ধেয় মোঃ রেজাউল করিম ভাই মৃত্যুবরণ করেন গত ২ ফ্রেব্রুয়ারি ২২ খ্রি.। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি শিশু-কিশোর সংগঠন ঝিলমিলের অন্যতম সদস্য ও পরিচালনা পরিষদের সাবেক পরিচালক এবং নিউজবাংলা২৪ডটকমের জেলা প্রতিনিধি মজহারুল করিম অভির পিতা।
 
“কেউ সরব থেকে মানুষের মন থেকে মুছে যায়,
কেউ নীরব থেকেও হাজারো মানুষের মনে জায়গা করে নেয়”।

সদ্য প্রয়াত লেখক ও সাংবাদিক মোঃ রেজাউল করিম ছিলেন তেমনই একজন মানুষ। তিনি নীরবে-নিভৃতে সাহিত্য ও সাংবাদিকতার সেবা করে গেছেন। ফলশ্রুতিতে পেয়েছেন অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা। যার স্বরুপ আমরা দেখতে পাই তাঁর মৃত্যুর পর, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন ব্যক্তির শোক প্রকাশের বন্যা দেখে। শুধু তাই নয়; পরদিন জেলা ইদগাহ ময়দানে জানাজার মাঠে মরহুমের আত্মীয় স্বজনসহ বিপুলসংখ্যক কবি, সাহিত্যিক, লেখক, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সেই বিষয়টির প্রমাণ বহন করে।


মোঃ রেজাউল করিম বাল্যকালেই লেখক ও সাংবাদিক হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন তার পূর্বপুরুষ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আরেকজন কৃতিসন্তান, দেশখ্যাত কবি মোঃ আবদুল কাদিরের কাছ থেকে। 

“লক্ষ মানুষের প্রচলিত জীবন ধারা, লক্ষ হৃদয়ের মধুর পূর্ণ কল্পনাকে 
নিজের মধ্যে ধারণ করলেই ভালো লেখক হওয়া যায়”।

ছোট বেলায় এই বাক্যটি তিনি শুনেছিলেন তাঁর দাদা কবি আব্দুল কাদিরের কাছ থেকে এবং এটিই ছিলো তাঁর লেখক ও সাংবাদিক হওয়ার পেছনের মূলমন্ত্র। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাই তিনি লেখালেখি নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন।


সংবাদ সংগ্রহ তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। খড়ের গাদায় হারিয়ে যাওয়া সুই খোঁজার মতই সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে লুকিয়ে থাকা নানা বিষয়ে সংবাদ তিনি খুঁজে বের করতেন। আর তা অবলিলায় প্রকাশ করতেন পত্রিকায়। তাঁর সাজানো গোছানো “সাপ্তাহিক তিতাস” অফিসে সাংবাদিকতায় দীক্ষা পেয়েছেন অনেক সাংবাদিক। পেয়েছেন সংবাদ প্রকাশের শক্তি ও সাহস। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সংবাদ প্রকাশের কারণে একসময় তাকে একটি দুঃখজনক পরিণতি বরণ করতে হয়েছে।

একসময়ের সাংবাদিকতা ও বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজে প্রচুর ব্যস্ত থাকলেও বিগত এক দশকে তিনি প্রায় অনেকটা নিভৃতচারী ছিলেন। এ সময় তিনি বেশকিছু গ্রন্থ রচনায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হলেও আরো কয়েকটি বই প্রকাশের অপেক্ষায় ছিলো।


মোঃ রেজাউল করিম রক্তে মাংসে গড়া মানুষ ছিলেন। আর মানুষ মাত্রই ভুলত্রুটির উর্ধ্বে নয়। কর্মজীবনে তারও নানা ভুল-ভ্রান্তি থাকতে পারে, তবে তিনি যে কয়েটি মহৎ কর্ম আমাদের কাছে রেখে গিয়েছেন। সেই মহৎ কর্মের মাধ্যমে তিনি আমাদের সবার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

মরহুমের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় শিশু সংগঠন ঝিলমিলের কাজ করতে যেয়ে। ২০০৯/১০ সালে ঝিলমিলের বিভিন্ন নিউজ নিয়ে কাজী মাহমুদ শাহ রোডে অবস্থিত উনার পত্রিকা অফিসে নিয়ে যেতাম। তিনি আমাদের সংগঠনের নিউজগুলো গুরুত্বসহকারে ছাপাতেন এবং সাংগঠনিক বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।


একটা সময় বিশেষ কারণে পত্রিকাটি সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে উনার সাথে আমার যোগাযোগও কমে যায়। পরবর্তীতে ২০১২/১৩ সালে আমার একটি কাজের প্রায় সময় উনার কাছে যাওয়া হতো। তিনি তখন আমাকে নানানভাবে উৎসাহ ও পরামর্শ দিতেন। যেই সময়টাতে আমি উনার কাছে যেতাম। ওই সময়ে নানান কারণে অনেকেই আমাকে গুরুত্ব দিতেন না। কিন্তু তিনি আদর-স্নেহে কাছে টেনে নিতেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উপকার করতে যথেষ্ট আন্তরিকতার পরিচয়ও দিয়েছেন।

তারো কিছুকাল পরে উনার ছেলে মজহারুল করিম অভি ঝিলমিলের সাংগঠনিক কাজে যুক্ত হয়। অভি যখন আমার সাথে দেখা করতে আসতো বা সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত থাকতো সে সময় তিনি অভি-কে মাঝে মাঝে কল দিতেন। অভি বলতো ‘মনির ভাইয়ের কাছে আছি”, তখন বুঝতে পারতাম উনার কাছে আমার একটা মূল্যায়ন আছে। আমাদের কাছে থাকায় নিজের ছেলেকে নিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত থাকতেন।


মাঝখানে কিছুদিন বিরতি দিয়ে ২০১৯/২০ সালে সাহিত্যচর্চার সুবাদে আবার ওনার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। “কবির কলম” ও “চেতনায় স্বদেশ” এর সাংগঠনিক কাজ বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উনার সাথে নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ হতে থাকে।

তার লেখা “ভাষা আন্দোলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া” বইটি তিনি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। আমি দিয়েছিলাম “মেঘের ভেলা” বইটি। কাজীপাড়া বা কালীবাড়ি মোড় গেলে মাঝে মাঝে উনার সাথে দেখা হতো। বরাবরের মতই তিনি যথেষ্ট স্নেহ করতেন, চা খাওয়াতেন। আমি নিজেকে যাদের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছি তার মধ্যে তিনি একজন ছিলেন। আমি তাঁর কাছ থেকেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অনেক অজানা ইতিহাস জেনেছি।

তাঁর এক চিলতে হাসি, একটি মধুর ডাক, এক কাপ চা,
কিছু আড্ডা, কিছু উপদেশ,
আর শোনা যাবে না। তা ভাবতেই অবাক লাগে।


গুণী এই মানুষের আকস্মিক মৃত্যুতে আমি যারপরনাই ব্যথিত ও দুঃখিত। কবি ও কবিতা বিষয়ক সংগঠন ‘কবির কলম’ ও শিশু কিশোর  সংগঠন ’ঝিলমিল একাডেমি’ পরিবারের সকলের পক্ষ থেকে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি এবং মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। আমিন। আশা করি তার বড় ছেলে অভি বাবার মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠে পরিবারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বাবার সুনাম ধরে রাখবে। 

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
কবি ও সংস্কৃতিকর্মী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ খ্রি. 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ