Ticker

6/recent/ticker-posts

অধ্যাপক হরলাল রায়-এর জীবন ও কর্ম

 অধ্যাপক হরলাল রায়-এর জীবন ও কর্ম


বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বাংলা ভাষা সাহিত্যের গবেষক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ  সাহিত্য একাডেমির সভাপতি, অধ্যাপক হরলাল রায় ছিলেন একজন বহুমাত্রিক প্রতিভা। ১৯৮৮ সালে মার্চ এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে। আমৃত্যু তিনি ছিলেন একজন সৃজনশীল চেতনার মানুষ। নানা রকম জ্ঞান, গবেষণার সঙ্গে তিনি নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল সারাদেশে। বন্ধু মহলে তিনি ছিলেন সদালাপী, সজ্জন, নিরহংকার সংকীর্ণ চিন্তা চেতনার উর্ধ্বে একজন মানুষ। তিনি তাঁর জ্ঞান, গুণ সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের জন্য একজন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি হিসেবে অমরত্ব লাভ করেছেন

হরলাল রায় জন্মে ছিলেন কুমিল্লা জেলার বর্তমান দেবীদ্বার উপজেলাধীন ধামতি গ্রামে ১৯৩৫ সালের ২৯ নভেম্বর। তার পিতার নাম হৃদয়চন্দ্র রায় মাতার নাম মাতাঙ্গিনী দেবী। পাঁচ ভাই তিন বোনের মধ্যে হরলাল রায় ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর চার ভাই মনীন্দ্র রায়, গোপাল রায়, রাখাল রায় গোপাল রায় তিন বোন প্রমীলা দেবনাথ, মিলন দেবনাথ, অঞ্জলি ভৌমিক। হরলাল রায়ের দুই পুত্র ভাষণ রায়, কল্লোল রায় এক কন্যা ভারতী রায়। আলোকিত কর্মজীবনের মতো তাঁর শিক্ষা জীবন একটি স্মরণীয় অধ্যায়

পাঁচ বছর বয়সে হরলাল রায়ের শিক্ষা জীবন শুরু হয় ধামতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে দুবছর পর তিনি গঙ্গামন্ডল রাজ ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন কুমিল্লার ঈশ্বর পাঠশালায়। তীক্ষ্ণধী ছাত্র হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাত ছিলেন। ১৯৫০ খৃষ্টাব্দে তিনি ঈশ্বর পাঠশালা থেকে ১ম বিভাগে তৎকালিন এন্ট্রান্স বা ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তৎকালিন এন্ট্রান্স বা ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো ইন্ট বেঙ্গল সেকেন্ডারী এডুকেশন বোর্ড, ঢাকার অধীনে আর উচ্চ মাধ্যমিক স্নাতক শ্রেণীর পরীক্ষাগুলো ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৫৪ খ্রীষ্ঠাব্দে তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক (আই.এস.সি) এবং ১৯৫৬ খ্রীষ্ঠাব্দে বি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অতঃপর উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য বাংলা ভাষা সাহিত্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫৭ খ্রীষ্টাব্দে তিনি এম. প্রথম পর্ব পরীক্ষায় মেধানুসারে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং ১৯৫৮ খ্রীষ্টাব্দে দ্বিতীয় শ্রেণিতে দ্বিতীয় হয়ে এম. ডিগ্রি লাভ করেন। সে বছরই লা সেপ্টেম্বর থেকে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যাপনার দায়িত্ব নিয়ে চাকুরি জীবন শুরু করেন। সেখানে প্রায় এক বছর দুই মাস চাকুরির পর তিনি ১৯৫৯- এর ১লা নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে যোগদান করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ সরকারি হবার পর ১৯৭৯- মে সহকারি অধ্যাপক হিসেবে তাঁর পদোন্নতি হয়। ১৯৮৪- ২৫ এপ্রিল সহযোগী হিসেবে পদোন্নতি নিয়ে তিনি সাতকানিয়া সরকারি কলেজে বদলী হন। সেখান থেকে ১৯৮৬- ১৪ মার্চ তিনি উপাধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়ে পুনরায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে ফিরে আসেন। আমৃত্যু এই দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। মাঝখানে দীর্ঘ আট মাস তাঁকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করতে হয়

১৯৫৯ সালের অধ্যাপক হরলাল রায় চাকুরিসূত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসেন। কালক্রমে এখানেই স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন। ১৩৬৯-এর (১৯৬২) ১৪ আষাঢ় তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাইকপাড়াস্থ রমণীমোহন দেবনাথ এর কন্যা রমা রায়কে বিয়ে করেন

শিক্ষকতা জীবনের দীর্ঘ ত্রিশ বছর কাল অধ্যাপক হরলাল রায়ের আলোকসামান্য প্রতিভা বিভিন্ন ক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছে। শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, সাহিত্য সমালোচক গবেষক এবং বহু পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা সাহিত্যের পরীক্ষক হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষকতাকে তিনি শুরু পেশা হিসেবেই নেননি, নেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। শিক্ষাবিস্তার এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, বিভিন্ন সংস্থা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়েছেনও। একদিকে তিনি যেমন একজন প্রশিক্ষক, অন্যদিকে তেমনি ছিলেন প্রশিক্ষণার্থীও। শিক্ষকতার আদর্শ এই দেয়া নেয়ার বিষয়টিকে তিনি পুরোপুরিভাবেই আত্মস্থ করেছিলেন। ১৯৮১ খ্রীষ্টাব্দে তিনি বাংলায় বি..আর .আই এবং ১৯৮৬ তে নিয়েয়ার পরিচালত কলেজ প্রশাসনে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন

পি.এইচ.ডি করার আগ্রহ তাঁর প্রথম থেকেই ছিল। কিন্তু নানা কারণে সুযোগ করে উঠতে পারছিলেন না।১৯৭০-৭১ এর দিকে ব্যাপারে খুবই আগ্রহান্বিত হয়ে উঠেছিলেন। ডক্টর দিনেশচন্দ্র সেনের ওপর পড়াশুনা শুরু করেছিলেন। বিষয়ে প্রচুর বই-পত্রও সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাঁকে স্বপরিবারে দেশত্যাগ করতে হয়। সবকিছু ফেলে রেখে তিনি ভারতে চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি বৃহত্তর স্বার্থে জড়িত হয়ে পড়েন। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তৃতা দিয়েছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য দায়িত্ব পালন করেছেন। তৎকালিন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে অবস্থানরত বাংলাদেশের কলেজ শিক্ষকদের নিয়ে বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি (পূর্বাঞ্চলীয়) গঠিত হয়। হরলাল রায় ছিলেন এর সহ-সভাপতি। সভাপতি হয়েছিলেন মুজিবনগর সরকারের পূর্বাঞ্চলীয় কার্যালয়ের প্রধান, চট্টগ্রামের জহুর হোসেন চৌধুরী। আর সম্পাদক ছিলেন সরাইলের শেখ মোঃ আবু হামেদযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার পূর্বে হরলাল রায় পি.এইচ.ডি করার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তালিকাভুক্ত হয়ে আসেন।

কিন্তু দেশে ফিরে এসে তিনি খুবই হতাশ হন। অনেক কষ্টে জোগানো বই-পত্র, আসবাবপত্র, ঘরদোর সব লুট হয়ে গেছে। ধাক্কা সামলাতে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করার জন্য।কিন্তু তিনি দমলেন না।পুনর্বাসনে মনোনিবেশ করলেন। ধীরে ধীরে সবকিছু গুছিয়েও নিলেন। এরই মধ্যে কেটে গেলো দীর্ঘ সতেরটি বছর। পি.এইচ.ডি করার জন্য আবারো উৎসাহি হয়ে উঠলেন। এবার তালিকাভুক্ত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে দীনেশচন্দ্র সেনের ওপর থিসিস তৈরির প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন। বিষয়ে একটি খসড়া পরিকল্পনাও অনুমোদন করিয়েছিলেন।আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধিশীর্ষক পরিকল্পনাটিতে দীনেশ চন্দ্র সেন সম্পর্কে গবেষণা গ্রন্থ রচনার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘বাংলা ভাষা সাহিত্যের সমৃদ্ধির জন্য যে মনীষী আজীবন কর্ম করে গেছেন তার কাছে বাঙ্গালী জাতি চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই উপমহাদেশে আচার্য সেনের ওপর কোন গবেষণামূলক বা জীবন-চরিত্র গ্রন্থ আজ পর্যন্ত কেউ রচনা করেননি। বাঙ্গালী যে আত্মাবিস্মৃত জাতির তার আর একবার প্রমাণ মিললো। লজ্জা ঢাকবার উপায় নেই। আচার্য সেনের ওপর গবেষণামূলক কাজ করার বাঙ্গালী জাতির জাতীয় কর্তব্য।এই অঙ্গীকার নিয়েই তিনি গবেষণা কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু কাজটি তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। আরও অনেক মহৎ পরিকল্পনার মতো কাজেও তাঁকে অতৃপ্তি নিয়েই চলে যেতে হল

বাংলা সাহিত্যের একজন শিক্ষক, গবেষক, চিন্তক হরলাল রায়ের সমধিক খ্যাতি ছিল একজন খ্যাতিমান বৈয়াকরণ হিসেবে। ব্যাকরণের নানা বিষয় নিয়ে তিনি অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। বাংলা ব্যাকরণকে তিনি সহজ সরল ভাষা উপমায় ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট উপস্থাপন করেছেন। শতাধিক বছরের বাংলা ব্যাকরণের দুর্বোধ্যতা দূর করে তিনি একে সহজতর রূপদান করেন

তাঁর রচিতউচ্চতর ব্যাকরণ ভাষা সেকালের সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ ১৯৬৩ গ্রন্থটি পুঁথিঘর লিমিটেড, ঢাকা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির বহু সংস্করণ বেরিয়েছে। ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যেপযোগী বাংলা ব্যাকরণ সাহিত্য বিষয়ক বহুগ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত প্রায় প্রতিটি গ্রন্থ একাধিক সংস্করণ রয়েছে। প্রতিটি সংস্করণেই তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নতুন বিষয় আঙ্গিক যোগ করেছেন। পরিবর্তনশীল সমাজ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনেই তিনি একাজটি করেছেন। সম্পর্কেউচ্চতর ব্যাকরণ ভাষাগ্রন্থের পূর্বভাষণে তিনি বলেছেন, ‘স্থান কাল ভেদে রূপান্তর হচ্ছে মানুষ মানুষের মন। তাই একশো বছর আগের পৃথিবী এখন নেই, আর একশো বছর পরেও আজকের পৃথিবী থাকবে না। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়, নতুবাএই পৃথিবীতে টিকে থাকা দায়।রূপান্তরের নীতিকে মেনে নিয়েই তিনি প্রতিটি গ্রন্থের ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণে পরিবর্তন পরিমার্জন করেছেন। এদিক থেকে তিনি রক্ষণশীল ছিলেন না মোটেই। সৃজনশীল ছিলেন। যে কারণে তাঁর প্রতিটি গ্রন্থই পাঠক-প্রিয়তা অর্জন করেছে।

হরলাল রায় রচিত কোন না কোনো গ্রন্থ পাঠ করেনি এমন ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা আজ দুর্লভ। তাঁর রচিত গ্রন'গুলোর মধ্যেউচ্চতর ব্যাকরণ ভাষা’ ‘ব্যাকরণ রচনা’ , ‘বাংলা ব্যাকরণ রচনা,’ ‘এসো ব্যাকরণ শিখি’, ‘রচনাদর্শ’, ‘কিশোর বাংলা ব্যাকরণ রচনা, ছোটদের ব্যাকরণ রচনা, ‘দেবভাষা প্রবেশ, ’সঞ্চয়ন,’ ‘সংস্কৃত পাঠ,’ ‘বাংলা ছন্দের রূপরেখা’ ‘চর্যাগীতি’, উচ্চতর বাণিজ্যিক বাংলা, বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব গ্রন্থ স্কুল পর্যায় থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে পঠিত হয়ে থাকে

বিভিন্ন গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে তিনি আমাদের পাঠ্যপুস্তক শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নকল্পে গবেষকের ভূমিকা পালন করেছেন। প্রফেসর মনিরুজ্জামানের ভাষায়, ‘মিশনানী উৎসাহ নিয়েতিনি পথে নিযুক্ত ছিলেন। স্মারক গ্রন্থে সংকলিতহরলাল রায়ঃ প্রাসঙ্গিক কথনশীর্ষক রচনায় তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের দেশে অনেকেই ব্যাকরণ রচনায় আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, রচনা বইও লিখেছেন বড় বড় সাহিত্যিকদের অনেকেই। কিন্তু তাঁদের প্রচেষ্টাকে যিনি ম্লান করতে পেরেছিলেন, তিনি হরলাল রায়। ব্যাপারে হরলার রায়ের কৃতিত্বের কথা উল্লেখ করে তিনি আরো লিখেছেন, ‘টেকস্ট বই রচনার কাজকে এখন বিদেশে বৈজ্ঞানিক করার চেষ্টা হচ্ছে। বিষয়ে বহু প্রতিষ্ঠানে গবেষণা হচ্ছে। বহু জায়গায় নিয়ে সেমিনার পর্যন্ত হয়েছে হচ্ছে। হরলাল রায় সেই সব শিক্ষা এবং ভাষা বিষয়ক গবেষকদের কথা জানতেন কিনা জানি না। কিন্তু তিনি একক প্রচেষ্টায় সাধারণ জ্ঞানে যা করে গেছেন, এখন পর্যন্ত কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে আমরা তার বিকল্প পাইনি।

কিন্তু পাঠ্য পাঠ্যসহায়ক গ্রন্থ রচনাতেই হরলাল রায় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তা নয়, বাংলা সাহিত্যের মৌলিক গবেষণাতেও তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, তারচর্যাগীতিগ্রন্থে বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের ওপর তাঁর পর্যালোচনা গ্রন্থচর্যাগীতি গ্রন্থে তিনি বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। বইটির মূল্যায়ন প্রসঙ্গে প্রফেসর মনিরুজ্জামান লিখেছেন, ‘বইটাতে একটা সহজ আকর্ষণ আছে, ছাত্রদের অনেক প্রশ্নের সহজ সমাধান আছে, অনেক পরিশ্রম এখানে সংক্ষিপ্ত হয়ে এসেছে। পন্ডিতদের বই অনেক ছাত্রেরই বোধগম্য হয় না, হওয়ার কারণ নেই। হরলাল সেতুর কাজ করেছেন রকম ছাত্রদের জন্য গ্রন্থের জন্যে ১৯৬৯ সালেরতিতাস সাহিত্য পরিষদতাঁকেতিতাস সাহিত্য পুরষ্কারেভূষিত করে

শিক্ষা সাহিত্য গবেষণা ছাড়াও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে হরলাল রায়ের অবদান উল্লেখযোগ্য। আমৃত্যু তিনি নিজেকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত রেখেছিলেন। তিনি ১৯৭৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অনুষ্ঠিত মাসব্যাপী শিল্প, সাহিত্য সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় সাহিত্য বিষয়ক পত্র-পত্রিকা প্রদর্শনের জন্য তিনি পুরষ্কৃত হন। ১৯৮৮ সালে জেলা ভিত্তিক জাতীয় গ্রন্থ সপ্তাহে পারিবারিক লাইব্রেরির জন্য তিনি বিশেষ পুরষ্কার লাভ করেন

জীবন দর্শনে অধ্যাপক হরলাল রায় ছিলেন মানবতাবাদীমানুষের সাথে মানুষের কোনরূপ প্রভেদ তিনি মানতেন না। ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাস করতেন কিন্তু গোঁড়ামি ছিল না। নিজে ধর্মীয় আদর্শ মেনে চলতেন, কিন্তু অন্যকে বাধ্য করতেন না। সকল ধর্মের প্রতিই তাঁর মিত্রভাব ছিল। সমস্ত ধর্মের মধ্যেই যে উত্তম আদর্শ আছে তার প্রশংসা করতেন।যত মত তত পথএকথাও তিনি ততটাই বিশ্বাস করতেন যতটা মানবিক। মানুষের জন্যই ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়- বিশ্বাসে তিনি বলীয়ান ছিলেন

অত্যন্ত ধীর-স্থির এবং শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি। জীবনে অনেক দুঃখ দেখেছেন, কিন্তু দুঃখের কাছে পরাজয় মানেননি। হতাশা দেখেছেন, কিন্তু তা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন। কঠিন জীবন দেখেছেন, কিন্তু সারল্য ত্যাগ করেননি। অনেক বাঁধা-বিপত্তি বৈরিতার সম্মূখীন হয়েছেন, কিন্তু মনোবল হারাননি। সবকিছুর উর্ধ্বে জ্ঞান ছিল তাঁর সাধনার বিষয়। গভীর জ্ঞান দিয়েই সবকিছুর মোকাবেলা করেছেন। নিজেই নিজেকে বড়ো মহৎ করে তুলেছিলেন তিনি

সাহিত্য একাডেমির সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল নিবিড়। তিনি এর সভাপতি ছিলেন আমৃত্য অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। নানা ব্যস্ততার মাঝেও সাহিত্য একাডেমির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সিদ্ধান্ত সভায় উপস্থিত থেকেছেন। গঠনমূলক আলোচনা সমালোচনা করেছেন। একাডেমির নীতি নির্ধারণ কর্মসূচী বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে অত্যন্ত গভীরভাবে ভালোবেসেছেন। ভালোবেসেছেন এর সঙ্গে যাঁরা জড়িত তাঁদের সবাইকে, এর কার্যক্রমকে। সাহিত্য একাডেমির বিভিন্ন দূর্যোগপূর্ণ মুহুর্তেও তিনি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন

হরলাল রায়ের প্রকাশিত গ্রন্থাবলী

. চর্যাগীতি: বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের ওপর আলোচনামূলক গ্রন্থ (১৯৬৯)

. উচ্চতর ব্যাকরণ ভাষা: স্নাতক শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়ক গ্রন্থ (১৯৬৩)

. ব্যাকরণ রচনা: মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্য গ্রন্থ (১৯৬২)

. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস: স্নাতক স্নাতকোত্তর শ্রেণীর সহায়ক গ্রন্থ (১৯৬৪)

. বাংলা ছন্দের রূপরেখা: স্নাতক স্নাতকোত্তর শ্রেণীর সহায়ক গ্রন্থ (১৯৬৪)

. উচ্চতর বাণিজ্যিক বাংলা: স্নাতক স্নাতকোত্তর শ্রেণীর সহায়ক গ্রন্থ (১৯৬৪)

. সঞ্চয়ন: (স্কুল পাঠ্য) বাংলাদেশ স্কুল টেকস্ট বুক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত গ্রন্থ: (১৯৮০)

. গল্প সঞ্চয়ন: (স্কুল পাঠ্য) বাংলাদেশ স্কুল টেকস্ট বুক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত গ্রন্থ (১৯৮১)

. দেবভাষা প্রবেশ: (স্কুল পাঠ্য) বাংলাদেশ স্কুল টেকস্ট বুক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত গ্রন্থ (১৯৮১)

১০. সংস্কৃত পাঠ: (স্কুল পাঠ্য) বাংলাদেশ স্কুল টেকস্ট বুক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত গ্রন্থ (১৯৮১)

১১. বাংলা ব্যাকরণ রচনা: (স্কুল পাঠ্য) বাংলাদেশ স্কুল টেকস্ট বুক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত গ্রন্থ (১৯৮০)

১২. এসো ব্যাকরণ শিখি: (স্কুল পাঠ্য) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়ক গ্রন্থ

১৩. রচনাদর্শ: (স্কুল পাঠ্য) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়ক গ্রন্থ।

১৪. কিশোর বাংলা ব্যাকরণ রচনা: (স্কুল পাঠ্য) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়ক গ্রন্থ।

১৫. ছোটদের ব্যাকরণ রচনা: (স্কুল পাঠ্য) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়ক গ্রন্থ।

অগ্রনি' কয়েকটি রচনা:

. ঊনিশ শতকে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবসা (প্রবন্ধ), ঢাকা, ১৯৫৬

. উৎসব তাৎপর্য (প্রবন্ধ), পূরবী, আসাম, ১৯৫২

. কবি সুকান্ত (প্রবন্ধ) সাহিত্য একাডেমীর পত্রিকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ১৯৮৪ (স্মারকগ্রন্থে সংকলিত)

. রবীন্দ্রনাথ ধূলির ধরণী (প্রবন্ধ), ইত্তেফাক, ঢাকা ১৯৫৬

. অজিত গুহ (প্রবন্ধ) আজাদ, ঢাকা ১৯৬২

. মহাকবি হোমার (প্রবন্ধ) আজাদ, ঢাকা, ১৯৬২

. মধুসূদনের মানবতা (প্রবন্ধ) ইত্তেফাক, ঢাকা ১৯৫৮

. বাংলা সনের কথা (প্রবন্ধ) সাপ্তাহিক প্রতিবেদন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া (১৯৮১)

. মানবতার চাবি (প্রবন্ধ) সাহিত্য একাডেমি, কলকাতা (১৯৫৪)

১০. দূরে আরো দূরে (প্রবন্ধ), প্রতিধ্বনি, বেনারস (১৯৫০)

১১. মনের গহনে (প্রবন্ধ), প্রতিধ্বনি, বেনারস (১৯৫২)

১২. তরঙ্গ (গল্প), প্রতিধ্বনি, বেনারস (১৯৫৬)

১৩. জন্মান্তর (গল্প) প্রতিধ্বনি, বেনারস (১৯৬৩)

১৪. মুক্ত কণ্ঠ (প্রবন্ধ), শতদল, ঢাকা হল বার্ষিকী (১৯৫৮)

১৫. পরিণতি (প্রবন্ধ), দৈনিক লোকসেবক, কলকাতা (১৯৫০)

১৬. মালবিকা (প্রবন্ধ), দৈনিক লোকসেবক, কলকাতা (১৯৫৫)

১৭. তংকাহিকোলক (রম্যরচনা), দৈনিক লোকসেবক, কলকাতা (১৯৫৫)

১৮. গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ (প্রবন্ধ), রবীন্দ্র স্মরণিকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া (১৯৭২)

১৯. রবীন্দ্রনাথের মহুয়া নাম্নি কবিতাগুচ্ছ (প্রবন্ধ), সমাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া (১৯৭২)

২০. রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অভিযোগ (প্রবন্ধ), ভেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া (১৯৭৪)

২১. সম্পাদক নজরুল (প্রবন্ধ), স্বজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া (১৯৮২)

২২. মানিক বন্দোপাধ্যায় (প্রবন্ধ), সাপ্তাহিক প্রতিবেদন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

২৩. শাশ্বত সাহিত্য (প্রবন্ধ), সাপ্তাহিক মা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

২৪. সংস্কৃতি সাংস্কৃতিক সম্মেলন, পাক্ষিক পরিচয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

২৫. একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় চেতনা, প্রবাহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

২৬. স্বাধীনতা দিবসের ভাষা (অপ্রকাশিত), ব্রাহ্মণবাড়িয়া

২৭. ক্ষেপা বৈশাখ (প্রবন্ধ), ব্রাহ্মণবাড়িয়া


তথ্য সংগ্রহ :

অধ্যাপক হরলাল রায় স্মারকগ্রন্থ- সম্পাদনা, জয়দুল হোসেন।

অধ্যাপক হরলাল রায় জীবনী সমগ্র ডাঃ কল্লোল রায়

আপলোড: মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ